“সেইসব পাহাড়দের, যারা খুব শীতকালে আশ্রয় হয়ে উঠেছিল”- রাণা রায়চৌধুরী
বিশ্বাস নাও
করতে পারেন
কবি- সুমন সাধু
প্রচ্ছদ- সেঁজুতি বন্দ্যোপাধ্যায়
প্রচ্ছদ- সেঁজুতি বন্দ্যোপাধ্যায়
প্রকাশক- ধানসিড়ি
দাম- ৯৫ টাকা
দাম- ৯৫ টাকা
আমি নতুনদের
কবিতা পড়ি শেখার জন্য। কবি সুমন সাধু তাদের মধ্যে একজন। ‘বিশ্বাস নাও করতে পারেন’
এই কবির প্রথম বই কিনা জানিনা। জিগ্যেস করা হয়ে ওঠেনি। কিন্তু প্রথম দ্বিতীয় যাই
হোক বইটি পড়তে পড়তে আমি যথেষ্ট পুলকিত। পুলকিত শব্দটি এক্ষেত্রে ঠিক প্রয়োগ হল
কিনা জানি না, তবু এই কারণেই বলছি যে নূতনের স্বাদই আলাদা। প্রথম দেখা দীঘা, প্রথম
দেখা সাঁওতালডি, প্রথম দেখা চাইবাসা, প্রথম বুঝতে পারা দেবব্রত বিশ্বাস – এইরকম আর
কি! অনেক তরুণের কবিতাই পড়ি। ভালোও লাগে। তবু কোথাও পূর্বসূরির দাগ বা হুল্লোড়
সেখানে ছায়া ফেলে থাকে মনে হয়। কিন্তু এই আমাদের সুমন সাধুতে তা নেইই প্রায়। প্রায়
কেন, নেইই।
পুরো বইটি
কবি তিনটে ভাগে ভাগ করেছেন। প্রথমে ‘আমি পাখি এবং অন্যান্য’, দ্বিতীয় ‘তাকে যতই
তাড়াই দূরে’, তৃতীয় ‘বিশ্বাস নাও করতে পারেন’।
এরমধ্যে
‘আমি পাখি এবং অন্যান্য’ ভালো, কিন্তু আমার সবচেয়ে ভালো লেগেছে ‘তাকে যতই তাড়াই
দূরে’ তারপর ‘বিশ্বাস নাও করতে পারেন’-এর কবিতাগুচ্ছ। কবিতার সাজানো, পরম্পরায়, এক
বিরাট মুন্সিয়ানা দেখিয়েছেন কবি এই বইতে। ছোট ছোট লেখা কিন্তু তার ব্যাপ্তি অনেক
দূর।
সবচেয়ে বড়
কথা তারুণ্যে ভরা এই বই। বইটি পড়তে পড়তে আমি বুঝতে পারছিলাম, আমার বয়স বেড়েছে। এই
যে, এই বইয়ে যা যা অনুভবের কথা লেখা আছে তা এখন এই সময়ে আর আমি লিখতে পারব না।
হ্যাঁ, বইটি আমি একজন কবির চোখ দিয়ে, মন দিয়ে, হৃদয় দিয়ে পড়েছি... মিথ্যা বলব না,
একজন কবিতা লিখিয়ে হিসেবেই আমি এই বই পড়েছি। ভাবখানা এমন, দেখি তো ছোকরা কী এমন
লিখেছে যা আমি নিজে আজও ভাবতে পারিনি। এমন এমন অনুষঙ্গ, এমন পরিবেশ তৈরি হয়েছে এই
বইয়ের কবিতাগুলিতে, বা এমন সব পূর্বে না দেখা বা দেখলেও খেয়াল করিনি, বা এমনভাবে
বাক্যগঠন হয়েছে “আমি জানি, হাস্যকর এই কন্ট্রাস্টে বেঁচে থাকা যায় না” যা আমার
লিখনশিক্ষায় পূর্বে দেখা যায়নি বা আমি ভাবিনি যে, এইভাবে হতে পারে...।
“আলুসেদ্ধ,
পোস্তবাটা আর ভাত করে রেখেছে মা
আরামে খাই,
স্নান সারি।
তারপর
স্কুল, অফিস আর রান্নাঘর- এই আমাদের অসম্ভব থাকা।
কিছুবা
ছাপোষা কিছু মধ্যবিত্ত
রাতে সবার
দেখা হলে বাড়ি ভর্তি উঠোনে আমাদের পায়ের ছাপ পড়ে থাকে।
আমরা জানি,
আমাদের কোনো ছাতা নেই, একটা বিশাল আকাশ আছে।”
(কুড়িয়ে
রাখছি যত্নে/১) ‘তাকে যতই তাড়াই দূরে’-র একটি।
এইরকম
দৈনন্দিনের, কিন্তু তাতে প্রিয়জনের পায়ের ছাপ, ভালোবাসার ছাপ, আর বিশাল আকাশ আছে।
