অনিন্দ্য সেনগুপ্ত

চেনা তকমা, অচেনার ভয় -  শিল্পে নিষিদ্ধকরণ নিয়ে কিছু ভাবনা




   আমরা সেই গল্পটা পড়েছিলাম যেখানে দৈত্যর বাগানে প্রবেশ করা নিষিদ্ধ ছিল। গল্পটা ইংরেজি ভাষায় পড়লে সেই সাইনবোর্ডটার কথা আমরা জানতে পারব যেটা বলছে যে 'ট্রেসপাসারস উইল বি প্রসিকিউটেড'। এই বিজ্ঞপ্তিটা বাংলায় অনুবাদ করলে লিখতে হবে 'প্রবেশ নিষিদ্ধ; প্রবেশ করলে শাস্তি পেতে হবে'।  

   অতএব দু'টি ইংরেজি শব্দ অনুবাদ করার সময় আমাদের 'নিষেধ' বা 'নিষিদ্ধ' শব্দগুলি ব্যবহার করতে হয়- 'প্রহিবিটেড' এবং 'ব্যানড'। এই শব্দগুলো নিয়ে একটু ভাবা যাক।  ভাবা যাক মূলত সংস্কৃতির প্রাঙ্গণে কথাগুলো কীভাবে ব্যবহৃত হতে পারে, তার দ্যোতনাগুলি কীরকম।
ভাবার আগে নিজের অবস্থানটি পরিষ্কার করে নেওয়া যাক। আইনি পরিভাষা, আইন, রাষ্ট্রবিজ্ঞান যদি আমার বিষয় হত তাহলে আমি একদমই ভিন্নভাবে কথা বলতাম। হয়ত আমার বলা কথাগুলির তাৎপর্য ভিন্ন হত্ন আমি ফিল্ম স্টাডিজের গবেষক ও অধ্যাপক, সিনেমার ছাত্র। আমি সেই জায়গা থেকেই কথা বলব, সংস্কৃতি আমার অধ্যয়নের বিষয়- সেই নিরিখে।

   'প্রহিবিশন' মূলত সম্ভাবনাকে আটকায়। দৈত্যর বাগান মনোরম, সুন্দর, আকর্ষণীয়। সেখানে শিশুদের প্রবেশ করার সম্ভাবনা থাকে কারণ তাদের নির্মল আনন্দের প্রতি আকর্ষণটা প্রাপ্তবয়স্কদের চাইতে খানিকটা বেশি। দৈত্য একটি লিখিত নিদান হাঁকছেন কারণ তার মালিকানাধীন পরিসরটি শিশুদের টেনে আনবেই। সেই সম্ভাবনাটি আটকাতে চান তিনি। এক্ষেত্রে তিনি একটি পরিসরের সীমানা বাঁধছেন। 
'প্রহিবিশন' আবার সময়ের উপর একখানি নিদানও বটে। সম্ভাবনা- যা হতে পারে, সময়ে যা ঘটবে তার উপর নিষেধাজ্ঞা জারি হল। এবং ভবিষ্যতের এই সম্ভাবনা দাঁড়িয়ে আছে ক্রিয়াটি- বাগানে অনুমতিহীন প্রবেশ- যে করতে পারে সেইসব চরিত্রদের কথা মাথায় রেখে। এক্ষেত্রে তারা শিশু, বালক ও বালিকা। তাদের চরিত্র- আনন্দের প্রতি আকর্ষণ, কৌতূহল এবং মোটামুটি নিয়মের ব্যাপারে উদাসীনতা- তাদেরকে সম্ভাব্য অনুপ্রবেশকারী হিসেবে চিহ্নিত করে।

   অতএব মানসিকভাবে নড়বড়ে, জরাগ্রস্ত একজন মানুষও বেখেয়ালে প্রবেশ করতে পারে দৈত্যর বাগানে। তাকেও দৈত্য প্রসিকিউট করবেন নিশ্চয়ই, কিন্তু মূলত তার নিষেধাজ্ঞা শুধুমাত্র একটা ক্রিয়ার সম্ভাবনাই নয়, সেই ক্রিয়ার সম্ভাব্য একটি কর্তাকে উদ্দেশ্য করেই।
নিষেধ করতে গেলে একটি অস্তিত্ব, একটি শরীরকে চিহ্নিত করে রাখতে হয় আগে থেকে। সেই শরীর ও সত্তা চেনা নয়। তাহলে নাম দিয়ে রাখা যেত যে  অমুক নামধারী ব্যক্তির প্রবেশ নিষিদ্ধ, সেই অচেনা ট্রেসপাসারকে ন্যূনতম পরিচয়ে চিহ্নিত করে রাখতে হয়। এক্ষেত্রে সাইনবোর্ড যাই বলুক না কেন, উদ্দেশ্য কৌতূহলী শিশুদের প্রবেশকে আটকানো।

