হওয়ার মানে | দীপ শেখর চক্রবর্তীর গদ্য | আঙ্গিক


বৃহস্পতির বিখ্যাত লাল দাগটি(The great red spot) হয়তো আমাদের জীবনকালের মধ্যেই মিলিয়ে যাবে।আসলে এটি একটি বিরাট ঝড়।পৃথিবীতে এমন ঝড় কখনওই হতে পারে না।হওয়া সম্ভব নয়।

কয়েকদিন ধরেই একটি চিন্তা আমাকে চিবিয়ে খাচ্ছে।শুনলাম,একজন প্রায় মহাকাশ থেকে ঝাঁপ দিয়ে পৃথিবীর মাটি স্পর্শ করার ক্ষেত্রে নতুন বিশ্বরেকর্ড স্থাপন করেছেন। তার সেই ঝাঁপ দেওয়ার চলচ্চিত্র তিনি নিজেই ক্যামেরাবন্দি করেছেন। শোনা যাচ্ছে, ঝাঁপ দেওয়ার ঠিক পূর্ব মুহূর্তে তিনি যা বলছেন তার বাংলা করলে মোটামুটি এই দাঁড়ায়- আমি এই মুহূর্তে যা দেখছি, ইসস যদি সকলকে তা দেখাতে পারতাম।

কী দেখেছিলেন উনি?

ঈশ্বর নাকি মৃত্যু?

হয়ত বা মানুষের চিরন্তন একাকীত্ব।

মহাজাগতিক বিস্ফোরণের (The big bang) পর এই মহাকাশ ক্রমাগত প্রসারিত হয়ে চলেছে। এর সীমা কতদূর তা এখনও আমাদের পক্ষে জানা সম্ভব নয়। পৃথিবীর বয়স যতটা সেই সময় অনুসারে যে আলো আমাদের টেলিস্কোপে এসে পৌঁছোয় তা নির্ভর করে আমরা মহাকাশের একটা ধারণা করতে পারি মাত্র। হয়তো এখনও অনেক আলো আমাদের কাছে এসে পৌঁছোয়নি।আমরা অপেক্ষা করে যাচ্ছি।

অপেক্ষা, কী আশ্চর্য এক শব্দ।

যতক্ষণ অপেক্ষা আছে, ততক্ষণ আছে আশা। যতক্ষণ আশা ততক্ষণ জীবন।

ফ্রাঙ্কো-প্রুশিয়ান যুদ্ধের পর Camille Pissarro যখন স্বভূমিতে ফিরে এলেন ততদিনে তার অধিকাংশ ছবি হয় নষ্ট করা হয়েছে নয়ত তা চুরি হয়ে গিয়েছে। প্রায় পনেরোশো ছবির মধ্যে অবশিষ্ট আছে মাত্র ত্রিশ চল্লিশটি। Pissarro তখন কী দেখেছিলেন?

ঈশ্বর নাকি মৃত্যু?

নাকি নতুন করে সমস্তটা গড়ে তোলার এক জেদ।

তিনি পেরেছিলেন Impressionism আন্দোলনের এক মুখ্য পুরুষ হয়ে উঠতে। তবে সেই হয়ে ওঠা তো একদিনে নয়। মাঝে সুদীর্ঘ কাল। কে আশ্রয় দিয়েছিল তাকে?

অপেক্ষা নাকি সেই চিরন্তন একাকীত্ব।

Adrei Tarkovsky -এ একটি সাক্ষাৎকারে বলেছিলেন যুবকদের উচিৎ নিজেদের একা করতে শেখা। একা মানে নিঃসঙ্গ নয়। একা মানে গভীরভাবে পৃথিবীকে দেখার ধ্যান। তার Nostalgia (১৯৮৩) চলচ্চিত্রটির শেষতম দৃশ্যের কথা মনে পড়ে? প্রায় দশ মিনিট দীর্ঘ একটি দৃশ্যে Oleg Yankovsky একটি মোম জ্বালিয়ে পারাপার করতে চাইছেন।

কী পারাপার করতে চাইছেন?

শূন্যতা? স্মৃতি নাকি অপেক্ষা?

একদিক থেকে দেখলে সমস্ত স্মৃতিই একটা শূন্যতা।

সমস্ত অপেক্ষাই একটা শূন্যতা।

অপেক্ষার যেখানে শেষ সেটাও এক আশ্চর্য শূন্যতা। ক্রমাগত প্রসারিত হয়ে চলেছে এই আশ্চর্য মহাকাশের মতো।

বুদ্ধদেব বসুর ‘প্রথম পার্থ’ নাটকে যখন কৃষ্ণ কর্ণকে আগাম জানিয়ে দিলেন যে যুদ্ধের ময়দানে তিনি রথের চাকা বসিয়ে দেবেন। অর্জুনের বাণে কর্ণের মাথা ছিন্ন হয়ে ভূপতিত হবে, এই সাবধান বাণীর পরও কর্ণ যুদ্ধ থেকে নিজেকে সরিয়ে নিলেন না।

কর্ণ অপেক্ষা করলেন সেই মুহূর্তটির। এক দীর্ঘ অপেক্ষা।

এ কি আত্মহত্যা?

