“গোপাল বড়ো সুবোধ বালক”| সোহম ভট্টাচার্য | আঙ্গিক ব্লগ
নির্বাচনের ঠিক আগে আগে, বিদ্যাসাগরের
টুকরো (পড়ুন মূর্তির) কুড়িয়ে তুলে রাখতে রাখতে মাননীয়া বলেছেন, (এবিপি আনন্দের সাংবাদিক সভা) ইউপি বিহার থেকে গুন্ডা নিয়ে আসা জনতা
পার্টির কথা। পরমুহুর্তে বলেছেন, এই মারপিটে সম্ভাব্য
নিহত দুবরাজপুর থেকে এসেছেন। ইউ পি বিহার থেকে নিয়ে আসার সঙ্গে কিভাবে জুড়ে গেল
দুবরাজপুর। ঠিক পাঁচ বছরের মাথায় কিভাবে একটা বড় সংখ্যক বাঙালি পদবীধারী মানুষজন,
ভারত মাতা কি জয় কিংবা পাকিস্তান ভেজ দেঙ্গে বলতে শুরু করল?
যে মুহূর্তে দাঁড়িয়ে, স্বয়ং মাননীয়াকে
স্বীকার করতে হয় দুবরাজপুর থেকে আসা যুবক ইউপি বিহারের বিজেপি ভাষা বলছে?
বহু তাত্ত্বিক লেখার মধ্যে উঠে আসছে, বিজেপি আর এস এস এর দলীয় তৎপরতা, নিয়মিত অর্থ
কিংবা মদ্যপান জোগাড় করে দেওয়ার অভিযোগ।সি ট্রিপল এস, বলবে,
ইহাই বামপন্থার মরিচঝাঁপি। তাতে ওরাই লাইক কমেন্ট করবে। কাজেই
বাদ দিন। তাই শুধু মদ, পদ বা অর্থ নয়,কারণ তা হয়তো একটা দিনের মাঠ ভরানোর রাস্তা হতে পারে। বাকি দিন?
২০১২ সাল অব্দি যে
দলের মুখপাত্র খুঁজে পেতে এবিপি আনন্দের চাপ হয়ে যেত, সেই দলের সর্বভারতীয় স্লোগান এবং সন্ত্রাসের রাজনীতি, দাঙ্গার রাজনীতি এবং ওয়াটসাপ মেসেজ হঠাৎ প্রাইম টাইমে আসছে, তার কারণ কী একদিনের টাকা কিংবা মদ? তা নয়।
হুঙ্কারের রাজনীতি সবসময়ই একটা পুরো যুগের কাজের উপর দাঁড়িয়ে থাকে, এই ক্ষেত্রে বিজেপির হয়ে সেই কাজের সুযোগ করে দিয়েছেন মাননীয়া আর তার
কর্মীদল নিজেরাই। সাথে পেয়েছেন একটা বদলে যাওয়া অর্থনৈতিক ভিত্তিতে দাঁড়িয়ে থাকা
কলকাতা শহরের মধ্যবিত্তকে, এই সূত্র গুলো একটু ক'রে পরিষ্কার হওয়া দরকার।
২০০৭ সালের পর থেকে, বামপন্থার উপর ধীরে
ধীরে অনাস্থা কিন্তু এত মজবুত হত না যদি না এই শহরের একটা বড় অংশের, বিশেষত মিডিয়ার সাহায্য থাকত শাসক দলের প্রতি । যে মধ্যবিত্তের নেক্সট
জেনারেশন, শহর থেকে বেরিয়ে চাকরি বা পড়াশোনায় যাচ্ছে,
তাদের কাছেও টাটা বা চাকরি তখন প্রয়োজনীয় নয়। কারণ প্রায় ২০০০
সাল থেকেই চাকরির এবং বিশেষ ক'রে মধ্যবিত্ত বাঙালির গড়
ইঞ্জিনিয়ারিং স্বপ্নে, টিসিএস ব্যাঙ্গালোর, আইবিএম পুনে ঢুকে গেছে। ছেলে বা মেয়ে, বাবা
মায়ের সঞ্চয়ের টাকায় প্রাইভেট এডুকেশনে ইঞ্জিনিয়ারিং ক'রে
বর্ধমানে চাকরি করবে, এ কোন উনিশশো আশি? একটু খতিয়ে দেখলে যদিও জানা যাবে সেই সঞ্চয়ের বড় একটা অংশ পাবলিক
সেক্টরে চাকুরীরত বাবা-মায়ের সঞ্চয় যদিও। ডেলি প্যাসেঞ্জার বর্ধমান যাত্রীর সঞ্চয়।
নিয়মিত পেতে থাকা সরকারী চাকরির সঞ্চয়। কোন আমলে সেটা বলছিনা। কিন্তু যে মুহূর্তে
সেই পাওয়া অভ্যাসে দাঁড়ায়, সেই মুহূর্তে মধ্যবিত্ত
প্রাইভেট হতে চায়। ব্র্যান্ডেড স্কুল, টিসিএস, মেন ল্যান্ড চায়না। এইখানে ১৯৯১ ফিরে আসে রান্নাঘরে, রেশনের চালের চেয়ে কোহিনূর বাসমতি ভাল লাগে ২০০০ এর সঞ্চয়ী বাঙালির।
মুশকিল হল, এই অভ্যাসের প্রভাব পড়ে অন্যত্রও। যে ইউনিয়ন