   'ব্যানিং'- জাতীয় নিষিদ্ধকরণ উলটো কাজটা করে। ভবিষ্যতের সম্ভাবনা মূল টার্গেট থাকে না; লক্ষ্য হয়ে ওঠে যা সমাপ্ত হয়ে গেছে, যা হবেই তা। যেমন ধরা যাক হাংরি জেনারেশনের কবিতাকে নিষিদ্ধ ঘোষণা করা হল। তাহলে নিষিদ্ধ হলটা কি? নিষিদ্ধ হল কতগুলো ছাপা কবিতা এবং সেগুলিকে পড়া। অর্থাৎ ব্যান করতে গেলে বস্তু লাগে- যে বস্তুর অস্তিত্ব আছে, যেটা পড়ে ফেলতে পারে কবিতার সম্ভাব্য পাঠক। একটা চলচ্ছবিকে ব্যান করতে গেলে সেই ছবিটিকে সমাপ্ত হতে হয়, সেটিকে সার্টিফিকেটের জন্য পাঠাতে হয় সেন্সরের কাছে, অভিপ্রায় ছবিটির বাণিজ্যিক মুক্তি।

   ভাষা বেশ মজার জিনিস- সিনেমার ক্ষেত্রে শব্দটা হল 'রিলিজ' বা 'মুক্তি'। মুক্তি পেল্ব বা পাওয়ার সম্ভাবনা হলে, মুক্ত হতে চাইলে ব্যান করা  হয়ন সাহিত্যের ক্ষেত্রে ভাষাটা হবে 'প্রকাশ'। মুক্ত ও প্রকাশিতকে নিষিদ্ধ ঘোষিত করা যায়।

   কেউ বলতেই পারেন যে আমি যে দু'টি শব্দ নিয়ে এতটা বলছি তা আখেরে একই দাঁড়ায়। প্রহিবিশন যেমন সম্ভাবনাকে আটকায়, তেমনই ব্যানিংয়ের ক্ষেত্রেও আটকানো হচ্ছে সম্ভাবনাকেই। নিষিদ্ধ কবিতা পড়ার সম্ভাবনা, নিষিদ্ধ ছবি দেখে ফেলার সম্ভাবনা। কিন্তু আমি দু'টি ভিন্ন দ্যোতনায় উৎসাহী- একটা হল নির্দিষ্ট ব্যক্তি দ্বারা সম্ভাব্য কর্ম রুখে দেওয়া, আরেকটি হল নির্দিষ্ট বস্তু যে নির্দিষ্ট কাজটির জন্য উদ্দিষ্ট সেটি রুখে দেওয়া। নিষিদ্ধ কবিতার বইটি নিয়ে ঠোঙা বানানো যেতে পারে, যারা বইটি ব্যান করার পক্ষে তারা বইটি পুড়িয়েও দিয়ে থাকেন, সেক্ষেত্রে পোড়ানোটা ব্যানড নয়, ভবিষ্যতে ছাপা, পড়া ও বিক্রি করা ব্যানড। বই যখন ব্যান করা হয় তখন বলা হয় না যে সম্ভাব্য পাঠকদের ব্যান করা হল- বলা হয় বইটি সমাজের পক্ষে হানিকর, তাই বইটি- শুধুমাত্র বইটিকেই নিষিদ্ধ ঘোষিত করা হল। 

   ব্যানিং অতএব একটি নতুন বস্তুর জন্ম দেয়- নিষিদ্ধ সাহিত্যকর্ম, নিষিদ্ধ ছবি, নিষিদ্ধ নাটক। অর্থাৎ, নিষিদ্ধ হওয়ার আগে কবিতাটি, ছবিটি, নাটকটি আর পাঁচটা কবিতা, ছবি ও নাটকের মতোই ছিল- এখন ওটি নতুন একটি বস্তুতে পরিণত হল।

   সেক্ষেত্রে ব্যানিং যেটা করে সেটা হল একটি বই বা কবিতা বা নাটকের সম্ভাবনাকে নির্দিষ্ট করে দেওয়া। একটা নিষিদ্ধ ছবির কথাই ধরা যাক না হয়। এমার্জেন্সির সময় 'কিসসা কুর্সি কা' নামে একটি ছবি ব্যান করা হয়েছিল। আমি জানি না কোনো ক্যাননে বন্দি হয়ে ছবিটি পড়ে আছে নাকি। ছবি যখন সেলুলয়েডে হত তখন তাকে ব্যান করা সহজ হত। সার্টিফিকেট না পেলে ছবিটি ছবিই হয়ে উঠতে পারেনা। এই ক্ষেত্রে একটি ছবি বা একটি নাটক একটি উপন্যাস বা কবিতার বইয়ের মতো নয়। হলে প্রজেকশন না হলে একটি ছবি অর্থহীন সেলুলয়েডের স্ট্রিপে ধৃত লক্ষাধিক ফ্রেম হয়ে থাকে মাত্র, সেগুলি দেখলে কিছুই বোঝা যায় না, কারণ ছবি দেখতে পেলেও শব্দ শোনা যায় না। সেভাবেই একটি নাটক মঞ্চস্থ না হলে এক তৃতীয়াংশ কিছু একটা হয়ে থাকে সংলাপ হিসেবে। 

