হাওয়াই চটি অথবা চোখ ফোটার গল্প


||  দেবহূতি সরকার  ||



হঠাৎই তরকারি কাটতে কাটতে হাওয়াই চটিটা ছিঁড়ে গেল। শ্রীময়ী দেখল। একদিকের স্ট্র্যাপটা খুলে এসেছে। তখনও একটা কাঁকরোল বাকি, কোলে খোসা রাখার প্যাকেট। এখন নিচু হয়ে বেশি দেখতে গেলে প্যাকেটটা পড়ে খোসাগুলো ছড়িয়ে যাবে। শেষ কাঁকরোলটার খোসা ছাড়ানো হলে প্যাকেটটা টেবিলে রেখে নিচু হল। স্ট্র্যাপ্টার নিচের অংশটা ছিঁড়ে আলাদা হয়ে গেছে। তিন বছর হল। আর চলবে না। চটিটা খুলে সরিয়ে রাখে। বাথরুম যাবে। খালি পা। ও মা, ওই তো বাথরুমের বাইরে মায়ের হাওয়াইটা। কিছু না-ভেবেই সে শেষ পর্যন্ত মায়ের চটিতে পা-টা গলিয়েই ফেলল। তার খুব হাসি পেল। বেহায়ার মতো, শয়তানের মতো, খুনখুনে বুড়ির মতো করে হেসে ফেলল সে।  

বেশ কিছুদিন যাবৎ তার খুব হাসি পাচ্ছে, অস্থানে-কুস্থানে হেসে ফেলছে। অন্যকে এর’ম নিজের মনে হাসতে দেখলে সে কেবলই প্রশ্ন করে, কেন হাসছিস? তারা ক্ষেপে যায়। শ্রীময়ী দেখেছে এই ‘কেন’ প্রশ্নগুলোই যত নষ্টের গোড়া। হয় মানুষ রেগে যায় বা বিব্রত হয় বা ভাবতে শুরু করে অথবা হাই তোলে। কেউ কেউ অবশ্য মুচকি মুচকি হাসেও। তো সে যাই হোক। এই যে ও অস্থানে-কুস্থানে আপন মনে হেসে ফেলছে, ও বুঝতে পারছে অন্যরা কেন হাসে, আর ওর আরও হাসি পাচ্ছে। ওর কেমন যেন হিজিবিজবিজের মতো হাসি পাচ্ছে। 

হিজিবিজবিজকে ওর ভারি পছন্দ। কী মিস্টি কান রে বাবা। একবার একটা পেপারে ও সুকুমার রায়কে হিজিবিজবিজ লিখে ফেলেছিল। তারপর ম্যাডামের মুখটা মনে পড়ে যাওয়াতে জিভ কেটে ডিলিট করে দেয়। ও না, তখন তো ও কাগজে লিখত। তাহলে কেটে দেয়।

কথাটা হল কান। শ্রীময়ীর কানে দুটো করে ফুটো, মানে দুল পরার বিঁধ আর কী। একটা বুজে গেছিল। ও তো তখন মানে ছোটবেলায় মাথা নিচু করে দৌড়ত, তাই দুল পরার কথা অত মনে থাকত না। ফলে একটা অকাজের বিঁধ ও কানে নিয়ে ঘুরে বেড়ায়। এমনিতেই ওর খুব কান। মা খালি বলে- ওফফ, তোকে বলছি না, তুই শুনছিস কেন, আর শুনছিসই যদি তো উত্তর দিচ্ছিস কেন? মায়েরও খুব কান। ও মাঝরাতে মুখে কাপড় গুঁজে কাঁদলেও মা এসে দরজা ধাক্কা দেয়। ও তখন মটকা মেরে পড়ে থাকে। কানে কান চেনে। মা-ও ওকে চেনে। মাঝে মাঝে বলে- তুই আমার পেটে হয়েছিস না আমি তোর পেটে? আচ্ছা ও কি পেটে হয়েছিল? মানে ও কখন হল? পেটে না পেট থেকে বেরিয়ে। ধুর বাবা, যত বাজে প্রশ্ন! কাঁকরোলগুলো ভাজতে হবে ভাত খেতে হবে তো না কি?

ডালটায় আবার পোড়া পোড়া গন্ধ পাচ্ছে। আজকাল ওর খুব নাক হয়েছে। সেদিন সকালে খামোকা উঠে পড়ে নিজের ঘরে বসে রান্না ঘরে মায়ের লাগানো অল-আউটের গন্ধ পেয়ে গেল। প্রথমে ভাবলো যাবে না। তারপর হাঁচি পেতে লাগল। তখন গিয়ে অল-আউট বন্ধ করে ফ্যান-ট্যান চালিয়ে নিজেকে বেশ তারিফ করল, কেমন বুদ্ধি করে রান্নাঘরে ফ্যানটা লাগিয়েছিলাম! মা শুধু বলল, রুটিগুলো ফোলে না। এই রে, হাওয়া তো ফুলবে কী করে! তারপর ফ্যানটা রিভলভিং বলে ঘুরিয়ে দিল ঠিকই, কিন্তু খচখচ করতে লাগল। ও দেখেছে, ভোরের বেলায় উঠে পড়লেই মা হেব্বি ক্ষেপে যায়। দুপুরবেলা ঘুম থেকে উঠলেও ক্ষেপে যায়, কিন্তু সেটা দুপুরে ঘুম থেকে ওঠার অভ্যেসটা খারাপ বলে। কিন্তু ভোরবেলা উঠলে ক্ষেপে যাওয়াটা ঠিক তেমন ক্ষেপে যাওয়া নয়। ভোরে উঠলেই ও মা আর বাবার সব হিসেব গন্ডগোল করে দেয়। হিসেবের অভ্যেস আর কী! সেই এটা কেন, ওটা কেন প্রশ্ন করে। যদিও সত্যেন স্যর ওকে প্রশ্ন করত বলেই মনে রেখেছিলেন। তবুও প্রশ্ন করাটা মোটেই ভালো জিনিস নয়। জ্ঞান বেড়ে যায়। খুব খারাপ। খুবই।

