মেয়েবেলার প্রেম | শুভশ্রী পাল | আঙ্গিক
মফসসলের গার্লস স্কুলের একটা নিজস্ব চরিত্র থাকে, যেটা ছবির মতো স্পষ্ট অথচ লিখে বোঝানো যায় না। আমার স্কুলের প্রথম দিন থেকে যেসব বন্ধু হয়েছিল তারা আজও অমলিন। আমাদের গ্রুপটায় এক অদ্ভুত ব্যাপার ছিল, কেউই কারো মতো নই। সবার চরিত্র আলাদা। এর মধ্যে সবথেকে পাকা মেয়েটির নাম ছিল সোমা, যাকে দিদিমণিরাও সোমাপাকা বলে ডাকতেন। এই সোমাই আমাদের প্রথম শেখায় বাবা-দাদা-কাকা জাতীয় সম্পর্কের বাইরের কোনও ছেলে কোনও মেয়েকে আই লাভ ইউ বললে নাকি সেটাকে প্রেম বলে। প্রতিদিন এরকম একটা করে সূত্র শেখাত, পরের দিন সেই পড়া পারলে পাকা হওয়ার দিকে আরো একধাপ এগোতে পারতাম। সোমাকে গুরুমাতা হিসাবে না পেলে হয়তো এ জীবনের অনেক গলি-বাঁকই আর দেখে ওঠা হতো না। এ হেন সোমাপাকা ছিল উচ্চমার্গের কল্পনাপ্রবণ। অনেক পরে বুঝেছি সোমা তার যেসব প্রেমিকদের কথা বলে আমাদের চোখে সম্ভ্রম আদায় করে নিত, তার বেশিরভাগই গল্প।
এবার আসা যাক আমার প্রেমের গল্পে। ছোটো থেকে ক্যারাটে শেখা, টমবয় 'আমি'টার প্রচুর ছেলেবন্ধু থাকলেও কোনও প্রেমিক ছিল না। এদিকে ক্লাসের প্রায় সব বন্ধুর জীবনেই এক পিস করে প্রেম চলে এসেছে। খেলার মাঠে কনফিডেন্স লেভেল নিয়ে আমার কোনও সংশয় না থাকলেও এই বিষয়ে বেশ চাপ খাচ্ছি। এমন সময় সোমা এল একটি সম্বন্ধ নিয়ে। ওর মাসতুতো দাদা। নামঃ সঙ্কেত। ভালো ফুটবল খেলে, পড়াশোনায়ও বেশ ভালো। আমি অবশ্য পড়ার খোঁজ নিতে আগ্রহী ছিলাম না। ফুটবল শুনেই আমি মনে মনে পাত্র পছন্দ করে ফেলেছিলাম। আমাদের সময়ে দেখা সাক্ষাতের থেকেও বেশি থ্রিল ছিল প্রেমপত্রে। প্রেম ব্যাপারটা হওয়ার জন্য চিঠি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করত। সঙ্কেতের চিঠি এল এরপর। তখনও আমাদের দেখা হয়নি। মনে মনে এঁকে নিয়েছি সুঠাম চেহারার নীল জার্সি পরা এক প্রেমিকের ছায়া। যার মুখ ব্লার হলেও সে আমার। চিঠি পাওয়ার পর হাত-পা-বুক কাঁপতে লেগেছিল তিরতির করে। হার্টবিট মিস করতে করতে বার তিনেক চিঠিটা পড়ে ফেলেছিলাম গোগ্রাসে। আমাদের বাড়ি অনেক দূরে হওয়ায় দেখা তখনও হয়ে ওঠেনি। আর টিউশন কামাই করে দেখা করার মতো লায়েক হইনি সেসময়। অগত্যা চিঠি এবং সোমা নামের পিওনই ভরসা। বেশ জমিয়ে কয়েক সপ্তাহ পার হয়ে গেল আমাদের প্রেম। ল্যান্ড লাইনের নম্বর পেলেও সঙ্কোচ কাটিয়ে ফোন করে উঠতে পারিনি। এসব ব্যাপারে আবার আমি খুবই লাজুক। প্রেম চলছে...
একদিন টিফিনে কিছু একটা কেন্দ্র করে সোমার সঙ্গে আমার ঝগড়া হল৷ আমি আপ্রাণ চেষ্টা করছিলাম মাসতুতো ননদের অর্থাৎ সোমার সঙ্গে ভাব করে নেওয়ার কিন্তু...
এরকম উত্তপ্ত বাক্য বিনিময়ের পরে ছুটির সময় সঙ্কেতের দেওয়া চিঠির উত্তর লিখে সোমাকে দিতে গেলাম মুখ ভার করে। সোমা তখনও ভালোই রেগে। চিঠিটা ওকে দিতে যাব, এরকম সময় সোমা গম্ভীরমুখে জানাল সে চিঠি ও নিতে পারবে না, কারণ, সোমার সঙ্কেত নামের কোনও দাদা নেই। আমি বজ্রাহত বললেও কম। কোনও রকমে খাবি খেতে খেতে প্রশ্ন করলাম, "তাহলে চিঠিগুলো?" সোমা মুখ গোঁজ করে অন্যদিকে তাকিয়ে জানাল, ওগুলো সব ওরই লেখা। সেদিন সারাটা রাস্তা আমার এই পৃথিবীটাকেই মিথ্যে মনে হচ্ছিল। যে পৃথিবীতে সঙ্কেত নেই, সেই পৃথিবীর থাকা-না থাকা আমার কাছে একই ব্যাপার।
দুদিন পরেই সোমার সঙ্গে ভাব হয়ে গেল৷ দুজন গাছ তলায় বসে টিফিন ভাগ করে খাচ্ছি। এমন সময় আমি ছলছল চোখে সোমাকে বললাম, "আমি না কিছুতেই সঙ্কেতকে ভুলতে পারছি না।" সোমা স্থানুবৎ। শুধু গল্প শুনে কল্পনা করে নেওয়া প্রেম-অনুভূতিও কত গভীরে যেতে পারে, তা সেদিন বুঝেছিলাম। আমার এমনই কপাল যে আমাকে এই গল্পে ডুবিয়েছিল, মনখারাপ থেকেও বেরিয়ে আসার জন্য তারই সাহায্য নেওয়া ছাড়া বিকল্প ছিল না।
অন্ধকারের উৎস-হতে উৎসারিত আলো | আঙ্গিক, জুলাই ২০২০
মন্তব্যসমূহ