ভালোবেসে আমার নিহন্তাকে | স্নেহা সেন-এর গদ্য | আঙ্গিক




স্বপ্নের মধ্যে দেখি অন্ধকারে এক অবয়ব পিঠ ঘুরিয়ে দাঁড়িয়ে থাকে। সে নারী কিম্বা পুরুষ বুঝি না। প্রতি রাতে তার সামনে লুটিয়ে মাটিতে পরে থাকে একজন নারী কিম্বা পুরুষ। অবয়ব তার চুলের মুঠি ধরে তুলে দাঁড় করায়। হাতের ঝকঝকে ক্ষুর দিয়ে সামনের মানুষের গলা চিরে দেয়।

তারপর অবয়ব কাঁদে।

ঘোলাটে জড়ানো‌ গলায় বলে, “হন্তারক হতে চাইনি কখনো। তবুও...”
এরপরেই পৈশাচিক হেসে উঠে বলে, “তবুও হলাম। আনন্দ পেলাম।”
আর সামনের রক্তাক্ত শরীরের প্রতিটা অঙ্গকে ফালাফালা করে কাটতে কাটতে ঘাঁটে। কী যেন খোঁজে। কলজেটাকে উপড়ে নিয়ে উঠে হেঁটে সামনে অন্ধকারে মিলিয়ে যায়।

প্রতিবার এই স্বপ্ন দেখার পরে আমি আর্তনাদ করে উঠে বসে দেখি জবজবে ঘামে ভিজে আছি। আশ্রয়ের খোঁজে হাত বাড়াই পাশে।

কেউ নেই।

ঐশ্বরীক একাকীত্বের মধ্যে অভিশাপগ্রস্থ অহল্যা।

বিছানা থেকে নেমে জলে গলা ভেজাই। বাথরুমে গিয়ে শাওয়ার চালিয়ে দাঁড়াই। ভিজে যায় রাত পোশাক। তবুও অবয়ব ঝাপসা হয় না। বাথরুমের মেঝের জমে থাকা জলে নিজের মুখ দেখার চেষ্টা করি। দেখতে পাই না। শুধু দেখি অন্ধকার নোংরা শ্যাওলা ধরা গর্তদের মধ্যে ঘোলাটে কিছু জল। যখন উৎসমুখ থেকে ছিটকেছিল এই জল, স্বচ্ছ ছিল। অনেকটা পথ পেরিয়ে আজ সে ঘোলাটে। অথবা আশ্রয়স্থলটাই কদর্য।

প্রতিবার ইচ্ছে হয় আরেকবার ঘুমিয়ে পড়ি। একবার সাহস করে গিয়ে অবয়বের মুখটা টেনে এনে দেখি। হত্যাই বা করা হচ্ছে কেনো অকারণ। কীসের রক্ত। কেনো এত ঘৃণা। কিন্তু নিজেকে সামলাই। বলি, “সবকিছু দেখতে নেই। না দেখাটাই আসল। আমরা আসলে যা দেখি তার থেকেও বেশি দেখি না। দেখাটুকুও অনেকটা মিথ্যে হয়। না দেখাটাই আশ্চর্য রকম সত্যি। কিন্তু সেই সত্যি অব্দি আমরা যখন পৌঁছাই, ততক্ষণে আমরা ক্লান্ত, রিক্ত, শূন্য।”

শুধুমাত্র এই একটা কারণেই ইচ্ছে থাকলেও আর ঘুমোই না আমি। অবয়বকে অথবা নিজেকেই মুক্তি দিই। এর থেকে ভালো এক কাপ চা খাওয়া। খুব কড়া কর্কশ চা। ঠোঁট থেকে জিভ তেতো করে নামতে নামতে বুঝিয়ে দেবে কোনদিকে সে যেতে চায়। সেই চা বানিয়ে এনে বিছানায় বসি। চা খেতে খেতে নিজেকে কেমন দেখতে লাগে এই ইচ্ছা হয় প্রতিদিন। কিন্তু দেখার অবকাশ নেই।

আমার ঘরে কোনো আয়না রাখিনি।

কোনোভাবেই আমার একাকীত্বের যেন বিনাশ না হয়। এ বড়ো যত্নে অর্জিত। বহু কিছু ছাড়তে ছাড়তে পাওয়া। এখন ঠিক মনে পড়ে না, রাখতে চেয়েছিলাম কী কিছু কোনোদিন? নাকি আদপে শুরু থেকে ছাড়তেই চেয়েছিলাম। নাকি ছাড়ানো হয়েছে?

মাথার ধোঁয়াশার মাঝে হাঁটতে থাকি।
কী হাঁটতে হাঁটতে অন্ধকারের দিকে এগোই।
দেখি সামনেই সেই দৃশ্য। সেই অবয়ব পিঠ ঘুরিয়ে দাঁড়িয়ে।
ফিরে যাবো?
ফিরে যাবো কি আজও?
কিন্তু ওর সামনে যে আজ হত্যা করার মত কিছু নেই।
হঠাৎ খুব মায়া হয় ওই অবয়বের জন্য।
হত্যা না করলে ও আজ কী করবে?
অসহায়ের মত দাঁড়িয়ে থাকবে এক যুগ?
প্রতীক্ষা করা কী সম্ভব এতটা?
অবয়ব যদি প্রস্তুরীভূত হয়ে যায়?

ধীর পায়ে এগোই।
গিয়ে লুটিয়ে পড়ি অবয়বের সামনে মাটিতে।
যেভাবে প্রতি রাতে শুয়ে থাকে অন্যেরা।
চুলের মুঠি ধরে সে তোলে আমাকে।
অবয়বের মুখ আসলে পুরনো ভিক্টোরিয়ান স্টাইলের আয়না।
কত যুগ পরে নিজেকে দেখি...

মন্তব্যসমূহ

Unknown বলেছেন…
Osadharon laglo
Unknown বলেছেন…
কি অদ্ভুত সুন্দর! ♥️♥️♥️
নামহীন বলেছেন…
Khub sundor laglo ����

জনপ্রিয় লেখা