প্রিয় নাম শিস দিলে/ ছিঁড়ে যায় আত্মার একক : আমাদের ‘বৃষ্টিদিন’
|| রাজদীপ রায় ||
আলাদাভাবে বলতেই হবে সঙ্ঘমিত্রার কথা। কবি সঙ্ঘমিত্রা হালদার। আমার বন্ধু ভাস্করের খুব প্রিয় বন্ধু সে, লেখে, কিন্তু ছাপতে দিতে চায় না। সঙ্ঘমিত্রা এক নিজস্ব গ্রহের মানুষ। এক বিরল মৌলিক স্বরের অধিকারী। এখনো পর্যন্ত বলে ক’য়ে লালনে ছাপানো গেছে তার লেখা, সে লেখা সমাদৃতও হয়েছে। সে এবার লেখা পাঠাল বৃষ্টিদিনে। আর সে লেখা ছেপে বেরল ১৪১২-র বৃষ্টিদিনে। মিঠিদি জিজ্ঞেস করছে: ‘তোর বন্ধু কোথায়?’ মনে আছে সঙ্ঘমিত্রার লেখা পড়ে খুবই প্রশংসা করেছিলেন দিদি। এরপর থেকে সঙ্ঘমিত্রা শুধু বৃষ্টিদিন নয়, অনেক পত্র-পত্রিকাতেই নিয়মিত হয়ে ওঠে। বাকিটা ইতিহাস। শুধু সঙ্ঘমিত্রা নয়, এই ঘটনা শূন্য দশকের অনেক গুরুত্বপূর্ণ কবির ক্ষেত্রে ঘটেছে।
খুব মনে পড়ছে দেব মাইতির কথা। তার দৃপ্ত কবিতাভাষার কথা। শুধু বৃষ্টিদিনই নয়, লালনেও দেবদা অনেক কবিতা লিখেছে। বৃষ্টিদিন থেকে প্রকাশিত হল দেব মাইতির প্রথম এবং একমাত্র বই ‘রঙিন খামে কালো অসুখ’। সে বই বেশ আদৃত হয়েছিল। তখন দেব মাইতির কবিতা মানে সে এক ব্যাপার। এখন তো আর সে লেখে না। থাকে সম্ভবত মেদিনীপুরের প্রত্যন্ত কোনো গ্রামে। পাঠক, আপনারা যারা এই তুচ্ছ স্মৃতির আখ্যান পড়ছেন,তাদের দেব মাইতির কবিতা পড়াই একটু :
কালাপানি
বৃষ্টির অনুপাত কোথাও কমবেশি
ঈশ্বরের হাতও...
আমার মাথায় ছাতা,কারও রেনকোট,ছাদ
ওদের একটা পাঁচিলকে কেন্দ্র করে
প্লাস্টিকের ছাউনি ,
ভেতরে বাচ্চা কাঁদছে
চোখের জল বৃষ্টির জল
বৃষ্টির জল চোখের জল
জল...জল...জল...
কোথাও বাজ পড়ল
বোধায় ঈশ্বরের মাথায়
বাচ্চাটার মায়ের অভিশাপ
আর একটা কবিতা পড়ুন, কবিতার নাম ‘আমার পৃথিবী’
যেদিন থেকে বাস কনডাক্টর মাযের কাছে
আমার জন্যে ভাড়া চেয়েছে
সেদিন থেকেই আমি বড় হয়ে গেছি।
অথচ গরুর চোখের কোলে লম্বা জলের মত স্পষ্ট
নিম্নবিত্ত বেঁচে থাকার জোড়াতালি যন্ত্রণা
আমার ‘রাঁধুনি’ মাকে এখনো লুকিয়ে রাখতে হয়,
আর বাবার ‘রিক্সাওয়ালা’ অপবাদ মৃত্যুতে ঘুচবে
সঙ্গে রিটায়ারমেন্ট...