ভোরবেলা তাহলে গাছেদের কাছে যাওয়া যাক। ভাবল। ওদের প্রশ্ন করলেও ওরা কিছু বলে না। ওরা ভালো। আরে, পঞ্চমুখী লাল জবাটায় ফুল হয়েছে! সল্টলেকের নার্সারি থেকে এনেছিল। সল্টলেকে মিস্টি জলের গাছ। হেসে ফেলে। দেখেছ, বলেছিলাম না, ও হেসে ফেলে। হাসতে হাসতেই জবাটার কাছে যায়। কী সুন্দর, ভেলভেটের মত। ও ছুঁয়ে দেয়। আরে দারুণ তো, এক্কেবারে কুকুরছানা ছোঁয়ার মতো। ধুকপুক করছে। নাহ, কুকুরছানাদের কথা ও আর ভাববে না। একটাও বাঁচে না। ওরা মোটে ভালো না, একটুও ধৈর্য নেই। ধ্যাত্তেরি, ছাদে উঠেও শান্তি নেই। খামোকা গাছ ছুঁয়ে কুকুর ছানাদের কথা মনে পড়ছে।

দুমদুম করে নিচে নেমে আসে। মা একবার কড়াচোখে দেখে। উঠে থেকে চিড়বিড় করছে এর’ম একটা ভাব। আহ, মা তাকিয়ে না থেকে চা দাও। চা’টা ঠক করে নামিয়ে দিয়ে মা দাঁত ব্রাশ শুরু করে। এ মা! মা তুমি দাঁত না মেজে রান্না করছিলে! তুমি ইঁ করোনি? আর আমায় যে বড় বল ঘুম থেকে উঠে দাঁত না মেজে কিচ্ছু করতে নেই। আমি বলে কিনা দুপুরের ঘুম থেকে উঠেও দাঁত মেজে ফেলি। কেন বলো মা? উফফফফ আব্বার কেন। বিদ্যাপতি বলে গেছেন না, বড়রা ভুল করলেও ভুল ধরতে নেই। ঝটপট চা’টা তুলে নিয়ে ঘরে গিয়ে দরজা বন্ধ করে দেয়।

তার জিভে আজকাল বড় ধার হয়েছে। ওই জন্যেই বোধহয় খাবার বিস্বাদ লাগছে। কিন্তু না তো, ও তো এখন ফার্স্ট ফ্লাস খুঁজে খুঁজে কিনে আনে। কৃষ্ণনগরের বাড়িতে চাটনি অবধি রেঁধে ফেলে। গরম চাটনি আর ঠান্ডা চাটনির মিষ্টতা যে আলাদা বুঝতে পারে। মানে চাটনিটা বেশি টক হয়ে গেছিল আর কী! খ্যাক খ্যাক খ্যাক। সিদ্ধার্থ ভয়ে ভয়ে বলল, বাঙালিরা বোধহয় চাটনিতে আর একটু মিষ্টি খায়। ভয় পেল কেন? 

মাকে আত্মীয় স্বজনরা এত ভয় পায় কেন? ও-ও কি পায়? মা চোখ করে। ওহ! চোখকে ভয় পায়। মার চোখ এমনিতে খুব সুন্দর। চোখ জিনিসটা ভালোই। ট্রেনের ওই বাচ্চাটার চোখটা কী বড়বড়। ওই বাজে লোকটার চোখটা কেমন কুতকুতে ছিল। বাজে লোকেদের চোখ কুতকুতেই হয় বোধহয়। ও বাবা, ওই গালে হাত দেওয়া টুপি পরা রবীন্দ্রনাথের চোখটা কী ছুড়ির মতো ছিল রে বাবা। ভাগ্যিস ছবিটা ভেঙে পড়ে গেল। কলেজে প্রিন্সিপালের চেয়ারের ঠিক উলটোদিকে এক পিস ওই ছবি আছে। ওসি কি করে থাকেন কে জানে। সরকারি জিনিস। নামাতেও পারেন না। ভেবে ও ফিক করে হেসে উঠল। 

এই রে, ওর কি চোখ উঠল! হে ভগবান। জিনিয়া ক’দিন ধরেই বলছিল, ওকে নাকি মায়ের মতো দেখতে হয়ে যাচ্ছে। হে ঠাকুর, বাঁচাও ঠাকুর আজ ও মায়ের চটিটা পরতে গেল কেন। তারপরেই কীসব ছাইভস্ম লিখছে। হে ঠাকুর বাঁচাও ঠাকুর, হাওয়াই চটিটাকেই একবার পেন্নাম ঠুকে নেয়। আর আবারও হেসে ফেলে।

|| আঙ্গিকে কবির গদ্য ৯ ||

মন্তব্যসমূহ

Jinia বলেছেন…
কবিকে কবিতায় চেনা যায়, গদ্যেও চেনা যায়। চেনা যায়? বড় হৃদয়স্পর্শী, বাঙময়।

জনপ্রিয় লেখা