‘ও বিদ্যেসাগর, আমাদের খাবার দে’; সবাইকে ভুট্টা পরিবেশন করলেন তিনি | আঙ্গিক ব্লগ





তন্ময় ভট্টাচার্য

তাঁকে নিয়ে আজ উৎসাহের কমতি নেই। ছিল না সেদিনও। আবার, সেই উনিশ শতকেও প্রচুর মানুষের বিরোধিতার সম্মুখীন হয়েছিলেন তিনি। কয়েকমাস আগে তাঁর মূর্তির ওপর আক্রমণেও পরোক্ষে সেই বিরোধিতারই ছায়া। বিদ্যাসাগর নিজে কি পরোয়া করতেন এসবের? চাইলে নিজের প্রচার করতে পারতেন তিনি অনায়াসেই। তার যোগ্য মানুষ ছিলেন তিনি। অথচ নাম নয়, কাজকেই প্রাধান্য দিয়ে এসেছেন সারাজীবন। এমনকি শেষ বয়সেও, ভাই শম্ভুচন্দ্র বিদ্যারত্ন তাঁর জীবনী লিখতে শুরু করলে, বিদ্যাসাগর বলে দিয়েছিলেন দানের কথা না লিখতে। অনেকে অপ্রস্তুত হতে পারে তাতে। অথচ প্রচুর মানুষের দিন গুজরান হত বিদ্যাসাগরের দেওয়া মাসোহারাতেই। পরবর্তীকালে শম্ভুচন্দ্র কিছু কিছু জানিয়েছেন। কিছু জানাননি। না জানালেও, আজ আর অজানা নেই বিদ্যাসাগরের ক্ষুদ্রাতিক্ষুদ্র অবদান। বাংলার শ্রেষ্ঠতম মনীষী বলা হয় তাঁকে। কিন্তু তাত্ত্বিকদের দেওয়া এই বিশেষণ সরিয়ে রাখলে, সাধারণ মানুষ কি তাঁকে গ্রহণ করতে পেরেছে আজও?

প্রৌঢ় বয়সে, আশেপাশের মানুষের ওপরচালাকি ও অকৃতজ্ঞতায় বিরক্ত হয়ে গিয়েছিলেন তিনি। পাড়ি দিয়েছিলেন সাঁওতাল পরগনায়, কর্মাটাঁড়ে। বাইরের কারণ অবশ্য স্বাস্থ্যের জন্য হাওয়া পরিবর্তন। সেখানে, স্টেশনের পাশেই বাংলো ও বাগান ছিল তাঁর। আর ছিল অসংখ্য সাঁওতাল নারী ও পুরুষ। তাঁরা জানতেন না, বিদ্যাসাগর কে। তাঁদের ‘বিদ্যেসাগর’ খিদে পেলে খাবার জোগান দেন, শরীর খারাপ হলে চিকিৎসা করেন – এতেই খুশি তাঁরা। বিদ্যাসাগরও সহজে মিশে গিয়েছিলেন তাঁদের সঙ্গে। নিজের পরিচয় ও সাফল্য কখনও বাধা হয়ে দাঁড়ায়নি। এমনকি, সাতসকালে তাঁদের চিকিৎসার জন্য বেরোতেও কসুর করতেন না তিনি।

কর্মাটাঁড়ে থাকাকালীন, বিদ্যাসাগরের কাছে গিয়েছিলেন হরপ্রসাদ শাস্ত্রী। একসঙ্গে কাটিয়েছিলেন বেশ কয়েকদিন। সেই দিনগুলিরই অভিজ্ঞতার কথা লিখেছেন তিনি। দেখে অবাক হয়েছেন, বিদ্যাসাগরের মতো একজন বড় মাপের মানুষ কীভাবে বন্ধু হয়ে উঠছেন সাঁওতালদের। সকাল হতে না হতেই পাঁচ-ছটা ভুট্টা নিয়ে হাজির এক সাঁওতাল। তাঁর দাবি, ভুট্টাগুলো নিয়ে পাঁচ গণ্ডা টাকা দিতে হবে তাঁকে, ছেলের চিকিৎসার জন্য। বিদ্যাসাগর টাকা দিয়ে কিনে নিলেন ভুট্টাগুলি। আরেক সাঁওতাল বাজরাভর্তি ভুট্টা নিয়ে হাজির, টাকার দরকার তাঁরও। আট গণ্ডা টাকা দিয়ে বাজরাটাই কিনে নিলেন বিদ্যাসাগর। এভাবে একে একে হাজির হলেন প্রচুর সাঁওতাল, সবার সঙ্গে ভুট্টা। যে যা দাম চাইছেন, তাই দিচ্ছেন বিদ্যাসাগর। দেখতে দেখতে ভুট্টায় ভরে উঠল তাঁর ঘর।

