ছায়াচরাচরঃ পাঠ প্রতিক্রিয়া- সায়ন্তন ঠাকুর
ছায়াচরাচর
লেখক- সন্মাত্রানন্দ
প্রচ্ছদ- সৌজন্য চক্রবর্তী
প্রচ্ছদ- সৌজন্য চক্রবর্তী
প্রকাশক- ধানসিড়ি
দাম- ৩৭৫ টাকা
দাম- ৩৭৫ টাকা
আমরা কত কী না হতে চাই জীবনে। বয়সের সঙ্গে সঙ্গে সেই
“হতে চাওয়া” গুলোও পাল্টে যেতে থাকে। ধরা
যাক, প্রথম যৌবনে কেউ চিত্রকর হতে চায়, দশ বছর পর যখন চুলে সাদা রঙের আভাস, চোখের তলায় ঘন
ক্লান্তির কাজল তখন হয়তো সে একজন সার্থক পিতা হয়ে উঠতে চায় অথবা একজন সুখী
গৃহী! কে জানে শেষ অবধি কিছুই হয়ে উঠতে পারে কিনা! এই হয়ে-ওঠার বাসনার চারপাশে
বয়ে জীবন। প্রতিটি দিন এবং রাত্রি। ক্লান্তিহীন ঋতুচক্র। চৈত্রের খরতপ্ত
মধ্যাহ্নে ছায়া ফেলে এগিয়ে আসে কার্তিক মাসের হলদে রোদ্দুর অথবা চরাচর আকুল করে
ধেয়ে আসা জলভরা মেঘের দল। কত নাম-না-জানা ফুল ফোটে। আবার ঝরে পড়ে। গাছে নতুন
পাতা আসে। একাকী কোনও মাঠে ঝলমল করে ক্ষুধার অন্ন, হলুদ
ধানের শিষ। আমরা খেয়াল করতে পারি না। দিন যে কাটে আমাদের ওই কিছু “হয়ে ওঠার” নেশায়।
কেমন হয় ? যদি কেউ লেখেন
এই হয়ে ওঠা অথবা না হতে পারার গল্প ? মধুসূদন সরস্বতী সে
আখ্যানের নায়ক। বিস্মৃত বাঙালি। অদ্বৈত বেদান্তের আচার্য। কিন্তু শুধু কি তাই ?
তিনি কি নৈয়ায়িক নন প্রথম জীবনে ? কৈশোরে
কবি হতে কি তিনি চাননি ? হ্যাঁ তিনি চেয়েছিলেন। তাহলে শেষ
পর্যন্ত কী হয়ে উঠলেন ? এইস্থলে লেখক সন্মাত্রানন্দ তাঁর
উপন্যাসের প্রারম্ভে আমাদের গঙ্গার এক ঘাটে নিয়ে যান। চোখ বন্ধ করে ভাবতে বলেন,
যে মানুষটি ঘাটের পৈঠায় বসে আছেন তিনি বসেও থাকতে পারেন আবার
একইসঙ্গে নৌকোয় চেপে ওপারেও যেতে পারেন। দুটোই সম্ভাবনা। চোখ খুললেই একটি
সম্ভাবনার বাস্তবে মৃত্যু ঘটবে, কিন্তু অন্য কোনও সমান্তরাল
বিশ্বে সে প্রবাহিত হতে থাকবে।
আশ্চর্য মনে হচ্ছে আপনার এই যুক্তি পাঠক ? আসুন
আমরা একটা খেলা শুরু করি। ধরা যাক আপনি একটি মেয়েকে ভীষণ ভালোবাসতেন। সেই যে
আপনার স্কুলের দিনগুলো, সাইকেল, একই
মাস্টারমশাইএর কাছে একসঙ্গে পড়তে যাওয়া সন্ধেবেলা, তার নরম
হাতের আঙুল, কিন্তু বলে উঠতে পারেননি কখনও। যদি সাহস করে
বলতেন তখন ? তাহলে তো আপনারা দুজন কত ফুলেল বিকেলে অস্ত
সূর্যের আলোয় নীচু স্বরে গল্প করতেন। কত মান অভিমান হত। কত ভাব আড়ি ঝগড়া আড়ালে
কত চকিত চুম্বন! হত তো ? আপনি বলবেন এ তো কল্পনা!
সন্মাত্রানন্দ বলেন, এ কল্পনা নয় এ এক সম্ভাবনা। এবং সেই
সম্ভাবনা ঘটমান অন্য কোনও প্যারালাল ইউনিভার্সে। আরও মজা হয় যদি সেই যে ছেলেটি
আপনারই মতো দেখতে, আপনারই ছায়া, যে
মেয়েটিকে প্রেম নিবেদন করতে পেরেছিল, আর এই আপনি, যিনি পারেননি প্রেম নিবেদন করতে, দুজনের আজ এই
মুহূর্তে যদি দেখা হয়ে যায় ? কী ঘটবে তখন ?