আমি মাযের দিকে গভীরভাবে যাই না
বাবার দিকেও নয়,
কারণ, আমি নিমগাছে নিমফল
দিনে কারখানা সন্ধ্যেয় কলেজ...শেষে তাও
ধরে রাখতে পারিনি,ফলত কখনো কারখানা
কখনো অফিস, কখনো বা দোকানে স্বল্প বেতনভোগী,
মুমূর্ষুর জন্যে আপেল, বেদানা কোথায় পাব।
এই বেশ ভাল ঝড়বৃষ্টি সামলে ফুটপাথবাসীর মতো
ভাড়াবাড়িতে আমরাও বেঁচে আছি মিলেমিশে
একে অপরের সান্ত্বনা হয়ে।
খালি যা মাঝেমাঝে ভুল করে স্বপ্ন দেখে ফেলি:
আমি একদিন...
জীবন নিংড়ে লেখা কবিতা এসব। প্রবল সম্ভাবনাময়। কিন্তু সেই সম্ভাবনা আর এগলো না। এই দুঃখের। তবে জীবন ফুরিয়ে যায়নি এখনো। নিশ্চয়ই দেব মাইতি আবার কবিতা লিখবেন,আমরা অপেক্ষা করব,পড়ব সেইসব লেখা।
ছন্দের হাত কোনোদিনই তেমন ভাল ছিল না। একবার লেখা পাঠিয়েছি। নির্বাচনের সময় ফোন। ফোনের ওধারে অরিনিন্দম মুখোপাধ্যায়। অরিনিন্দমদা ফোন করে বলছে, তোর দিদি বলছে ছন্দটা শিখে তারপর ছন্দপ্রয়োগ করতে। আর বলছে তোর সাবলীল লেখা তো নয় এগুলো,পাঠিয়েছিস কেন? আরও কিছু লেখা পাঠা। প্রতিটা কথাই দূর থেকে বলে দিচ্ছে দিদি। আমি আবছা গলা শুনতে পাচ্ছি। লেখা প্রত্যাখ্যান তো কতবার হয়েছে। ভবিষ্যতেও হবে। কিন্তু সেই প্রত্যাখ্যান আর দ্বিতীয়বার এত স্মরণীয় হয়নি। এর পরে আরো পাঁচটা লেখা পাঠাতেই দিদির ফোন, লেখা পছন্দ হয়েছে। কিন্তু একটা লেখায় একটা শব্দ প্রয়োগ করেছি: ‘হাপ্তা’। সেটা কী? বললাম আমাদের অঞ্চলে যখন ঘুড়ি কেটে যায়, বাকি পড়ে থাকা সুতো যেটা লাটাইয়ে ফের গুটিয়ে নিতে হয়,সেটাই হাপ্তা বা হপ্তা। আঞ্চলিক শব্দ। হাওড়ার ছেলেদের, যারা ঘুড়ি ওড়াতে ভালোবাসে, তাদের প্রিয় শব্দ।
নতুন নতুন মেয়েরা লিখতে এলে সেটা ছিল দিদির বিশেষ আনন্দের। সঙ্ঘমিত্রার কথা আগেই বলেছি। দীপান্বিতা, রাকা, সম্রাজ্ঞী, শ্রীদর্শিনী চক্রবর্তী, স্বাগতা দাশগুপ্ত এদের কথা তো সকলেই জানেন। কিন্তু স্বাগতা গুপ্ত? বৃষ্টিদিন ১৪১০ সংখ্যায় তার লেখা পাচ্ছি। এরপর তিনি অনুপস্থিত। আমি নিজে দেখেছি মিঠিদিকে এই মেয়েটির কাছ থেকে লেখা চাইতে। এখনো কি লেখে সেই মেয়ে? এখনো কি কেউ তাকে পরম স্নেহে বারবার লিখতে উৎসাহ দেয়? কিংবা মৃদু ধমক দিয়ে বলে, এবার কিন্তু লেখা দিতেই হবে, না বললে শুনব না...আমার কাছে উত্তর নেই। শুধু রয়েছে তার পাঁচটি কবিতা। একটা পড়াই আপনাদের:
প্রতিদ্বন্দ্বী
বরফ উপত্যকা
তোমাকে পলকে চিনে ফেলি
স্বপ্ন থেকে পিছু নিয়ে
উপড়ে এনেছ এই মৃত্যুময় হিমে
সীমান্তে,কাঁটাতারে কবে ছিঁড়েছিল
শিশুকাল,নীল ফ্রকের বোতাম...