খানিক পরে, এলেন এক সাঁওতালনী। বললেন, ‘বিদ্যেসাগর, আমার ছেলেটার নাক দিয়ে হু হু করে রক্ত পড়ছে, তুই যদি এসে তাঁকে বাঁচাস।’ হাতে একটা পাথরের বাটিতে হোমিওপ্যাথিক ওষুধ নিয়ে রওয়ানা হলেন সঙ্গে-সঙ্গে। মাইল দেড়েক দূরের সেই গ্রামে পৌঁছে গেলেন হেঁটেই। ছেলেটিকে এক ডোজ ওষুধ দিতেই বন্ধ হয়ে গেল রক্ত পড়া। দেখে অবাক হলেন বিদ্যাসাগরও। হরপ্রসাদকে বললেন, এরা বেশি ওষুধ খায় না বলেই অল্প ওষুধেই উপকার হয়। ওদিকে কলকাতার লোকেদের ওষুধ খেয়ে খেয়ে পেটে চড়া পড়ে গেছে, তাই যথেষ্ট পরিমাণ না খেলে কাজ দেয় না কখনওই।
একসঙ্গেই বাড়ি ফিরলেন দু’জন। উঠোনে তখন পুরুষ-মেয়ে-ছেলে-বুড়ো সাঁওতালদের ছড়াছড়ি। কোথাও পাঁচজন, কোথাও আটজন, কোথাও আবার দশজন – আলাদা-আলাদা দল করে বসে আছেন তাঁরা। প্রত্যেকের সামনেই শুকনো পাতা ও কাঠ। বিদ্যাসাগরকে দেখেই শুরু হল চেঁচামিচি। সকলেরই এক কথা – ‘ও বিদ্যেসাগর, আমাদের খাবার দে!’ কী সহজ চাওয়া! সপাট, ভণিতাহীন। যেন মায়ের কাছে ছেলে আবদার করছে খাবারের। বিদ্যাসাগর নিজে হাতে ভুট্টা পরিবেশন করতে লাগলেন সাঁওতালদের মধ্যে। একেকজন দুটো-তিনটে করেও নিলেন। পাতা ও কাঠে আগুন জ্বালিয়ে, সেই আগুনে ভুট্টা সেঁকে খাওয়ার তৃপ্তি তাঁদের চোখেমুখে। খাওয়ার পর, যাওয়ার আগে হাসিমুখে ‘খুব খাইয়েছিস, বিদ্যেসাগর’ বলে তাঁদের বিদায়। বিদ্যাসাগর হাসছেন। বারান্দায় দাঁড়িয়ে, এ-দৃশ্য দেখে হাসছেন হরপ্রসাদও। বোঝাই যাচ্ছে, দু-একদিনের নয়, রোজকার ব্যাপার এটি। এখানে না এলে দেখাও হত না। জানাই যেত না, শ্রেষ্ঠ বাঙালি কর্মবীর কর্মাটাঁড়ে এসে এমন জীবনযাপন করছেন।

হ্যাঁ, এমনই ছিলেন বিদ্যাসাগর। প্রবীণ বয়সে বাবাকে কুণ্ঠিত মুখে জানিয়েছিলেন, কলকাতায় এবার একটা বাড়ি করতে চান তিনি। নিজের জন্যে নয়, কিন্তু অসংখ্য বই রয়েছে তাঁর সংগ্রহে; বইগুলির যত্নের জন্যেই নির্দিষ্ট একটা ঠিকানা প্রয়োজন। অথচ এর আগে প্রায় পঞ্চাশ বছর কলকাতায় কাটিয়েছেন তিনি, বিভিন্ন ভাড়াবাড়িতে। তাঁর আশঙ্কা ছিল, কলকাতায় বাড়ি হয়ে গেলে বীরসিংহের গ্রামের শিকড় ভুলে যেতে পারেন। এভাবে আত্মশাসন করেছেন, বারবার। শহরে থেকেছেন, জড়িয়েছেন বিভিন্ন আন্দোলনে, শিক্ষকতা করেছেন সেরা প্রতিষ্ঠানগুলিতে, ওঠাবসা ছিল সাহেবদের সঙ্গেও। এতকিছুর পরেও নিজের ভেতরের সারল্য নষ্ট হতে দেননি তিনি। ‘আধুনিক’ হয়েছেন, ‘শহুরে’ হননি কোনোদিনই।

যাবতীয় কর্মকাণ্ডের পাশাপাশি, এমন যাপনের জন্যই তিনি ‘বিদ্যাসাগর’। বাঙালির সৌভাগ্য, এমন একজন ছিলেন তাদের মধ্যে। বাঙালির দুর্ভাগ্য, আর কেউ এলেন না এমন...

মন্তব্যসমূহ

জনপ্রিয় লেখা