তখনই বোধহয় লেখা হয় ছায়াচরাচরের মতো আশ্চর্য এক
উপন্যাস। মধুসূদন সরস্বতীর বাল্য নাম কমলনয়ন। সে কবি হতে চেয়েছিল। কাব্য
প্রতিভাও তার ছিল। কিন্তু পারলেন না হতে। পরে তিনি হতে চাইলেন নৈয়ায়িক। আরও পরে
অদ্বৈতবাদী সন্ন্যাসী। কিন্তু কিছুই হয়ে উঠতে পারলেন না শেষ অবধি। আর এই না হতে
পারা মুহূর্ত থেকে জন্ম নিল একেকটি নতুন চরিত্র। পদ্মাক্ষ। উৎপলদৃষ্টি। একেকটি
সম্ভাবনার বিশ্ব। যা যা হতে চেয়েছিলেন কমলনয়ন সেখানে তাঁরা তাই হয়ে উঠলেন। শুরু
হল আখ্যান। সে আখ্যানে আছে আজকের সাম্প্রদায়িক হিংসার বীজ তৈরি হওয়ার মুহূর্ত।
আছে বেদান্ত দর্শন। আছেন এক পরমা আশ্চর্য ভৈরবী। যোগ বাশিষ্ঠ রামায়ণের গল্প।
কাশীর ঘাট। যুবক তুলসীদাস। কোথাও আবার জলদস্যুদের সঙ্গে রোপ ফাইটের অতুলনীয়
রোমাঞ্চকর দৃশ্য। আছেন সম্রাট আকবর। প্রতাপাদিত্য। সুর সাধক এনায়েৎ খাঁ এবং
পরাবাস্তব এক হাভেলি। আর সবার মধ্যে মিশে আছেন সেই তিনি। এক সজল সপ্রাণ বিগ্রহ
কৃষ্ণকিশোর। তিনি কথা বলেন কমলনয়নের সঙ্গে একাকী। নিভৃতে। আমার পড়া বিগত কুড়ি
বছরের বাংলাভাষার শ্রেষ্ঠ সংলাপটি রচিত হয় তখন। অন্ধকার রাত্রি। মধুসূদন
কৃষ্ণকিশোরের জন্য ভোগ রান্না করছেন। উনোনের আলো তাঁর মুখে। সামান্য আয়োজন। ভাত
ডাল সেদ্ধ আর বেগুন দিয়ে কুমড়োর তরকারি। কৃষ্ণকিশোর ডাকছেন—কমল,
ও কমল! বলছেন, আমার ক্ষিদে পেয়েছে! বায়না
করছেন রান্না করার!
এ কোন জগত ? অদ্বৈতবাদের
বিপরীতে দাঁড়িয়ে থাকা এ কোন সত্য ? নাকি আমার ভুল! কোথাও
কোনও বিরোধ নেই। “মায়ায় ধরিলে মানবকায়”ই তবে এভাবেই প্রকাশিত হয় ? জানি না। শুধু ক্লান্ত
আমার জীবনে কী এক অপূর্ব আলো বয়ে আনে ওই দৃশ্য। আশ্চর্য প্রেমের সামনে নতজানু হতে
ইচ্ছে করে। মনে হয় শুধু এই ভালোবাসার টানেই তো বেঁচে থাকা যায়।
এ উপন্যাস সাধু ভাষায় লিখিত। কিন্তু নির্ভার পালকের
মতো তার রূপ। যেন ঢেউএর দোলায় ভেসে যাওয়া ডিঙি। চাঁদ উঠেছে তার পাশে। মায়াবী
আলোয় ভেসে যাচ্ছে চরাচর। এ ভাষা পূর্বজ কোনও সাহিত্যিকের ভাষা নয়। এ আমার দেশের
ভাষা। এ ভাব বাংলা ভাষায় অন্যতম শ্রেষ্ঠ প্রেমের ভাব। ছায়াচরাচর যেন আমার নিজেরই
বেঁচে থাকার গল্প। কিছুই হয়ে উঠতে পারিনি আমি। বৃথা কেটে গেল সময়। এই উপন্যাস
আমার পাশে এসে দাঁড়ায়। কাঁধে হাত রাখে। ভালোবাসার স্বরে বলে, সেই
তো ভালো। কিছু হতে পারনি, এই ভালো। ওই যে দ্যাখো শরতের
রাত্রি, ওই মাধবীলতা, তোমার বাড়ির
পাশে ল্যাম্পপোষ্টে জ্বলে থাকা একাকী হলুদ বাল্ব, ছাতিমের
গন্ধ, ওরাও কি কিছু হতে পেরেছে, বলো ?
এই তো তোমার ভুবন! অনেকদিন পর ঘুমোতে ইচ্ছে করে আমার। বাংলাভাষায়
ছায়াচরাচরের নামটি সোনার অক্ষরে লেখা হয় তখন। যে লেখা এক সামান্য ব্যক্তিমানুষের
কষ্ট মুছিয়ে দিতে পারে। লেখক সন্মাত্রানন্দের শ্রেষ্ঠ উপন্যাস ছায়াচরাচর,
এখনও পর্যন্ত, অন্তত আমার কাছে।
-সায়ন্তন ঠাকুর
আঙ্গিক, বইমেলা সংখ্যা, ২০১৯
মন্তব্যসমূহ