নিজের চাকরিতে ন্যায্য ভাতা দিত, সেই ইউনিয়নকে শুধু স্ট্রাইক
করে বলে মনে হতে থাকে। “বাবা
ভাল হয়েছে, বাবলুকে বাইরে পাঠিয়েছি, এখানে
যাদবপুরে যা ইউনিয়ন বাজি”
আসে। পার্টিসিপেশনের রাজনীতি নেমে আসে, ভোট দেওয়া আর প্রাইম
টাইমে। যেরকম রেগান চাইতেন,শো বিজনেস।
ধীরে ধীরে তাই, টালিগঞ্জের নায়িকা
বীরভূমে দাঁড়িয়ে ভোট চাইতে থাকেন সিনেমার টিকিটের ইঙ্গিতে, ভোটের বাজার তৈরি হয়। মুশকিল হল, এই পুরো
সারফেস এর পলিটিক্সটা তৃণমূল নেত্রী রপ্ত করেছেন। উৎসব করেছেন।
কিন্তু বোঝেননি, বাজারের বড় হতে থাকার
একটা ভিত্তি দরকার। অর্থনীতির ভিত্তি। নইলে, শুধু ক্লাবে
টাকা দিয়ে মফস্বলের নিম্ন মধ্যবিত্তের জুজু মানেনা। নতুন চাকরি না এনে, এনে ফেলেছেন ব্র্যান্ড বাংলা। লিখেছেন কবিতা। এবার বিজেপির প্রয়োজনই
নেই, আপনার সাধের এবিপি বুদ্ধিজীবীর। করাপশন খাতে এমনিই
কিছু টলিউড মুখ এসে গেছে, বাকি মফস্বলকে শেখাতে বেশি সময়
লাগে না যে চাকরি নিয়েছে মুসলিম আর গাড়ি নিয়েছে ছোট জাত। খিদের আসলে এটাই রাজনীতি।
ধীরে ধীরে শাসকদলের নেতারাও বিজেপির ব্র্যান্ডে হাত মিলিয়ে তৃণমূলকে সন্ত্রাসী বলে
দিচ্ছে। মুশকিলে পড়েছে, কলকাতা শহরের মধ্যবিত্ত, এই নতুন সন্ত্রাসটা কলেজ স্ট্রিটের মত ভদদরপাড়ায় হয়ে যাবে বোঝেনি। তাই
যে নিজের ছেলের বাংলাটা খুব উইক বলত, সে আজকে পুরো
বর্ণপরিচয় কিনে পাড়ায় দান করছে। পারলে এখুনি দামোদর পেরিয়ে যায়।
মুশকিলটা বুঝুন, বিদ্যাসাগর এর মূর্তি
ভাঙতে বিজেপি আসেনি, মূর্তিটা ভেঙেছে দুটো বাজারের
লড়াইতে। মূর্তিটা আসলে দুজনের কাছেই সমস্যার, দুজনেই চায়
শিক্ষা স্বাস্থ্য অবৈতনিক না হোক। দুজনেই চায়, নারীর
অধিকার টলিউড নেত্রী ঠিক করবেন। দেবলীনা হেমব্রম নয়।
তাই দুবরাজপুরের ছেলেটা, একদিনে সঙ্ঘ
পায়নি। প্রথমে এস এস সি পায়নি। তারপর অপেক্ষা করেছে। তারপর ব্যবসার লোন পায়নি
অপেক্ষা করেছে। বিশ্ব বাংলার কোনো শিল্প হয়নি, চপ হয়েছে। তারপর
সে বিশ্বাস করেছে, সব মুসলমান খারাপ। তারপর সে কলেজ পাড়ায়
মারা গেছে।
ইউপি বিহারের রাজনীতি আসার যে ভয় এখন মাননীয়া নিজের
মধ্যবিত্তের কাছে দিচ্ছেন। সেটা আসলে দুবরাজপুরকে ঠকিয়ে দিনের পর দিন উৎসবের
অর্থনীতির ভুল। যে ভুলের অতীত আনন্দবাজার লিখেছে, ২০০০ এর
মধ্যবিত্ত লিখেছে। যে ভুল বাজার তৈরি করেছে। যতদিন প্রিন্ট মিডিয়াতে বাঙালি পাঠক
ছিল, ততদিন দিদি ব্র্যান্ড, যেই
মিডিয়ার ফর্ম পাল্টে মোদি বেশি বিক্রয়যোগ্য, তখন অব কি
বার। সবচেয়ে লজ্জার, মূর্তির যে টুকরো গুলি মাননীয়া
তুললেন, সেই 'ভদ্র'লোক অথরিটিকে তবু কিছু প্রশ্ন করেছিলেন, এই
বাঙালি পোস্ট লাইক করে আর বাবলুকে, ইংলিশ মিডিয়াম আর
প্রাইভেট ইঞ্জিনিয়ারিং এর স্বপ্ন দেখিয়ে যাচ্ছে। স্বপ্ন দেখছে ইউনিয়ন নেই এমন
অফিসে তাই রে নাই রে নাই।
আর মনে মনে ভাবছে, কী করে যে বিজেপি এল?
নিশ্চয় টাকা দেয়, মদ খাইয়ে আনে এদের।
নিশ্চয় ইউপি বিহার।
(মতামত লেখকের নিজস্ব)
মন্তব্যসমূহ