যিনি প্রায় মহাকাশ থেকে ঝাঁপিয়ে পৃথিবীর মাটি স্পর্শ করার বিশ্ব রেকর্ড করলেন তিনি জানতেন সামান্য এদিক ওদিক হলেই নিশ্চিত মৃত্যু। তাকে দীর্ঘ একটা শূন্যতা দিয়ে ফিরে আসতে হবে নিজের কাছে। একটা বিন্দুতে এসে সে পৃথিবীর মাটি স্পর্শ করবে। শুধুই কি পৃথিবীর মাটি স্পর্শ করা? আসলে নিজেকেও স্পর্শ করা। একটা বিন্দু- Space time singularity.

Pissarro ঝাঁপ দিলেন মহাশূন্যে। এক শূন্য থেকে শুরু করে আরেক শূন্যের দিকে। মাঝে পড়ে রইলো অপেক্ষা। হয়ে ওঠার অপেক্ষা। তারপর আবার নতুন এক ঝাঁপ।                                                                 

Nostalghia -র শেষ মোমবাতিটি নিভে যাবে একসময়। তবু তার নিভে যাওয়া পারাপারের স্মৃতিকে ভুলিয়ে দিতে পারবে না। নিভে যাওয়া বা জ্বলে ওঠা তো খালি দুটি মুহূর্ত। একটার পর আরেকটা বিন্দু যেমন অত্যন্ত স্বাভাবিক ভাবে আসে।

কর্ণ আত্মহত্যা করেননি। তিনি নিজের হয়ে ওঠার দিকে যাত্রা করতে চেয়েছিলেন। তিনি জানতেন, তার এই পরাজয় আসলে পরাজয় নয়। তার এই মৃত্যু আসলে একটি ঝাঁপ। প্রতিটি ঝাঁপের অতলে একটি বিন্দু থাকে। যে বিন্দু শিল্পীর, শিল্পের।

পৃথিবীর বয়স যত বাড়বে তত নতুন নতুন আলো এসে পৌঁছবে আর আমরা জানতে পারবো এই মহাকাশকে যতদূর আমরা ভেবেছিলাম তার থেকে অনেক অনেক বেশি। ক্রমাগত তা প্রসারিত হয়ে চলেছে। হয়তো একটি মোম হাতে।

হয়তো একদিন সেই একটি বিন্দুতে গিয়ে মিশে যাবে সমস্ত সৃষ্টি।নিজেকে স্পর্শ করার মুহূর্ত।

Space time singularity

তারপর আবার একটি চলা। আমার একটি ঝাঁপ। আবার এক দীর্ঘ অপেক্ষা।

বৃহস্পতির ভেতর থেকে বিখ্যাত লাল দাগটি ততদিনে মুছে যাবে। ততদিন কেন, হয়তো আমাদের জীবৎকালেই। একটি প্রকাণ্ড ঝড় যা পৃথিবীতে হওয়া কখনওই সম্ভব নয়। প্রবল তার গতিবেগ। ধীরে ধীরে শান্ত হয়ে যাচ্ছে। শান্ত হতে হতে একদিন একটি বিন্দুতে মিশে যাবে।

সবথেকে আশ্চর্য হল এই একটি বিন্দু

ভেতরে ঝড় ধরে যায়। প্রকাণ্ড মহাকাশের শূন্যতা ধরে যায়। দীর্ঘ অপেক্ষা ধরে যায়।

শুধু নেই ও আছের মধ্যে থাকা এই একটি বিন্দু।

অস্তিত্ব, একটি আশা।

একটি এমন বিন্দুর দিকে ছুটে চলেছি আমরা কর্ণের মতো।রথের চাকা বসে যাবে জানি।জানি অর্জুনের তীর অব্যর্থ।

তবু এই অস্তিত্বের মানে খুঁজে চলি।

আমাদের ভেতর Oleg Yankovsky হাত দিয়ে মোমের আগুনটুকু বাঁচিয়ে এক শূন্যতা পারাপার করছেন।বারবার নিভে যাচ্ছে তার মোম।তবু জানি একদিন ঠিক সেই আলো পৌঁছে উজ্জ্বল করে তুলবে আমাদের সমস্ত অপেক্ষাটুকু।

মন্তব্যসমূহ

Amaniac বলেছেন…
খুব ভালো লাগলো দীপ
-অলোকপর্ণা

জনপ্রিয় লেখা