আকাশ গঙ্গোপাধ্যায়
সমর্পণ
মাত্র সালোয়ারের পিঠ থেকে হৃদয় কেটে দিয়ে দেওয়া মেয়েটির ফোন বেজে উঠল সারা বাস। সবাই এক নিঃশ্বাসে দেখছিল হাতিবাগান পেরিয়ে যাওয়া যায় কিনা এই সিগন্যালে। নড়চড়ে বসল স্তব্ধতা। কাল রাখী। শহর ফুটপাথ জুড়ে চিকচিকে প্লাস্টিক মোড়া আদর। মেয়েটি ফোন ধরল শান্ত গলায়, ‘আসবি না আজও? বেশ! এবার তাহলে ভেবে দ্যাখ, হচ্ছে না এভাবে!’
শুনে থেকে তাকিয়ে সামনের সিটে, পিঠের হৃদয় জুড়ে বিন্দু বিন্দু ঘাম তার। না জানি চোখের জল এভাবেই নোনা হয়ে ওঠে! ছেলেটি সাঁতার জানলে এবারটাও সামলে যাবে সব। এক আয়নায় চুল আঁচড়াবে তারা।
উপল এখনও বলতে পারেনি। ক্লাস নাইনে কেনা একজোড়া দুল। পড়ার টেবিলের ড্রয়ার। টিউশনে দেখা হওয়া অথবা পুজোর অঞ্জলি... মুদ্রার মনে হওয়ার মধ্যে এক-একটা পাহাড়প্রমাণ ভরসা আর অন্তর্লীন বিবাদ। এভাবে প্রত্যেকটা রাখী পেরিয়ে যায় বায়ো কিংবা ফিজিক্স কোচিং-এ। কিছু না বলার অহংকারে ওরা স্বপ্নে সংসার পাতে এ-ওর সাথে আর বাস্তবে এক একজন উপল প্রতিবার চুপ করে থাকে, এক একজন মুদ্রা জেনেও রাখী নিয়ে আসে সঙ্গে। পিঠের হৃদয় কুঁচকে ঘাম নামে শিরদাঁড়া বেয়ে। পুরোনো অভিমান। মুদ্রার এমন হৃদয় আঁকা ব্লাউজ আছে একটি, রক্ত লাল রঙ। মুদ্রার এমন অভিমানও আছে প্রচুর অহংকার পোষার মতো। আমার ঘোর কেটে যায় আচমকা ব্রেকে। মেয়েটি এবছরের রাখী নিয়ে নেমে গেল শ্যামবাজারে। সালোয়ারের হৃদয়টুকু থেকে এক উপলও স্কুলজীবনের লীনতাপ নিয়ে ক্রমশ নেমে যাচ্ছে গভীর থেকে গভীরে, আরও অন্ধকারে কোথাও...
অর্পণ
ঘুরে দাঁড়াতেই একটি চেনা নাম ভেসে এল কানে। সম্ভবত ডানদিকের ভাঙা বাড়ি থেকেই হবে। এই ভাবনার কারণ কী তা সেই মুহূর্তে একেবারেই মাথায় আসবে না অতএব নামটা আরেকবার ভেবে দেখলাম। কী বলে ডাক এল যেন, এখনও মোহে বাজছে...
বহুজনকে জিজ্ঞাসা করতে করতে রাস্তা ফুরিয়ে এল আমাদের। কালিদাস সিংহ লেন। বৈঠকখানার যে মাথা কেশব সেন স্ট্রিটের মুখে বিফ কাবাবের গন্ধ নিচ্ছে, তার ঠিক উল্টোদিকের গলি। ভাঙা ভাঙা টালির ছাদে ছোট ছোট সংসার। ভাগের সূর্য, ভাগের জল, ভাগের রাস্তা তার ধারে মেলে রাখা ছাপা শাড়ি আর কালো স্যান্ডো গেঞ্জি হাওয়া দিলেই জড়িয়ে ধরছে এ-ওকে। নেপথ্যে বৃদ্ধ জমিদারবাড়ি, কেবল আয়তনে বড় নয়, বয়সেও যারা শ’দেড়েক বসন্ত ছুঁয়েছে কমপক্ষে।
ডাকটা কানে আসতেই আবার তাকালাম ডানদিক। নিশ্চয় কোনও বাঁধাইখানা। তারপর প্রায় ধাক্কা দিয়ে একটি কদমছাঁট চুলের ছেলে দৌড়ে ঢুকে গেল উত্তর কোলকাতার সিগনেচার অন্ধকারে। দরজার ওপাশটা কিছু দেখা যায় না আর।
ছেলেটির বয়স বারো থেকে পনেরো হলে ও নিশ্চয় গ্রামের ছেলে; কাজে কোলকাতা এসেছে, এ বয়সি শহুরে ছেলেরা সেয়ানা অধিকাংশই, তাদের বাপ-মা ডাকলেও ছুটে যাবে না, মালিক তো নস্যি!
