সেলিম মণ্ডলের কবিতাগুচ্ছ | আঙ্গিক অনলাইন


গুচ্ছকবিতা/ সেলিম মণ্ডল

কবির পিতামাতা

কবির পিতামাতা বড়োবেশি ধার্মিক
তারা সকাল সন্ধ্যা ঈশ্বরের নাম জপে
আর ঈশ্বরকে বলে— হে ঈশ্বর, তুমি আমার সন্তানকে
সঠিক রাস্তায় ফিরিয়ে দাও

কবির পিতামাতা টাকা পয়সা জমায় না
গাড়ি কেনে না
বাড়ি বানায় না
অল্প অসুখে চিকিৎসা করায় না
কোনো কিছুতেই বিশেষ খরচ করে না
জমানো টাকা নিয়ে সন্তানের মুখের দিকে চেয়ে থাকে
তারা সাদা পাতার শূন্যতার দিকে তাকিয়ে থাকে



কবির বউ

প্রথম প্রথম বউ বলত— চলো, কোথাও ঘুরে আসি।
এ-কাজে ও-কাজে ছুটি চলে যায়।
আমি বলি— পরের ছুটিতে যাবই, যাব...
একের পর এক ছুটি ফুরিয়ে যায়... চুলে পাক ধরে।
তারপর ভুলে যায়।
আমি নিজেই বলি— কই আর বেড়াতে যাওয়ার কথা বলছ না যে?
সে বলে— আমি কবির বউ।
ওই তো, তোমার কবিতায় কালো পাহাড়, নীল সমুদ্র, সাদা বরফ...

আমি রোজ ভ্রমণ করছি... 

বউয়েরা অভিমান করলে আয়নায় তার অজস্র প্রতিবিম্ব পড়ে।
বউকে বলি, এত অভিমান করেছ; মুখ দেখা যায় না।
সে বলে— আয়নায় মুখ দেখতে নেই। 
কবিরা কখনো আয়নায় মুখ দেখেনি... দেখেও না...

কবিদের কাছে মনখারাপ এক কালো তিল।
শরীরের সঙ্গে লেপটে থাকে। 

বউয়েরা সেই মনখারাপ ঘষতে গিয়ে দেখে—
বেরিয়ে আসছে লাল চামড়া!



কবির বন্ধুরা

কবির বন্ধুরা সকালে ও বিকালে দু-বার দাঁত মাজে
তারপর সেই দাঁত বার করে হাসে
কারণ, তার বন্ধু কবিতা লেখে

কবির বন্ধুরা ভাবে— ব্যর্থ লোকগুলোই কবিতা লেখে
সবাই হতে চায় রবীন্দ্রনাথ 
তারা কবিতালেখক বন্ধুকে ‘রবীন্দ্রনাথ' বা ‘কবিগুরু' বলে ডাকে
আর মিটিমিটি হাসে

কবির বন্ধুরা ভাবে— কবিতা লেখা খুব সহজ
তারা প্রায়ই বলে— ভাই, প্রেমিকার জন্য একটা কবিতা লিখে দে
কলেজের নবীনবরণে একটা কবিতা লিখে দে
অথবা, বিশেষ দিবসে একটা কবিতা লিখে দে
কবি হলদে দাঁতে হাসেন
বন্ধুরা হাসেন সাদা ঝকঝকে দাঁতে

আসলে কবির কোনো বন্ধু নেই
প্রতিটা শব্দ সাদা পাতা অবধি পৌঁছানোর আগেই কবি রক্তাক্ত হন

কবি নিজের সঙ্গে বন্ধুত্ব করতে পারেন না বলে
ঝুলে পড়েন শব্দের ডগায়



কবির প্রেমিকারা

তাকে নিয়ে কবিতা লিখবে বলে অপেক্ষায় থাকে কবির প্রেমিকারা
কবির কি এক প্রেমিকা হয়?
গাছ, নদী, সমুদ্র, পাহাড়, চাঁদ... কত যে প্রেমিকা!
তারা প্রেমিককে ভাগ করতে চায় না...
শব্দ থেকে খুঁজে নেয় সন্দেহবীজ... গাছ বড়ো হলে
কবি চাপা পড়ে মরে...

প্রথম চিঠিতে লিখে ফেলে অনেক অনেক কথা
কবি কম কথা বলে
আকাশ, বাতাস জেনে গেছে বলে ভাবে প্রেমিকাও যাবে জেনে সবই
প্রেমিকারা যখন জানে মুখচোরা কবি, তখন 
দূরে ওড়ে সকল প্রতিশ্রুতি 

কবিকে বিয়ে করে কোনো প্রেমিকা হতে চায় না বউ
লাল সিঁদুরে রাঙানো সংসারে কবিতা যে বেমানান
তা সকল প্রেমিকারা জানে...



কবির প্রতিবেশীরা

একবার পাড়ার এক মধ্যবয়স্ক লোক— কীরে, তুই চাকরি-টাকরি পাসনি?
পাশ থেকে থেকে এক ছেলে— ও চাকরি করবে কেন?
চাকরির ডবল ইনকাম করে...
ও কবি, কবিতা লেখে...

কারো গোঁফ-দাড়ি বড়ো হলেই প্রতিবেশীরা সন্দেহ করা শুরু করেন
ভাবেন, নিশ্চয় কবিতা-টবিতা লিখছে...



কবির প্রকাশক

ঝড়ের মতন উড়ে যাবে প্রথম সংস্করণ
এই আত্মবিশ্বাস নিয়ে কবিতা লেখেন কবি
প্রকাশক ছাপান! যতটা দ্রুত পারেন তার অধিক দ্রুত ছাপান
এরপর কবির বিশ্বাসে পড়ে মেঘের ফুটকি
টুপটাপ বৃষ্টি পড়ে
প্রকাশক কিনে নেন নতুন রুমাল

এত বই বিক্রি হল, রয়্যালটি কই?
কবি ভাবেন, সব প্রকাশক জোচ্চর!
এটাই বাংলাবাজার! এত কবি না খেয়ে মারা গেল!
এ দোষ কারো না, কারো না
কবিতা লিখছি, এটাই ভাতের অহংকার...

প্রকাশকের সঙ্গে কবির বন্ধুত্ব দীর্ঘস্থায়ী হয় না
কবি ভাবেন, এখুনি আত্মসাৎ হবে নতুন পাণ্ডুলিপি
প্রকাশকও ভাবেন, দূরে থাকা ভালো
আবার গুঁজে দেওয়া পাণ্ডুলিপিতে লেগে যাবে বন্ধুত্বের অপরাধ



কবির কলিগ

কবির কলিগরা উঠতে-বসতে গালাগালি করেন
কবি ঠিকমতো কাজ করেন না
কাজে ভুলভাল করেন
তবে তাঁরা আফশোস করেন—
ফেসবুকে, কবি তাঁদের ছবিতে লাইক-কমেন্ট দেন না

লোকটি অসহ্যকর
চুপচাপ বসে থাকেন
পাঁচবার ডাকলে একবার সাড়া দেন
কোথাও গ্রুপ ট্যুরে যেতে চান না
ভালো রেস্টুরেন্টে খেতে যেতে চান না
কবির কলিগরা এসব ভাবেন...
কবি জেনে-বুঝে চুপচাপ থাকেন, আর আকাশের দিকে তাকিয়ে
বন্ধুদের নামে উড়িয়ে দেন সাদা পায়রা...

মন্তব্যসমূহ

রাজর্ষি দে বলেছেন…
খুব ভাল লাগল সেলিম

জনপ্রিয় লেখা