পথ বিষয়ক পণ্ডশ্রম | জিয়া হক | আঙ্গিক ব্লগ



রাস্তা ও পথের পার্থক্য কী
? সড়ক, সরণি আর মার্গ? ‘পথ’-এর আগে ‘রাজ’ যোজনা করে কী বোঝাতে চাই আমরা? ‘পথভ্রষ্ট’ দিয়ে কি পথের বাইরের কাউকে ইঙ্গিত করা হয়? রিলিজিয়ন বলে, ঈশ্বর-অবিশ্বাসী পথভ্রষ্ট। ‘সিরাতুল মুস্তাকিম’ অবলম্বনের কথা রয়েছে। এক সহজ, সরল, সোজা পথ যেখানে ‘মহাজন’-দের যাতায়াত। একটি প্রার্থনা এমন ছিল-- যে পথ তোমার কাছে পৌঁছেছে, সেই পথের সন্ধান দাও, হে ঈশ্বর! পুনঃ পুনঃ চাইতে হয়। শনৈ শনৈ বলতে হয়। এই যে মুনাজাত, তা কি কেবল ঈশ্বরকে জানানো? নিজেকেও জানানো নয়? অচেতন মনের সঙ্গে সচেতন মনের কথোপকথন নয়? মুরিদ প্রশ্ন করলেন, নিজের সবটুকু তো নিজের কাছে প্রকাশিত। কীভাবে আবার তা জানানো যায় নিজেকে? মুর্শিদ জানতে চান, ‘সবটুকু’?

- অনেকটা।

- অনেকটা?

- বেশ খানিকটা।

- বেশ খানিকটা?

ধরো, তোমাকে একটা সোনার পথ, একটা রুপোর পথ আর একটা মাটির পথ দেওয়া হল। তুমি কোন পথে যাবে?

- মাটির পথে। হ্যাঁ, মাটির পথই তো।

মুর্শিদ মৃদু হেসে সামনে ধূ-ধূ প্রান্তরে বয়ে চলা আঁকাবাঁকা অসংখ্য পথের দিকে তাকালেন অনাড়ম্বরে। গ্রীষ্মের দুপুর। তিনি বললেন, তুমি কি জানো তুমি কী বলছো? মুরিদ জানান, তিনি জ্ঞানত নির্বাচন করেছেন এই পথ। ‘আরেকবার ভাবো’--মুর্শিদ-- এত তাড়াতাড়ি উত্তর দাও, সেটা আমি চাই না’। সোনা ও রুপো প্রত্যাখ্যান করে মাটি বেছে এক ত্যাগের মহান কাহিনি রচনা করেছেন ভেবে পুরনো জবাবকে আরও আঁকড়ে, আরও জোর দিয়ে প্রতিষ্ঠা করতে চাইলেন মুরিদ।

পুরুষতান্ত্রিক সমাজের একেবারে বিপরীতে দাঁড়িয়ে ঋতুপর্ণ কখনও ‘ফেমিনিস্ট’ হতে চাননি | আঙ্গিক ব্লগ

এরপর মুর্শিদ শুধু বললেন, কোন পথ কোথায় যাচ্ছে তা না জেনেই তুমি পথ বেছে নিলে?

- কিন্তু আমার তো আনন্দ পথ চলাতেই। মহাকবির সেই উক্তির প্রতিধ্বনি করেন মুরিদ।

- তাহলে যে-কোনও একটা পথ হলেই তো তোমার চলে? আলাদা করে মাটিকে ধরলে কেন?

- ঘাসের আনন্দ নেব বলে।

- কিন্তু ঘাসকে হত্যা করেই যে পথের সৃষ্টি হয়। পথের দু’পাশে তুমি ঘাস পেতে পারো, তবে পথের ওপরে নয়। আর যদি পেয়েও যাও, সেই ঘাস মৃত। আর কে বলল, সোনা-রুপোর পথের ধারে ঘাস-গাছালি থাকবে না? তুমি কি জানতে চেয়েছ? পথের বিবরণ নিয়েছ?

