তন্ময় ভট্টাচার্য
একটা নতুন শহর জন্ম নিচ্ছে
সত্যিই কি খুব অবাক হয়েছি? আগস্ট ২০১৭ আর এপ্রিল ২০১৮ – সাতমাসের ব্যবধানে দু-বার ঢাকা যাওয়া এবং সেখানকার অভিজ্ঞতা থেকে আমার যেন এ-কথাই বারবার মনে হচ্ছে – এ যেন হওয়ারই ছিল। একদিন-না-একদিন হতই। মানুষের দীর্ঘদিন দাঁতে দাঁত চেপে সহ্য করে যাচ্ছিল পথঘাটের অনিয়ম, প্রাণ হাতে নিয়ে বাসা থেকে বেরনো। আর কতদিন? এই ধাক্কার প্রয়োজন ছিল। এবার যদি সিধে হয়!
লিখতে বসে, আগুপিছু না-ভেবেই সটান কয়েকটা কথা বলে দিলাম? সাম্প্রতিক পরিস্থিতির সঙ্গে তাল মেলানোর জন্য গড়ে-তোলা উষ্মা? আজ্ঞে না। আমি নিজের চোখে দেখেছি। ঢাকার ট্রাফিকে,ভিড় বাসের মধ্যে ঘামতে-ঘামতে কুড়ি মিনিটের পথ যখন ফুরিয়েছে দেড়ঘণ্টায় গিয়ে, আর আমি শাপান্ত করছি সিস্টেমের – আমার কলকাত্তাইয়া মনে ঢাকা-সম্পর্কে ভীতি জেগেছিল সেদিনই। কলকাতাতেও ট্রাফিকে ভুগেছি কম না। বাড়ির কাছেই, শ্যামবাজার থেকে ডানলপ আসতে গিয়ে গলদঘর্ম হওয়ার অভিজ্ঞতা সইতে হয় প্রায়শই। কিন্তু ঢাকায় ব্যাপারটা তার চেয়েও মারাত্মক। স্থানীয় লোকেদের মুখেই শুনেছি, একঘণ্টার দূরত্বে কোথাও যেতে হলে, তাঁরা আড়াই ঘণ্টা আগে বেরোন। ভেতরে-ভেতরে যেন মেনেই নিয়েছিলেন, এই পরিস্থিতি থেকে রেহাই নেই। তাঁরা কি আজ আশা খুঁজে পাচ্ছেন? নিজেরাও নেমেছেন পথে? কমরেড, তোমরা নবযুগের শরিক হচ্ছ তো?
হ্যাঁ, নবযুগ। আমি বিশ্বাস করি, বাংলাদেশে আমাদের সমসাময়িক যে জেনারেশন, তারা দেশটাকে বদ্ধতা ও সংকীর্ণতার হাত থেকে অনেকাংশে মুক্ত করতে পারে। বন্ধুদের এবং তাদের বন্ধুদের সঙ্গে মিশে এবং চিন্তাভাবনার ছোঁয়া পেয়ে এমনটাই মনে হয়েছে আমার। কিন্তু সাম্প্রতিক যে আন্দোলন, তা আরও ছোটদের। তরুণতমরা এবার নেমেছে পথে। স্কুলের ছাত্রছাত্রীরা। সমাজের লাল চোখ উপেক্ষা করে, বাসার আপত্তির তোয়াক্কা না-করে তারা দলে-দলে বেরিয়ে এসেছে। কেন? কারণ, তাদেরই সমবয়সি দুজন স্কুলছাত্র তিনটে বাসের রেষারেষিতে পিষ্ট হয়ে মারা গেছে। এই দুরবস্থা যদি চলতে দেওয়া যেত, যে-কোনোদিন যে-কেউ মৃত্যুর শিকার হতে পারতেন। ছাত্ররা প্রতিবাদ করেছিল। সাংবাদিকরা চেপে ধরেছিলেন নৌমন্ত্রীকে। মন্ত্রী আবার কদর্য হেসে সাফাই দেওয়ার চেষ্টা করেছিলেন। উড়িয়ে দেওয়ার চেষ্টা করেছিলেন ‘সামান্য ঘটনা’ বলে। আর তাতেই খেপে ওঠে ছাত্রছাত্রীরা। না, এই রোগ আর বাড়তে দেবে না তারা।
মনে আছে, একদিন সকালে মীরপুর ১০-এর কাছে, কাজীপাড়া বাসস্ট্যান্ডে দাঁড়িয়ে দেখেছিলাম এক বিরক্তিকর দৃশ্য। রাস্তায় জ্যাম, ফলে স্বাভাবিকভাবেই গাড়ি আস্তে চলছে। এরই মধ্যে একটা বাস এসে দাঁড়াল স্ট্যান্ডে। যাত্রী তুলে, গাড়ি গড়াতে-না-গড়াতেই ট্রাফিক ভলেন্টিয়ার হাতের লাঠি দিয়ে দমাদম মারতে শুরু করল বাসের পিছনে। সঙ্গে গালাগালি। সম্পূর্ণ অকারণেই। যেন যান চলাচল নিয়ন্ত্রণের দায়িত্ব পেয়ে কেউকেটা হয়ে গেছে। কলকাতায় এমন ঘটলে, ড্রাইভার তো বটেই, যাত্রীরাও নেমে এসে উচিৎ শিক্ষা দিত। ঢাকার মানুষ এসব সহ্য কেন যে করেন, কে জানে! করেন যে, তা তো নিজের চোখেই দেখেছি। নইলে ধানমণ্ডি থেকে কাজীপাড়ায় আসার আধঘণ্টার পথ সোয়া একঘণ্টা হওয়া সত্ত্বেও সবাই হাসিমুখে বসে থাকেন কী করে!