উপরে তাকাতেই টিনের বোর্ড, তাতে নীলের উপর নোংরা হলুদে লেখা ‘পাল বাইন্ডার্স’। বোর্ডের নীচে এক অন্ধকার দরজা, গতবছরের শীতের মতো অন্ধকার। যার ওপাশে কিছু ঘর থাকতে পারে ছাঁট কাগজে ভর্তি, যেখানে অন্তত তিন প্রজন্মের লোক থাকার কথা যারা হাঁটু ভাঁজ করে বসে জ্যাকেট জেল করছে পাশাপাশি। একজন দাঁড়িয়ে বোর্ড কাটছে আর বাঁ-হাতে টেনে বাড়তি টুকরো ঢুকিয়ে দিচ্ছে মেশিনের নীচের ফাঁকা জায়গায়। একটি ছেলে সবেমাত্র শ্যাওলা বাথরুম থেকে বেরিয়ে বাতিল ম্যাপলিথোয় পা মুছে নিচ্ছে ভালো করে আর এটুকু সময় দরজা খোলা পাওয়ার সুযোগে পেচ্ছাপের ঝাঁজালো গন্ধ ঘুরে দেখছে খ্যাতনামা কবির এবারের বইয়ে প্রচ্ছদ কে করল শেষমেশ। এসবই আমি অন্ধকার থেকে পাই। গত ছ’বছর যে অন্ধকারকে ভালোবেসে নিজেকে অন্ধকারে টেনে আনছি আপ্রাণ। ছেলেটি ঘোর ভাঙল আমার। এক বাণ্ডিল ছাপা ফর্মা ভ্যান থেকে তুলে মাটিতে ফেলল আচমকা। মুহূর্তের মধ্যেই আবার। গায়ের জোড়ের কমতিটুকু দক্ষ হাতে গতিতে বদলাচ্ছে ও। খুব দ্রুত ভ্যান খালি করে ভিতরে চলে গেল, দেখলাম জামায় হাত মুছেছে, এখনও কাঁচা রয়েছে সে আঠা। এবার একটি ন্যালা গোছের লোক বেরিয়ে এসে উপর থেকে তুলতে লাগল একটা করে রিম। দু’টো নেওয়ার পর আশেপাশে চোখ বোলাল। আগ বাড়িয়ে বললাম ‘ধরিয়ে দেব?’
‘না বাবু। লোক আছে।’
হাঁক পাড়ল সেই নাম। পুস্তানিইইইই!
ছেলেটি বড় মাপের একটা হাওয়াই চটি ঘষতে ঘষতে বেরিয়ে এল। বুঝলাম ও পুস্তানিতে আঠা মারে তাই এই নাম। এবার আমায় দেখে সামান্য হেঁসে বলল ‘কাউকে খুঁজছ কাকু?’
ওর সঙ্গী ঝাঁঝিয়ে উঠল, ‘আগে ছোটো মালটা দে! ঠিক করে ধর, মাথা ঘুরে যাবে নইলে।’
লোকটি চার রিম ফর্মা নিয়ে ভিতরে চলে গেল। একটা সিগারেট ধরিয়ে পুস্তানিকে ঈশারায় ডাকলাম এপারে। স্বতঃস্ফূর্ত এগিয়ে এল। বাড়ি কোথায় জিজ্ঞেস করলে তা বড্ড প্রেডিক্টেবল হয় তাই বললাম ‘হার্ড-বাউণ্ডে কতটা সময় লাগে রে?’