বহুমুখী পথের সামনে এসে আমরা আশ্চর্য হয়ে ভাবি, এত পথও ছিল বুঝি! পাঁচমাথা, ছ’মাথা মোড়ে নাবালকের দিক গুলিয়ে যায়। সে আকাশের দিকে তাকায়। সূর্যের গতিবিধি লক্ষ করে। এই নাবালকত্ব শুধু বয়সের সংখ্যা দিয়ে পরিমাপ্য নয়। বয়সকে তো নয়, মানুষ প্রণাম জানায় অভিজ্ঞতাকে। নব্য পথের সঙ্গে অভিজ্ঞতার সুসম্পর্ক নেই। যে বাজারে যেতে চায়, সে বাজারের পথ ধরে। যে উপাসনালয়ে, সে উপাসনালয়ের। যার কোথাও যাওয়ার নেই, সে যে-কোনও পথে যায়। পথটাই কি তার গন্তব্য? আচার্য বলেন, না, ফিরে আসাটা।

‘ও বিদ্যেসাগর, আমাদের খাবার দে’; সবাইকে ভুট্টা পরিবেশন করলেন তিনি | আঙ্গিক ব্লগ

হাজার বছর ধরে একটাই লোক কি হাঁটছে পৃথিবীর পথে? আমি না কার্যত আমরা, একা নাকি অনেকে এইসব রয়েছে। কিন্তু ক্রমান্বয়ে হাঁটছে কেন কেউ? কীসের সন্ধান? আত্মানুসন্ধান? ‘আত্ম’-কে পেয়ে ‘অপর’-এর বিষয়টি বুঝে নেওয়া? এই অপর বহু মাত্রায় ছড়িয়ে রয়েছে। কার সঙ্গে, কতদূর, কীভাবে তুলনায় গেলে ‘নয়া’ কিছু সম্ভাবনার পথ তৈরি হবে তা কি জানা? অথচ পথে বের হতেই হয় কেননা গৃহও বস্তুত এক ‘পথ’ বৈ আর কী? কেউ গৃহী মানে তিনি গার্হস্থ্যের পথ নির্বাচন করেছেন। একইভাবে, কেউ সন্ন্যাসের, কেউ উপপ্লবের, কেউ স্বীকারের, কেউ নাকচের, কেউ স্বস্তির, কেউ সংশয়ের, কেউ নাচের, কেউ চিত্রকলার, কেউ আক্রমণের, কেউ আত্মগোপনের। সবই পথ, সবই বিশেষ অবস্থান। মুরিদ বলেন, পথ চিনব কীভাবে? কে চেনাবে? প্রকৃত পথ

মুর্শিদ বললেন, আগুনে হাত দাও।

হাত পুড়ে যাবে তো!

কে বলে দিল?

জানি।

কে জানালো?

অভিজ্ঞতা।

আগে কি তোমার হাত কখনও পুড়েছে?

না, কিন্তু আগুনে পোড়ার কথা শুনেছি।

যিনি বলেছিলেন তাঁর হাত কি পুড়ে গিয়েছিল?

না, তিনিও শুনেছেন কিংবা দেখেছেন।

অনুভূতি হয়েছে?

নিজের সঙ্গে না ঘটলে অনুভব করবেন কীভাবে?

যেটা অনুভূত নয়, সেটা কি ‘অভিজ্ঞতা’?

তাহলে কী হবে?

নামো।

কোথায়?

পথে।

আদিদেব মুখোপাধ্যায়ের ডিসেম্বরে লেখা কবিতা

ভাবুক লিখেছেন সংক্রমিত হয়ে এলো বেলা/ পুরুষোত্তম, কী চাইছ, কহো/ ধান্য নিবে? নাকি পরিচিতি?/ তারা আছে ভিতরে, বাহিরে/ কিলো দরে দয়ামৃত নেবে?/ পথ এসেছে তোমায় নেবে ব’লে/ এ জন্মে আর রং পছন্দ হবে?

পথে নেমে পথকে করুণা করা হয় নাকি পথই আমাদের ধারণ করে করুণা করে? পদক্ষেপ হবে নম্র, প্রথম ঘাসটির মৃত্যুর দায় নিয়ে অপরাধী। সমস্ত অক্রবক্র পথই সোজা, সব সোজা পথই কার্যত আঁকাবাঁকা। দোকানে যাবার পথ আর ‘মুক্তি’র পথ কি অভিন্ন হয়?

ব্যবহৃত ছবিঃ আন্দ্রেই তারকোভস্কি

মন্তব্যসমূহ

জনপ্রিয় লেখা