আমি ঢাকার সাংবাদিক, ছাত্র, চিকিৎসক, সরকারি কর্মচারী – বিভিন্ন পেশার মানুষদের সঙ্গে একসময় আলাপ করেছি ট্রাফিকের এই অব্যবস্থা নিয়ে। সবাই হতাশ, ‘এ-দেশের আর কিস্যু হবে না’ – বলে শেষ করেছেন প্রসঙ্গ। উঁহু, চেষ্টা করলে যে হয়, দেখিয়ে দিচ্ছে ছোট-ছোট ছেলেমেয়েরা। নইলে ‘আম্মু বলেছে, বুকে গুলি না নিয়ে বাসায় ফিরবি না’– এই পোস্টার হাতে নিয়ে দাঁড়ানোর স্পিরিট কোত্থেকে পায়? শাহবাগ আন্দোলন বা কোটা সংস্কার আন্দোলনের প্রেক্ষিত ছিল অনেক বড়। সেখানে, একটা পথ দুর্ঘটনাকে কেন্দ্র করে এই যে কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে লড়াই – বাংলাদেশ দেখিয়ে দিল, প্রতিবাদ কোন স্তরের হতে পারে। ’৫২ মনে পড়ছে? ’৭১? ইতিহাসে পাতায় যা জেনেছি, তারই উত্তরসূরি এই আন্দোলন। হ্যাঁ, এও এক মুক্তিযুদ্ধ। দুর্নীতির বিরুদ্ধে, দিনের পর দিন মুখ গুঁজে মেনে চলার বিরুদ্ধে।
আচ্ছা, ফার্মগেটে কী অবস্থা এখন? শাহবাগে? মীরপুর, নিউ মার্কেট, কল্যাণপুর – সব জায়গায় ছড়িয়ে পড়েছে তো পিচ্চিরা? ওই যে মেয়েটা, ফর্সামতো, ঢাকা মেডিকেল কলেজে ইন্টার্নশিপ করে, আগের রাতে ঘুমোয়নি বলে সিলেট থেকে ঢাকা ফেরার সময় বাসে বারবার মাথা পেতে দিচ্ছিল আমার কাঁধে, এই জনস্রোতে হাতে পোস্টার নিয়ে কি নেমেছে সেও? তার নিচু গলা থেকেও কি ছিটকে বেরোচ্ছে স্বৈরাচারী পুলিশের বিরুদ্ধে রাগ? ধানমণ্ডি লেকের সন্ধেবেলায়, যে-যুবতী বাদামের খোসা ছাড়িয়ে তুলে দিচ্ছিল প্রেমিকের মুখে, সে কি আজ প্রেমিককে এগিয়ে দিচ্ছে ব্যারিকেড তৈরি করতে? আমি জানি, এই পরিস্থিতিতেও কেউ ভাবছে – ‘দেশে থাকব না বেশিদিন, এ-দেশে মানুষ থাকে! ফরেনে চলে যাব শিগগিরি।’ জানি, সমবয়সিদের আন্দোলন করতে দেখেও কোনো ক্লাস টুয়েলভ হাতে মোবাইল নিয়ে চ্যাট করছে তার ‘ইন্ডিয়ান মাল’-এর সঙ্গে। তবু, পতাকা হাতে যে-বাচ্চাটা দাদা-দিদিদের দেখাদেখি নেমেছে পথে, সে-ই বাংলাদেশের ভবিষ্যৎ। তার দিকে তাকিয়েই স্বপ্ন দেখা যায়। শেখা যায়। শিখছি।
এপ্রিল মাসে, যখন ঢাকায় পৌঁছেছিলাম, কোটা সংস্কার আন্দোলন তুঙ্গে। জায়গায়-জায়গায় অবরোধ; যেখানেই যাচ্ছি, সবার মুখে একটাই কথা – ছাত্রদের আন্দোলন। পুলিশি নির্যাতন। সুদূর সিলেটে গিয়েও দেখেছি, সেখানে টগবগ করে ফুটছে তরুণরা। কে কোথায় আহত হয়েছে, সরকার কী পদক্ষেপ নিল – ঘণ্টায় ঘণ্টায় আপডেট পাচ্ছি এসবের। আর আমি, ওই দেশের বাইরের একজন, শুধুমাত্র উত্তাপের