আম-আঁটি-মানুষ | সুপ্রিয় মিত্রের গদ্য | আঙ্গিক


কটা সিমবায়োটিক এফেক্ট প্রতিমুহূর্তে তাড়া করছে। বহুকাল বেঁচে থেকে এই পাশাপাশি আমগাছ আর জামগাছকে আলাদা করে চেনা যাচ্ছে না। এই বাগানকে দেখতে লাগছে অরণ্য। এই অরণ্য বাগানকে দেখে নিজেকে কেমন গুটিয়ে নিয়েছে। অরণ্যের পাশে স্থিত বাড়ি– সেই বাড়ির ভিতর ঘরের পুঞ্জ। ঘরগুলির মধ্যে এখন মিল খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে। আলাদা করে আর ঠাকুর ঘর, শোয়ার ঘর, খাওয়ার ঘর, রান্না ঘর বোঝা যাচ্ছে না তেমন। 

 সিমবায়োটিক এফেক্ট লেলিয়ে দিয়েছে কেউ। ঠাকুরদা বহুকাল আগেই গত, কিন্তু পিতার বার্ধক্যে তিনি কেমন ফিরে এসছেন পিতার মুখপটে। বেঁচে নেই সন্তান। তার মাকে আজ দেখতে লাগছে তার মতো। একটা স্মরণিকা প্রত্যেকে প্রত্যেকের মুখে লাগিয়ে বসে আছে, বহুকাল একসঙ্গে পাশাপাশি থেকে। 

   কোনও বাড়িতে বা পুরো পরিবারই উজাড়। ফলে, পরিত্যক্ত বাড়ি থেকে ক্রমশ সিমবায়োটিক এফেক্ট উবে যাচ্ছে। রোদ পড়লে তার ভাপ দেখতে পাওয়া যায়। কেমন হিলহিলে সেই অনভিকর্ষ কাপাসপ্রবাহ। 

   আবার কোনও বাড়িতে ফিরে এসছে দূরালোকের সন্তান। ফেরার সময় সে দেখছিল, যত এগিয়ে আসছে বাড়ির দিকে, রাস্তাঘাট-মানুষজন সব বাড়ির মতো দেখতে হয়ে যাচ্ছে। দুয়ারে পৌঁছে দেখল, বাড়ি আর সেই বাড়িটি নেই। তাকে দেখতে লাগছে খানিকটা পাশের পুকুর, খানিকটা বাগান। বাঁচোয়া, আকাশ নেই। তবে, বাড়ির বয়স বাড়লে, আকাশের তলায় থাকতে থাকতে, এই সংক্রমণও ঘটে যাবে ঠিক। ফাটল, চিড় খুব দূরে নয়। 

   এই সিমবায়োসিস থেকে আপাতত দূরে আছে পাড়ার ইশকুল। শ্মশানও। খানিকটা হাসপাতাল। কোনও বহুকালীনতার সংস্কার এখানে নেই ভাই। দীর্ঘকালীন ডাব্বা খাওয়া ফেলুকে স্কুল রাখে না। শ্মশানের কথা ওই, যতক্ষণ আগুন ততক্ষণ কাঁদুন। হাসপাতালের কথা এখন থাক। এক মিনিট। আচ্ছা। হুঁ। হুঁ। আচ্ছা। হাসপাতাল বাদ দিলেও, ডাক্তার কিছু বলতে চান।

   ডাক্তার বলছেন– কী সারাব? কাকেই বা সারাব?

   রোগীর প্রশ্ন– কী দেখাব? কাকেই বা দেখাব? দেখাতে গেলেই তো...

   রোগীর আত্মীয়র চিন্তা– আরে, কী করে হবে? কার থেকে হবে?

   তাহলে স্কুলে যাওয়া যাক। বাড়ি আর সুরক্ষিত নয়, স্কুল বরং সেফ হোম। রোগীর সন্তান ভাবে, এই সুযোগে কি স্কুল যাওয়া হবে?

   স্কুলের ভোলবদল দেখে দুয়ারে শিক্ষক বলে ওঠেন– কী আর পড়াব? কাকেই বা পড়াব?

   ছাত্রছাত্রীর কৌতূহল– কে পড়াবে... কী আর পড়াবে?