একটা জিনিষ লক্ষ্য করলাম যে, আমার কবিতাতেও আলুসেদ্ধ পোস্তবাটা হয়তো এসেছে, কিন্তু
এক্ষেত্রে তারুণ্যের নতুন দেখা কোথায়? যা আমার মতো পুরোনোর চেয়ে আলাদা? তা হল, ওই
‘...বাড়ি ভর্তি উঠোনে আমাদের পায়ের ছাপ’ এবং বলার ভঙ্গিতে নূতনের স্বাদ। খুব
আন্তরিক মায়াভরা সব অক্ষরে সমৃদ্ধ এই বই। স্মার্টনেস আছে বটে কিন্তু তা প্রবল
শহুরে নয়, মফস্বলের গাঁ-গঞ্জের শিক্ষিত মনখারাপ করা কোনো তরুণ যেন নিজের মনে কথা
বলছে।
“আমাদের ভোর
হয় আজানের ঘ্রাণে
বাকিটুকু
জুড়ে হাতঘড়ি, মিনিটের কাঁটা
ক্ষীণ
শব্দের ধূসর হেমন্তে
বিম্বিসার
আর গালিচার কথা মনে পড়ে”
(কবিতার নাম
‘জীবনানন্দ’)
কত কম কথায়
এক বিরাট সময়কে ধরা, ভাবা যায় না! আমাদের ভোর হয় আজানের ঘ্রাণে... আজান শুনেছি
আমরা, আজানে মনখারাপ হয়, আনন্দের বার্তাও হতে পারে, বা শুরু হচ্ছে কিছু... কিন্তু
তা বলে, আজানের ঘ্রাণ? এই ঘ্রাণ যেন শিশিরের ঘ্রাণের মতো, বোধহয়। আমি পড়তে পড়তে
পিছনপানে চলে যাই, ভালোলাগে বেশ, বাকিটুকু জুড়ে হাতঘড়ি, মিনিটের কাঁটা – এইসবে
আমার ফসল কাটা পুরোনো ধানক্ষেতের কথা, শ্যাওলা পড়া পুকুরের জলের কথা যা বিম্বিসার
অশোকের সময়ের মায়াভরা পথের কথা বলে মনে হয়। ধীর বাতাসের মতো, আমার জীবনানন্দের সময়
ছাড়াও বিভূতিভূষণের সময়ের কথাও মনে আসে।
“ছাদ আসলে
জেনেছিলাম ইমরানদের বাড়ি গিয়ে...” ইমরানদের বাড়ির ছাদ আসলে কেমন তা জানতে গিয়ে
আমাদের এই তরুণ কবি কী দেখলেন? না, ইমরানদের বাড়িতে প্রতিমা গড়ার মধ্যেই আধখানা
চাঁদ ঢুকে পড়ে। সেটা ইদের চাঁদও হতে পারে, ইদের চাঁদের আলোতেই প্রতিমা হয়তো আরো
সুন্দর-লাবণ্যময়ী হয়ে ওঠে। “আবহাওয়া বলতে ইমরান বোঝে শুধু ইদ, আমি তার অংশ হয়ে
সিমুই খাই। ইমরান বলতে শুধু বুঝি আস্ত একটা ছাদ; যে ছাদে আশ্বিন মাসে ভোগ রান্না
হয়।” ইমরান, চাঁদ, ছাদ, সিমুই, আশ্বিন, ভোগের সুগন্ধি রান্না -- এই সবে মিলে এক
আনন্দময় ফুর্তির বেঁচে থাকা, প্রতিমা যেমন গড়ে ওঠে তেমন যেন আমাদের ভালোবাসাবাসির
জীবনও গড়ে উঠছে বিশাল এক, একটাই ছাদের নিচে। সেই ছাদের নাম হয়তো ভারতবর্ষ।
“বিশ্বাস
করুন, হিসেবের অঙ্ক বড়ো গোলমেলে। কী থেকে কীসব হয়ে যায়। তাই মনে মনে প্রস্তুত করি –
যাবতীয়দের হিসেব হয় না। এমতাবস্থায় একটি বৃদ্ধ আমায় ‘এঁচোড়ে’ বললেন। চমৎকার তরুণী
বলল, ‘ভাই বিলা দিস না’। যাদবপুরের পুরুষ বন্ধুটি ‘শালা’ সম্বোধন বলে ফেলল ‘কাজ
নেই?’ হুজুর আমি যে অঙ্কে কাঁচা। সে যাই হোক, হুজুগের এই একটি দুনিয়ায় আপনি আমায়
বিশ্বাস নাও করতে পারেন।”- এটি কবিতা-বইয়ের শেষ গুচ্ছ, ‘বিশ্বাস নাও করতে
পারেন’-এর প্রবেশক কবিতা। প্রতিটা গুচ্ছের আগেই এইরকম আরো দুটো “এসো সুসংবাদ এসো”র