   অর্থাৎ একটি ছবিকে বা নাটককে ব্যান করার সময়ে সেটিকে প্রোজেক্ট করার বা মঞ্চস্থ করার 'ইভেন্ট'টিকে নাকচ করে রাখা হয় আগে থেকে।
এবারে কূট তর্কে যাওয়া যাক। তাহলে 'প্রহিবিশন' ও 'ব্যানিং' তো আখেরে একই হল- দু'টিই সম্ভাব্য ইভেন্টকে রদ করেছে। শিশুরা দৈত্যর বাগানে প্রবেশ করতে পারে, মহারাষ্ট্রে বিফ খেতে পারে কিছু লোক, কিছু দেশের মানুষ 'স্যাটানিক ভার্সেস' পড়ে ফেলতে পারে, একটি ছবি দেখে ফেলতে পারে, একটি নাটক মঞ্চস্থ করে ফেলতে পারে।

   কিন্তু আমেরিকায় ১৯২০ থেকে '৩৩ অবধি যখন অ্যালকোহলিক দ্রব্য প্রহিবিটেড ছিল তখন সুনির্দিষ্ট কিছু জিনিসের উপর নিষেধাজ্ঞা ছিল। অবশ্যই সেই নিষেধাজ্ঞা 'নিষিদ্ধ লিকার' বলে এমন একটি বস্তু নামাঙ্কিত করেছিল যেগুলো বেচাকেনার ব্যবসায় একটি দানবাকার কালো টাকার অর্থনীতি ফুলে ফেঁপে উঠেছিল। কিন্তু একটি কবিতা বা ছবি বা উপন্যাস বা নাটক সেই একইরকম বস্তু নয়।

    যখন একটি শিল্পকর্ম ব্যান করা হয় তখন যে ক্ষতিটি সাধিত হয় সেটি হল এই নিষিদ্ধ শিল্পকর্মটির সম্ভাবনাকে একদম সুনির্দিষ্ট করে দেওয়া। শিল্প আখেরে মুক্তি চায়- অভিব্যক্তির মুক্তি শিল্পীর নিরিখে আর পাঠোদ্ধার এবং অর্থনির্মাণের মুক্তি পাঠক-দর্শক-শ্রোতার নিরিখে। ব্যানিং একটি শিল্পকর্মকে খুব অগভীর এবং এক মাত্রিক একটি অর্থের ঘেরাটোপে সীমাবদ্ধ করে দেয়।



   আমি জানি না কিউ তার 'গাণ্ডু' ছবিটিকে সেন্সর বোর্ডের কাছে পাঠিয়েছিলেন কিনা। পাঠালেও সেন্সর বোর্ডের কাছে ছবিটি কি সার্টিফিকেট পাবে তা অনুমেয়। এই সাদা-কালো ছবিটিতে একটি রঙিন পর্নোগ্রাফিক পর্ব আছে, সেটিকে তারা সম্পূর্ণ বাদ দিয়ে দিতে বলবেন। কিন্তু মুশকিল হবে সাউন্ডট্র্যাক নিয়ে, কারণন স্বাভাবিক ভাবেই ছবির মূল চরিত্রগুলি বাস্তবোচিত যে ভাষায় কথা বলে সেটি সেন্সর করতে গেলে ছবিটিতে শোনার জন্য আর কিছু থাকে না। তাই তারা বলবেন যে ছবিটি বাণিজ্যিক মুক্তির পক্ষে উপযুক্ত নয়। সেটা একজ্যাক্টলি ব্যান করা না হলেও আখেরে তাই। ছবিটি নিষিদ্ধ ঘোষিত হবে। আমি আগেই বলেছিলাম যে সেলুলয়েডের পর্বে একটি ছবিকে ব্যান করা সহজতর ছিল। কিন্তু ডিজিটাল পর্বে ছবিটি টরেন্টের মাধ্যমে ছড়িয়ে পড়বে, উত্তরোত্তর পিয়ার-টু-পিয়ারশেয়ারিং-এর মারফত ছবিটির ডিজিটাল কপি বৃদ্ধি পেতে থাকবে যা প্রায় নিয়ন্ত্রণের অপার। কিন্তু সেই দৈত্যর বাগানে সম্ভাব্য উৎসাহী শিশুর মতোই দর্শকের উৎসাহ হয়ে পড়বে সীমিত-প্রাকৃত ভাষায় সংলাপ তো সবার জানাই আছে, কিন্তু বাংলা ছবিতে বাঙালি পেশাদার অভিনেতারা যখন আনসিম্যুলেটেড যৌনতায় লিপ্ত হয় তখন তারা কী করে কীভাবে সেটা আরেকবার ঝালিয়ে নেওয়া যায় দেখে।

