অর্ণব সাহা-র কবিতাগুচ্ছ | আঙ্গিক অনলাইন


হেমন্তের ঘাতক বিকেল/ অর্ণব সাহা

একটা লোক এই মুহূর্ত থেকে ‘নেই’ হয়ে গেল। নিমেষে
বদলে যাওয়া বাড়ি, তার নিজস্ব এক ঘর, আলনায় গোছানো
পোশাক একইভাবে পড়ে থাকে। বিছানায় শোয়ানো মলিন
হ্যান্ডস্টিক, ঘরের কোণে পানের ডিবে সবাই নিশ্চুপ। একটা
অভ্যস্ত শরীরের গন্ধ ধীরে ধীরে ফিকে হচ্ছে। জানলায় ঝুলে 
থাকা না-কাচা পর্দা, ব্যবহারিক খুঁটিনাটি ইত্যাকার অবশেষ 
ঘেঁটেও তার হদিশ মেলে না। শুধু, দেয়ালে মূর্ছিত ছায়ার 
ভিতর সে ছিল, সে থাকবে...

সত্যিই থেকে যাবে? গোটা বাড়ি ফের আগের মতোই 
কর্মচঞ্চল, ত্রস্ত, কিছুটা ব্যথাতুর। কেবল শিশুর অলৌকিক
চোখে সে ধরা পড়ে। উবু হয়ে বসে থাকা সিঁড়ির ধাপে, ঝাড়ন
হাতে খাবার টেবিলের পাশে তার অতৃপ্ত ছায়া ফিরে আসে। 
এই সফল, চলিষ্ণু, উদাসীন পৃথিবীকে সে কি কিছু বলতে চায়? 

সে কি ওই শিশুর টানে ফিরে আসতে চায়?  


স্থূলপৃথিবীর বাইরে চোখ রেখে হাওয়ায় দোলানো
                            নারকেল বাগান
একটা পৃথিবী ছিল ‘সোভিয়েত দেশে’র পাতা ছিঁড়ে
ঝালবাদামের ঠোঙা হাতে হাতে ঘুরে যাবার মতো
একটা পৃথিবী ছিল অনশ্বর, স্থানু, চিরায়ত!

জানলা খুলে দেখতে পাওয়া মেঘেদের বর্ণবিপর্যয়
একটা স্বপ্নের মধ্যে অগোচর : মৃত্যু, ঘুম, ক্ষয়… 


৩ 
শিকড়ের খোঁজে চলেছি, বহুদূর, শহরের উপকণ্ঠে,
                               ঘুঘুডাঙা পেরিয়ে
ডানায় মাছের গন্ধ মেখে নামব আঁশটে ভেড়িতে
আবছা চাদর নেমে আসত সেই সব সন্ধেবেলায়
পাড়া-ক্রিকেটের গলি ভরে যেত ঝুপসি অন্ধকারে...

প্রত্যেক রাতের স্বপ্নে ছোটো ছোটো বোমা বিস্ফোরণ
প্রত্যেক ভোরের আলোয় ছিটকে যাওয়া শরীরের
                        নীলিমা! 


সমস্ত বিগ্রহই ৯০ ভাগ মিথ্যে দিয়ে তৈরি
সমস্ত সাফল্যের ৮০ অংশ জল
স্মৃতিভেজানো বাড়ির ভিতর অনধিকার প্রবেশ
                   আততায়ীর
সে জানে ভাঙা কার্নিশ আর ফাটা শার্সিতে
           ঠিকরে যাওয়া রোদে
স্তব্ধ হয়ে যাবে তার অপরাধপ্রবণ মন 
তাকেও করে তুলবে স্মৃতিকাতর
অন্ধকারে কুঁচকে যাওয়া তার আত্মায়
             নিকোটিনের ক্ষত
সেখানেই ফসল ফলিয়েছে শ্বাপদ
মুখ তুলেছে বাঁকা ঠোঁটের পানকৌড়ি, স্বপ্নে ঘাই 
             দিচ্ছে অজস্র মৌরলা! 


ঘষা প্যাস্টেল রং-এর আকাশ, ও শৈশব
মলিন হয়ে-আসা কিছু অ্যালবাম
যাতে ধরে রাখা জীবনের প্রথম ১৬ টা বছর
খুব ভোরবেলা মুন্সিজির রিকশায় চেপে স্কুলবাড়ি
টিনের চাল আর হাঁ-করা ইঁটের দেয়াল
ফেরতপথে দু’চোখ ভরে দেখা শহরতলির দিন
গা-ছমছমে দুপুর, আতঙ্কের সন্ধে আর
               রাতের আতশবাজি
            অবিরল পেটো পড়ার শব্দ
আস্ত গ্যালাক্সি তার রহস্য নিয়ে কবেই উধাও!

ওরা ছিঁড়ে ফেলেছে আমার কৈশোর
ওরা নষ্ট করেছে আমার যৌবন
শুধু বিকেল, হেমন্তের ঘাতক বিকেল ডানায় বেঁধে
প্যারাট্রুপারের ভঙ্গিতে ভেসে যাব
আরেক জন্মের ডিঙিনৌকোয় পা রেখে নিরুদ্দেশ 
                     হব বলে… 

মন্তব্যসমূহ

জনপ্রিয় লেখা