মতো প্রবেশক আছে, যে প্রবেশক আহ্বান জানায় রাতের উপগ্রহ দেখার জন্য যে উপগ্রহে
মানুষের প্রেম দুঃখ মায়া সার্কাস আলোর মতো ঘুরছে, ছড়াচ্ছে চারধারে এবং আমরা সেই
সার্কাসের আলোয় এই কবির সঙ্গে বেঁচে উঠছি প্রবলভাবে... “এ মহাজীবন, স্বীকার করো
অকস্মাৎ/ সার্কাসগুচ্ছ শূন্যে আমি এক হস্তিবিশেষ, যেখানে “স্বাধীনতা মানে একটা দড়ি
কিংবা সামান্য ব্যালেন্স।” শ্যাওলার সবুজ মাখানো শ্লেষ বিদ্রূপ আবার ঠাট্টাও
সামান্য “সব ভুলে ঠাকুরে মন দাও।”-এর মতো।
“তবুও বিকেল
শেষে আমাদের চাঁদ বড়ো দীর্ঘায়ু,
ঘন ঘন হেঁটে
যাওয়ায় জুড়ে থাকে এইসব অস্থিরতা।
গ্রহণ শেষে
একটা চাঁদের গায়ে এক-একটা ক্ষয়,
এক-একটা
ক্ষয়ের পাশে আর একটা চাঁদ
অতলে
দাঁড়িয়ে শুধু উপগ্রহ গুনি”
(কবিতার নাম
– সেই রাতের উপগ্রহ)
চাঁদ আমার
কবিতাতেও আসে বারেবারে। কবি সুমন সাধুর কবিতাতেও এসেছে এই বইতে অনেকবার। আসতেই
পারে। চাঁদ ছাড়া আছে কি আমাদের এই ক্ষয়িত জীবনে? চাঁদই তো আমাদের নদী, আমাদের
পিতা, আমাদের মা এবং বান্ধবী!
চাঁদ বড়ো
দীর্ঘায়ু... তাও আবার বিকেল শেষে... তারপরেই ঘন ঘন হেঁটে যাওয়ায় জুড়ে থাকে
অস্থিরতা... তারপরে এই লেখায় ক্ষয়ের কথা আছে, আছে অতলে দাঁড়িয়ে উপগ্রহ গোনার কথাও।
এক্ষেত্রে আমার মনে হচ্ছে, সুমনের এই চাঁদ দুঃখের- যন্ত্রণার- অবসাদের- বিষণ্ণতার
এবং অস্থিরতারও, আমি ভুলও হতে পারি। আবার ভুল নাও হতে পারি, এই জন্যেই যে, বিকেল
শেষ হলে পাঠক দেখবেন এক ধরণের মনখারাপ আমাদের গ্রাস করে, আমার তো করে। তারপরে আবার
বিকেল শেষের দীর্ঘ চাঁদ এবং সে গ্রহণ শেষে ক্ষয়াটে-বিবর্ণ ধরণের। সুমনের এই চাঁদ
ঠিক ‘পূর্ণিমার চাঁদ যেন ঝলসানো রুটি’ এইরকমটা নয় হয়তো, কারণ সময় গড়িয়েছে অনেক,
দুই হাজার আঠেরোর চাঁদ ঝলসানো নয়, নিভু নিভু, হ্যাংগ করে যাওয়া স্মার্ট ফোনের মতো
অনেকটা, বা কর্কট রোগে আক্রান্ত প্রিয়জনের ব্যথার মতো হয়তো বা।
এইরকম
স্মার্ট কিন্তু বিষণ্ণ, আধুনিক কিন্তু “টুকুর হাত ধরে অভাব ঢুকেছে এ সংসারের” মতো,
আবার “আমার এলোপাথাড়ি সিঁথি/ শুকিয়ে যাচ্ছে চা-বারান্দায়” –এর মতোও কবিতা, নতুন
দিনের কবিতা সাজানো আছে কবি সুমন সাধুর এই বইতে।
আমি পাঠক,
আমার পাঠ প্রতিক্রিয়া দিলাম মাত্র। আমি বিশেষজ্ঞ নই, সামান্য একজন কবিতা পাঠক
হিসেবে যা মনে হল তাইই জানালাম বা নিবেদন করলাম মাত্র। এ বই হাতে নিয়ে পড়লে আপনি
হয়তো অন্যরকম আলোর বা অন্ধকারের বা “দূর থেকে ভেসে আসা স্তোত্রের” সন্ধানও পেতে
পারেন এই বইতে।
শুভেচ্ছা
রইল এই তরুণ কবির জন্য। প্রচ্ছদ – সেঁজুতি বন্দ্যোপাধ্যায়। প্রকাশক - ধানসিড়ি।
- রাণা রায়চৌধুরী
আঙ্গিক, বইমেলা সংখ্যা, ২০১৯
মন্তব্যসমূহ