‘কত বই রয়েছে তোমার?’ ‘তাও ধর শ’দেড়েক।’ ‘ওই বড় চালানটা তোমার তাহলে! প্যাক করছে তো। ভিতরে বসবে?’ ‘চল’
জ্বলন্ত ফিল্টারটা গলির ঘুলঘুলি দিয়ে নর্দমায় ফেলার চেষ্টা করলাম, হয়েও গেল একবারে তারপর পুস্তানির পেছন পেছন ঢুকলাম অন্ধকারে। মাঝের সময়ে পুস্তানি আমাকে জানিয়ে দিতেই পারত ওর বাড়ি পাঁশকুড়া থেকে মিনিট চল্লিশের সাইকেল। অথবা আমরা এক ঠোঙা দু’হাতে উল্টে শেষ মুড়িটুকু এ-ওকে ছেড়ে দিতে পারতাম। কিন্তু বৃষ্টি নামল প্রবল। আমি ঘণ্টাখানেক বসে গেলাম অন্ধকারে। পুস্তানি আমাকে ওর অন্ধকারে নিয়ে যাচ্ছে বারংবার। এত কাজ থাকতে ছেলেটা বাঁধাইখানায় ঢুকেছে! ভাবতে অবাক লাগে এসব। এই অন্ধকার থেকে আমি দেড়শো আলো পিঠে নিয়ে ফিরে যাব বাড়ি। তার প্রত্যেকটি খুলে দেখব দামি কালো পুস্তানির ব্যবহার। নিজের পিঠ চাপড়ে দেব দু-একবার অথবা মনে করব পুস্তানি আসলে এক নিবিড় সেতু। কবিতার সঙ্গে মলাটকে যে জুড়ে রেখেছে এতকাল। ঝড়-জল-বৃষ্টিতেও।
তর্পণ
কাল মহালয়া। বাবার দাদুকে ডাকার দিন, তবে বরাবরই বুঝেছি এ ডাক ঠিক আমার ডাকের মতো নয়। একদল ধুতি পরা মানুষ ঘাটের নানা সিঁড়িতে বসে পূর্বপুরুষদের জল দিচ্ছেন। কিন্তু একই সময়ে ডাকা সকলের সাড়া যদি একই সাথে আসে? গুলিয়ে যাবে না? কিংবা যাদের গলার স্বরেও খুব মিল! এই যেমন বাবার বাঁ দিকে পিছনে বসে আছে সংকল্প, কাকু কথা বললে মনে হতো যেন জানা বাবুর ক্লাসে বসে আছি। ক্লাস সেভেন থেকে তর্পণে আসে ও। কাকুকে মনে পড়ে এইদিন, জল পাঠায়, শ্রদ্ধা, যত্ন, ভালোবাসা পাঠায়, কিন্তু বাকি বছর? প্রথম প্রথমও কি বাজার যেতে গিয়ে দু’একবার কেঁদে ফেলেনি? হাতটানে বাবার উপর রাগ হয়নি ওর? সি সেকশন তখন, একদিন দুপুরে স্কুলে ফোন এল বাড়ি ফিরতে হবে। ঠাকুমা অসুস্থ। প্রবীর সঙ্গে করে নিয়ে গেল সামলে। আমরা জানতে পারলাম পরেরদিন। সাতদিন বাদে ন্যাড়া মাথায় হেডস্যারের ঘর থেকে বেরোতে দেখে ছ্যাঁত করে উঠলাম তবু। অথচ বানিয়ে না বললে এ কথায় আমাদের আগেই কান চলে গেছে কাকু আর নেই। ও কাজ সেরে উঠে এলে আমি দৃষ্টি লুকাই। এখন অনেকটাই স্বাভাবিক যেন, তবু ভয় করে। ভয় করে আমাদের একসাথে দেখে মনখারাপ হবে ওর, অজান্তে খারাপ চেয়ে বসবে!
শেষ দু’বছর বিছানা ছেড়ে ওঠেননি কাকু, একটা দুর্ঘটনার পর। দিনের বেলা ঘুমিয়ে কাটান ফাঁকা ঘরে। কাকীমার সীমিত রোজকারে ওদের বসার ঘরে তখন কেবলমাত্র একটি ষাট ওয়াটের বাল্ব, একটি দেওয়ালে লাগানো পাখা। কাকু চলে যাওয়ায় একটি টিউব জ্বলল সে ঘরে। ওষুধপত্রের চেয়ে এখনও টিউবের খরচা কম। আমি ওদের বাড়ি গিয়ে দেখেছি কাকু কীভাবে আলো হয়ে উঠলেন! ছেলেবেলার সেই তারাদের মতো কাউকে টিউব হতে দেখলাম এই। মানুষটা যেন বিছানা থেকে দেওয়ালে উঠে পড়ল আস্তে আস্তে, এখনও গেলে দু’একবার দপদপ করেন অভিমানে তারপর স্থির হন। কাকীমাকে স্নেহোজ্জ্বল দেখায় আরও।
সপ্তাহ দু’য়েক পার করে সংকল্প স্কুলে আসা শুরু করে। মাথায় মিহি চুলের প্রলেপ। গোটা ক্লাস ওর মাথার দিকেই চোখ নিয়ে ফেলে বারবার। স্যারেরা ওর যত্ন নেন, সহানুভূতি দেন, বকাঝকা সরিয়ে রাখেন। বারবার এই প্রসঙ্গে উড়ে আসা নিয়ে ও যারপরনাই বিরক্ত হয় ভিতর ভিতর। দিন আটেকের মধ্যে পুজো, সন্ধের ঘাটে দেখতে পাই একা একা বসে কী যেন আওড়াচ্ছে সিঁড়ির নীচের দিকে। কেউ কী আসবে এখন? কাল মহালয়া। কাকুর সাথেই কথা বলছে তাহলে, ‘ওষুধ-টষুধ রয়েছে তো?’
মন্তব্যসমূহ
- অলোকপর্ণা
- স্নেহা
ভালোবাসা,অফুরান 💜