আজ আমাকে দুয়ো দিয়ে
আমাদের সন্তান সাবলীল তুলে নেয়
বিষ ছুরি,পিছল জঙ্গী হাতিয়ার।
সে ঘুমোলে
জেগে থাকে কালশনিকভ
বাতিল আমার চোখে
তবু পিছু নেয় চোরা শুঁড়িপথ,
তাড়া করে
ছুঁড়ে ফেলে মৃতদের স্তূপে...
একটি লিটল ম্যাগাজিনের শুধু এই কাজ নয় যে, কিছু কবিতা একত্র করে ছাপিয়ে দেওয়া। সেটা প্রথম জীবনের পাগলামি হিসেবে চলতে পারে। কিন্তু যদি সত্যি তার যদি স্টেটমেন্ট থাকে, তবে তা খুবই স্পষ্ট হওয়া প্রয়োজন। বৃষ্টিদিন এই কাজ করে গেছে স্বার্থহীন ভালবাসায়। একজন কবি হিসেবে মিঠিদির মনে হয়েছে, শুধু কবিতা লিখে জীবন পরিপূর্ণ করা নয়, পরবর্তী প্রজন্মের ছেলেমেয়েদের হাতটা তাকেই ধরতে হবে। এ ব্যপারে ছায়ার মতো তার সঙ্গে থেকেছে অরিনিন্দমদা। বৃষ্টিদিন তাদের মিলিত সন্তান। যে সন্তানের হাঁটতে শুরু করার সঙ্গে একটি দশকের গড়ে ওঠাও ইতিহাস হয়ে রয়েছে। বৃষ্টিদিন আর প্রকাশিত হয় না। ১৪২২, অর্থাত্ জানুয়ারী ২০১৬ তার আপাত শেষ সংখ্যা বেরিয়েছে। সে ঘুমচ্ছে এখন। হয়ত যে-কোনও চিরন্তন সৃষ্টি এইভাবে থেমে যায়। বুকে রেখে যায় দগদগে ক্ষত। মনে হয় আবার কোনও এক বছর লিটল ম্যাগাজিন মেলায় যদি গিয়ে দেখি বৃষ্টিদিন আবার স্টল নিয়েছে! সেই আবার বাম দিকে। জেঠিমা বসে আছেন। মিঠিদি হাসছে। হাসছে অরিনিন্দমদা, আর তাদের সামনে টেবিল আলো করে সুদূর মেদিনীপুর থেকে আসা কোনও তরুণ কবি। সে বিপুল বিস্ময়ে বৃষ্টিদিন উল্টে দেখে নিচ্ছে তার ছাপার অক্ষরে প্রকাশিত তার প্রথম কবিতা। আপাতত এ দৃশ্য স্বপ্নই। মেলা ভেঙে গেছে। যে যার পক্ষে যুক্তি তুলে সীমাহীন অভিমান নিয়ে দূরে সরে গেছে। তবু তাদের মধ্যে কেউ কেউ যখন প্রথম পা রাখে লিটল ম্যাগাজিন মেলায়, অজান্তেই চোখের কোণ নোনতা হয়ে ওঠে। তাহলে কি এবার বৃষ্টি এল চোখের ভেতর?
জেঠিমা- অনীতা সেন
|| আঙ্গিকে কবির গদ্য ৪ ||
মন্তব্যসমূহ