   অথচ ছবিটি এর বাইরেও অনেককিছু করছিল হয়ত। এমনকি ওই দৃশ্যটাতেই যা করছিল তার অন্য কিছু মাত্রা ছিল হয়ত। কিন্তু ব্যানিং এটাই করে- অর্থকে চেনা জানা, অতএব নিরাপদ একটি ঘেরাটোপে বন্দি করে দেয়। অশ্লীল শব্দটির সীমানা বড্ড নির্দিষ্ট।

   অতএব নিষিদ্ধকরণ এই 'ঘেরাটোপ'টাকেই তৈরি করতে চায়- একটি নির্দিষ্ট, একমাত্রিক, একরৈখিক অর্থের ঘেরাটোপ। পরিসরের উপমায় ভাবাই যায়, যেমন 'নিষিদ্ধ পল্লী'। এধরনের নিষিদ্ধকরণ সেই পরিসরের অস্তিত্ব লোপ করছে না মোটেও। সেখানকার বাসিন্দাদের এবং সেখানে যাতায়াত যাদের তাদের অর্থকে সীমাবদ্ধ করে দিচ্ছেন মাত্র।

   একটা ভাবনায় শেষ করছি। আমাদের ভাষায় একটা যুগ্মপদ চলে বেশ- শিল্প সংস্কৃতি। ভেবে দেখা দরকার যে এই পদটি কি করছে। শিল্প চায় ভাবনার, কৃতির, অভিব্যক্তির সীমালঙ্ঘন। কিন্তু সংস্কৃতি চায় সর্বসম্মত একটি স্থিতাবস্থা। যেমন ধরা যাক কর্মসংস্কৃতি শব্দটি। এই শব্দটি বলছে যে একাধিক মানুষ, একটি সমাজ প্রায় কাজ কীভাবে করা হবে তা জানেন, সেটা বেঁধে দিয়েছেন ভাবনায়। যাতে বলা হয় যে অমুক জিনিসটি 'আমাদের কর্মসংস্কৃতিতে নেই' বা তমুক ব্যবহারটি 'আমাদের কর্মসংস্কৃতির বিরোধী'। এখানে এই 'আমাদের' শব্দটি যেটি একটি নামহীন বহুত্বকে চিহ্নিত করে এবং অতিনির্দিষ্ট একটি 'সংস্কৃতি' শব্দটি জরুরি। এই সার্বিক কন্সেনসাস ছাড়া সংস্কৃতি হয় না, সেখানে সীমানা নির্দিষ্ট হয়। যে কোন মৌলবাদী, দক্ষিণপন্থী, রক্ষণশীল রাজনীতিই এটি করে থাকে। যারা ব্যান করে, যারা প্রহিবিট করে। শিল্পের কাজ রিস্ক নেওয়া, ভাবনাকে অচেনা, অস্বস্তিকর জায়গায় নিয়ে যাওয়া। শিল্পকে কি সংস্কৃতির সাথে আদপেই বিরোধাভাসে অবস্থিত নয়? শিল্প যেখানে সীমানা পার করতে চাইছে, সংস্কৃতিই তো সেইখানে বেড়া দিতে চাইবে। তৈরি করে দিতে চাইবে ঘেরাটোপ, সন্দেহ করবে অনির্দিষ্ট অর্থ, বহু অচেনা অর্থের সম্ভাবনাকে।

   যা অচেনা তাকে কি নিষিদ্ধ করা যায়? বা যাতে অচেনার সম্ভাবনা প্রবল তাকে নিষিদ্ধ করলেই হয়ত তাকে চেনা জানায় বেঁধে ফেলা যায়। 



এটি আঙ্গিকের মুদ্রিত সংস্করণ 'নিষিদ্ধ' (নভেম্বর ২০১৫) সংখ্যায় প্রকাশিত হয়েছিল। লেখাটির বিষয় এবং বর্তমান প্রাসঙ্গিকতা মাথায় রেখেই আমাদের ব্লগে পুনর্বার প্রকাশ করা হল।

মন্তব্যসমূহ

জনপ্রিয় লেখা