পুরুষতান্ত্রিক সমাজের একেবারে বিপরীতে দাঁড়িয়ে ঋতুপর্ণ কখনও ‘ফেমিনিস্ট’ হতে চাননি | আঙ্গিক ব্লগ



পুরুষতান্ত্রিক সমাজের একেবারে বিপরীতে দাঁড়িয়ে ঋতুপর্ণ কখনও ‘ফেমিনিস্ট’ হতে চাননি
- শ্রেয়ণ

সমাজ যেমন প্রান্তিক মানুষদের বুঝতে চায় না, দূরে ঠেলে দেয়, তেমনি প্রান্তিক মানুষরাও সমাজের মূল স্রোত থেকে নিজেদের বিচ্ছিন্ন করে রাখে, সচেতনভাবেই, হয়তো বা কিছুটা অভিমান থেকে। বাস্তব হল এটাই, ‘প্রান্তিক’ কিংবা ‘সংখ্যালঘু’ – এই শব্দগুলো যতদিন আমাদের কথাবার্তায় চালু থাকবে, ততদিন আমরা কেউই পুরোপুরি ‘মানুষ’ হয়ে উঠতে পারব না। ততদিন ঋতুপর্ণের মতো কিছু লোককে দরকার হবে, যাঁদের দিকে মেনস্ট্রিম সমাজ আড় চোখে তাকাতে গিয়ে থমকে যাবে, আবার চোখে চোখ রেখে কথা বলার হিম্মতও ফেলবে হারিয়ে।


ঋতুপর্ণ কিন্তু সবাইকে আপন করে নিতেই চেয়েছিলেন। সেই যোগ্যতা ছিল তাঁর। ‘আপনি’-র দূরত্বকে কাটিয়ে সবাইকেই এনে ফেলেছিলেন ‘তুই’-এর পরিবারে। সিনেমার কথাই ধরা যাক, মেনস্ট্রিম ছবির যাঁরা স্টার – কলকাতা হোক বা মুম্বাই – তাঁদেরকেই কী সাবলীলভাবে নতুন অবতারে হাজির করেছেন তিনি। তা সত্ত্বেও তিনি কত একা, কত বিচ্ছিন্ন, নিদ্রাহীনতার সঙ্গে লড়াই করে রাত্রির পর রাত্রি কেটে যেত তাঁর। সেই যন্ত্রণা কি সৃজনশীলতার, নাকি প্রান্তিকতার? আসলে সব সৃজনশীল মানুষই প্রান্তিক। কিন্তু সব প্রান্তিক মানুষই কি সৃজনশীল? এই প্রশ্নের উত্তর তখনই পাওয়া যাবে, যখন সমাজে কেউ প্রান্তিক থাকবে না। তখন কি সৃজনশীল মানুষরাও হারিয়ে যাবেন? কে জানে? 

ঋতুপর্ণ নিজেকে বলতেন সত্যজিৎ রায়ের উত্তরসূরী। অথচ, সত্যজিতের ঘরানায় যে ম্যাসকুলিনটি – তাকে অতিক্রম করে ঋতুপর্ণ তৈরি করে ফেলেছেন নিজস্ব শৈলী, যা হয়ে উঠেছে কিছু মানুষের পরিচয়, কিছু মানুষের অধিকারের লড়াই। ঋতুপর্ণ বলতেন ‘উইমেনিজম’-এর কথা। পুরুষতান্ত্রিক সমাজের একেবারে বিপরীতে দাঁড়িয়ে তিনি ‘ফেমিনিস্ট’ হতে চাননি। ‘পুরুষ’ এবং ‘নারী’ – এই দুই বিপরীতের মাঝখানে ধূসর পৃথিবীতে অস্তিত্বের জন্য লড়াই করে যাচ্ছেন আরও অনেক মানুষ – সমকামী, উভকামী, অকামী, রূপান্তরকামী, বৃহন্নলা এবং আরও অনেকে। ফেমিনিস্টরা এই ধূসর জগৎটাকে ধরতে পারেন না, কিন্তু উইমেনিস্টরা পারেন। 

এই ধূসর মানুষদেরও অনেক স্তর আছে, রয়েছে সামাজিক-সাংস্কৃতিক-অর্থনৈতিক নানা হায়রার্কি, সবার কাছে হয়তো ঋতুপর্ণ পৌঁছতে পারেননি, হয়তো তাঁর অবস্থান অনেকটাই এলিটিস্ট। তা সত্ত্বেও, তাঁর সততারই লক্ষণ সেটা, মেকি সাবঅল্টার্ন সাজার ভণ্ডামি ছিল না তাঁর মধ্যে। এরকমও অভিযোগ এসেছে, ধনতন্ত্রের সমস্ত সুযোগ-সুবিধে ঋতুপর্ণ অবলীলায় গ্রহণ করেছেন, তাই পুঁজিবাদী শোষণ-অবদমনের বিরুদ্ধে তিনি বড়ো নীরব। যাঁরা এই কথা বলেন, একটা সহজ ব্যাপার তাঁরা বুঝতে পারেননি, পুঁজিবাদি আগ্রাসন শুধুমাত্র অর্থনৈতিক নয়, অন্য সব অবদমনের মতোই পুঁজিবাদও প্রবলভাবে পুরুষতান্ত্রিক, যা তথাকথিত প্রগতিশীলরা এড়িয়ে যান। ‘চিনপন্থা’ আর ‘রুশপন্থা’র বাইরে তাঁরা কিছুই ভাবতে চান না, বা পারেন না। আজ ঋতুপর্ণের জন্মদিন। আজকের দিনে আমরা তো সিদ্ধান্ত নিতেই পারি, বস্তাপচা চিন্তাভাবনাগুলো থেকে বেরিয়ে এবার থেকে ঋতুপর্ণকে নতুন করে বিশ্লেষণ করব, তার সঙ্গে সমাজটাকেও।

মন্তব্যসমূহ

জনপ্রিয় লেখা