ছোঁয়া পেয়ে চিন্তিত হচ্ছি, কৌতূহলী চোখে জেনে নিতে চাইছি পরিস্থিতি। এমনকি, শাহবাগে অবরোধ চলছে শুনে সারাবেলা ঘরবন্দি হয়ে আছি – পাছে অচেনা জায়গায় যাতায়াতের জন্য যানবাহন না পেয়ে বিপদে পড়ি – এমন অভিজ্ঞতাও হয়েছে সেবার। একটা আন্দোলন ঘিরে যখন আশেপাশের সব শ্রেণীর মানুষ উদগ্রীব হয়, সেটাই প্রকৃত জন-অভ্যুত্থান। সাড়ে-তিনমাস আগে, এপ্রিলে, তা টের পেয়েছিলাম নিজে উপস্থিত থেকে। আর আজ, কলকাতায় বসে যখন দূর থেকে জানছি সবকিছু, খবর পাচ্ছি –সরকারের মদতপুষ্ট ছাত্রলীগ আর পুলিশ ঝাঁপিয়ে পড়েছে ছাত্রছাত্রীদের ওপর, মারা গেছে অনেক ছাত্র, ধর্ষিতা হচ্ছে ছাত্রীরা, একটা মেয়ের বুকে ঢুকিয়ে দেওয়া হয়েছে রড – এভাবে বাংলাদেশকে থামানো যাবে? বাংলাদেশের তরুণ প্রজন্মকে! অসম্ভব! আমার মনে পড়ছে যশোর থেকে ঢাকা পর্যন্ত বাসে যেতে-যেতে দেখা রাস্তার দু’পাশে আওয়ামী লীগ সরকারের প্ল্যাকার্ড, শেখ হাসিনার হাসিমুখ। তিনি কি এখনও সেই হাসি ধরে রাখতে পেরেছেন? জানতে ইচ্ছে হয় খুব।
ঢাকায়, চলমান গাড়ির মাঝখান দিয়ে দৌড়ে রাস্তার এপাশ থেকে ওপাশে পৌঁছেছি আমিও। কেননা আর কোনো উপায় ছিল না। সবাই এভাবেই যাতায়াত করে। অশীতিপর বৃদ্ধ, কোলে শিশু আঁকড়ে-ধরা মা, নিরীহ গৃহস্থ – সবার ক্ষেত্রেই, পারাপারের পদ্ধতি একই। যে-কোনো মুহূর্তে বিপদ ঘটতে পারে জেনেও, না, করার নেই কিছুই। সিগন্যাল নিজের মতো লাল হচ্ছে, নিজের মতো সবুজ। ট্রাফিক পুলিশ নিজের মতো হাঁকডাক করছেন। আর দু-চাকা চারচাকা নিয়মও ভাঙছে নিজের মতোই। এই একটা কারণে, কলকাতা নিয়ে গর্ববোধ করতে পারি আমি। কেননা কলকাতার দৈনন্দিন ট্রাফিক নিয়ন্ত্রণ অন্তত দিশাহীন নয়। আমার স্থির বিশ্বাস, ছাত্রছাত্রীদের এই আন্দোলন ঢাকাকে বদলে দেবেই। পরেরবার গিয়ে একটা নতুন শহর দেখব। যেখানে অন্তত প্রাণের ভয় নিয়ে রাস্তায় বেরোতে হবে না। সময়ে বাসায় ফিরতে পারব কিনা – এ-নিয়ে আতঙ্কিত হতে হবে না আমাকে।
হ্যাঁ, আমার জন্যই লড়ছে ও-দেশের ছাত্রছাত্রীরা। আমাদের জন্য। আমি জানি, এ-লড়াইয়ের রং কী। একটা সবুজ আয়তক্ষেত্রের মধ্যে লাল বৃত্ত। ঠিক একবছর আগে, আগস্ট মাসে এই রঙই উড়তে দেখেছিলাম কিশোরগঞ্জে, আমার গ্রামে। সেই থেকে বুকে পুষে রেখেছি তার উদ্ভাস। আজ, ঢাকা-সহ সারা বাংলাদেশে তা ছড়িয়ে পড়ছে দেখে, গ্রাম থেকে নিয়ে-আসা মাটি আমিও কি আবার ছুঁয়ে দেখব না, কমরেড?
(ছবিগুলি সংগৃহীত)
(ছবিগুলি সংগৃহীত)
মন্তব্যসমূহ