শুভদীপ মৈত্রর কবিতাগুচ্ছ | আঙ্গিক অনলাইন


শুভদীপ মৈত্র

লেপচা জগত ১

অনেকটা হেঁটে গেলে তবে
জুতোর নিচে পাথর, ঘাস, ফার্ন 
এ সমস্ত আর আলাদা থাকে না
একটা নিরন্তর নাচের ছন্দ
শরীরে খেলে যায়
আর কুয়াশার পর্দা সরিয়ে
কোনো একটা পাখির ডাক 
অথবা ঝিঁঝিঁই হয়তো 
বলে যায় এত বড় পাহাড়টাকে 
তুমি আর দেখতে পাবে না
কারণ তুমি নিজেই তার একটা 
মামুলি টুকরো হয়ে গেছ।
এভাবেই অমিতাভ আমাকে
প্রস্তরীভূত করে দিয়েছিলেন, 
তারপর থেকে আমি আর কখনো 
কোথাও যাই না, 
নিজেকেই মনে হয় 
পাহাড়ের কোলে বসা লেপচা জগত।।


লেপচা জগত ২

সবাই বেরিয়ে গেলে আমি জল চাপাই,
ভাত ফুটবে, ঘিয়ে রঙা চাল শাদা ফুল ফুল হবে
আলু আছে, পেঁয়াজ নেই, মাখনও নেই
সবচেয়ে বাজে লাগল ভেবে বাসন মাজবে কে?
মিরিক থেকে এসময় লেপচার গাড়ি ছাড়ে
দার্জিলিঙে এসময় নাওয়াংস ট্রেকে বসলে
একটা বিয়ার আর যত্নে বানানো থুক-পা।
আমার ভাত চাপানোর সময় চলে গেলে
খাবারের ঘ্রাণ করুণার মতো চেপে বসে
তথাগত আমার সামনে ভাতের হাঁড়ি এনে ধরেন না
 বা নিদেন হাঁড়িয়া, শুকনো রুটি;
আমি তবু তার চোখের থালায় কত কিছু বেড়ে খাই।।

লেপচা জগত ৩

পাকদণ্ডি পেরিয়ে যাওয়ার আগে বোঝাও যায় না
কেউ দেখতে পেল, না কি কুয়াশা ঢাকল
নিজের আনন্দে কে হাঁটে দু একজন
 বাকি তো লটবহর আর বিকিকিনি
তারা কুয়াশা নিয়ে ঘোরে না।
যাদের কোনো গন্তব্য নেই বলে হেঁটে যাওয়া আছে
তাদের হাঁটার আড়ালটুকুই আসলে কুয়াশা।।

লেপচা জগত ৪

আমরা একে অপরকে নাম দিইনি
আমরা একসঙ্গে ঘুরেছি খেয়েছি  থেকেওছি
মাংস আর রস টেনে হুল্লোড়
কখনো সে আমার উপর চড়েছে কখনো আমি তার উপর
ঘামতে ঘামতে বা কাঁপতে কাঁপতে একে অন্যকে নিয়েছি
ঘুমিয়ে পড়েছি পাশে, তারপর উঠে গেছি
তবুও আমি তাকে কিছু বলে ডাকিনি,
তবু সে আমাকে কিছু বলে ডাকেনি
এভাবে স্মৃতির ভিতর তাই আমরা পরস্পরকে
হারিয়ে ফেলিনি কখনো,
আমাদের স্মৃতির দুঃখ নেই
আমাদের বোধ শূন্য ও করুণায় মিশে
 যে কোনো সময়ে ফিরে আসে
                  নাম নেই, তাই তা প্রত্যেক।।

লেপচা জগত ৫

সাজানো বাগান পেরিয়ে
ক্রমশ পাথুরে রাস্তাটা উঠতে থাকে
জঙ্গুলে বিন্যাসের দিকে 
পাথরের উপর পাথরকে ধরে রেখেছে
শুধুমাত্র সবুজ শ্যাওলা 
বৃষ্টিতে পা হড়কে যায়
তবুও ক্রমশ দ্রুত হয়ে গেল গতি
ব্যাগে জল নেই
হাতে সময় নেই
অথচ ছোট্ট হৃদটা আমাকে 
টেনে নিচ্ছিল চুম্বকের মতো 
যদিও কিছুই নেই সেখানে
কুয়াশা, জল, নৈঃশব্দ্য 
আর রাস্তাটা আরো উপরে উঠে গেছে
এই নেইয়ে পৌঁছে মুখের কাছে হাত জড়ো করে
হুঙ্কার ছাড়লাম কোনো প্রাজ্ঞ ভিক্ষুর মতো 
লামাহাটা এর চেয়ে উঁচুতে ওঠার মতো
সময় আমার জন্য রাখেনি
নেইয়েও থিতু হতে দিল না 
সে অলৌকিক জলাশয়
নিচে নামার পর শুনলাম
পর্যটকরা না-কি খুবই বিরক্ত 
অতটা হেঁটেও আমোদের সন্ধান না পেয়ে।। 

লেপচা জগত ৬

ম্যাল থেকে ঘোরানো রাস্তা দিয়ে নামতে নামতে
স্কুল ড্রেস পরা ফুটফুটে বাচ্চা
আর কেতবাজ সব টিন-এজারদের ফেলে
তাদের মিশনারি কোট টাই 
ছাতা ও রকমারি জুতোর মচমচে শব্দ 
অচেনা গানের সুর আর কাঁধের গিটার 
পেরিয়ে ক্রমশ গাছেদের পাঠশালায় ঢুকে পড়লাম
তারপর গিয়ে বসলাম কাঠের বুদ্ধ মন্দিরে  
মঠ-বালকের মতো। হাওয়া আর পতাকার ঘর্ষণে 
তখন অশ্রুত মন্ত্র পৌঁছচ্ছে সচেতন কোনো কানে
আমার অবশ্য সে প্রাপ্তি নেই 
তবু হীনযান শব্দট অশোভন, এ-কথা 
মৃদু হেসে বলেছিল এক প্রৌঢ় এখানেই
তাই মঠের দাওয়ায় ফিরে আসি সহজ বিশ্বাসে 
ন্যাপস্যাক নামিয়ে জল খেয়ে তারপর পা মেলে জিরোই
নিজেকে মনে করি থেরাবাদী পাখি এক 
বসে আছি জন্মজন্মান্তরের পারে।।   

মন্তব্যসমূহ

Manas বলেছেন…
ভালো লাগলো গো

জনপ্রিয় লেখা