   

   বিন্দুমাত্র সিমবায়োসিস নেই। ফলে, কেউ কাউকে চিনতে পারছে না। এমনকী ভাষা, এমনকী স্নেহ, এমনকী ক্রোধ অচেনা হয়ে গিয়েছে এসমস্ত অঞ্চলে। যা আছে, তা নিতাইচাঁদের দরবারে প্রকৃতির মোটাদাগের ভাষা– আত্মরক্ষার ভাষা।

 

    এসমস্ত দেখে হতাশ নিরীশ্বর লিখলেন– কী লিখব? কার জন্য লিখব?

    পাঠক-ভগবান বললেন– কী পড়ব? কেনই বা পড়ব? কিন্তু, আমি একখান লেখা লিখেছিলাম... স্যর, যদি আজ্ঞা দেন, আপনাকে পড়ে শোনাই...

    নিরীশ্বর বললেন– অ, পড়ো...

    কিঞ্চিৎ গলা খাঁকারি দিয়ে শুরু করলেন–

     যাবদ ভ্রিয়তে জঠরং তাবৎ স্বতং হি দেহিনাম।

     অধিকং যোহভিমন্যেত স স্তেন দণ্ডমর্হতি।।

    –অ্যাই অ্যাই অ্যাই... এটা তোমার লেখা কোত্থেকে হল... এ তো আমার কথা হে। যতটুকু তোমার বেঁচে থাকতে লাগে, ততটুকু তুমি নাও। তার বেশি নেওয়া কিংবা প্রাপ্তির ইচ্ছাও অপরাধ। কোনও প্রাইভেট প্রপার্টি নয়, তোমার বেঁচে থাকার সমস্ত দায়িত্ব রাষ্ট্রের।

    –আজ্ঞে, স্যর, আমি ভগবান! আমারই লেখা। মাইরি বলছি ঝাঁপিনি।

    –সে তুমি না ঝাঁপতে পারো, কিন্তু তোমার বক্তব্য অত্যন্ত শাতির। এই বলছ কর্ম, ওই বলছ ভক্তি। তুমি ঝেঁপেটেপে এমন শুক্তুনি রেঁধেছ যে উচ্ছে আর রাঙালুর স্বাদ আর আলাদা করে চেনা যাচ্ছে না। অনুকরণ আর অনুসরণ বোঝা যাচ্ছে না! তোমার মতো লিবারালদের চেনা আছে।

    –স্যর, এটাই তো আধুনিকতা স্যর। এটাই ট্রেন্ড! এটাই এখন নতুন নিয়ম। বলা বাহুল্য, প্রাসঙ্গিক। ধূসরতার ফান্ডা যত, তত লেভারেজ স্যর।

    –অ্যাই অ্যাই ধরা পড়ে গেছ। নতুন, ফলে প্রাসঙ্গিক? তাহলে সবার আগে তুমি মরে গেছ। কারণ, তুমি একদমই নতুন নও। কী প্রাসঙ্গিক, কী নতুন, কী ট্রেন্ড– তা তুমি মোটেই বোঝোনি ভগবান! প্রাসঙ্গিকতা অত্যন্ত ব্যক্তিগত ইস্যু হে। যা তুমি খেঁাজো, তা সেই মুহূর্তে তোমার কাছে প্রাসঙ্গিক। তা নতুন হতেই হবে, কোনও দিব্যি দেওয়া নেই। বরং এই তুমি আর তোমার স্যাঙাতরাই তা ধর্তব্যের বাইরে রেখে চিরনতুন রাখার খেলা খেলতে থাকো। কিন্তু, তলায় তলায় প্রাসঙ্গিকতা হারিয়ে ফেলো, এবং অতি পুরনো হয়ে আবার রেট্রো-ফ্যাশন হয়ে ভক্তির নামে নিজেকে তুলে আনার চেষ্টা যে করো, অর্থাৎ প্রাসঙ্গিক হয়ে ওঠার চেষ্টা করো, সে তুমি ভাল করে জানো। এবং আমি তার চেয়েও ভাল করে জানি।

    –তাহলে মানছেন, আপনি আমাকে ভালমতো চেনেন। আর এদিকে দেখুন, আমিও আপনাকে কত চিনি! 

    যুগপৎ, মাথা ঠিক রাখতে না পেরে নিরীশ্বর বললেন– ওরে গর্দভ, তুমি এতটাই গাধা যে অন্য একটা গাধাকেও তুমি চিনতে পারো না, তুমি চিনবি আমাকে! 

    অতঃপর, সিমবায়োসিস আর ঘাপটি মেরে থাকতে পারল না। অলিঙ্গ-অযোনিময় এক কেলেঙ্কারি, দেখতে খানিকটা নারদ, যদিও ‘নারায়ণ নারায়ণ’ মাতন না দিয়ে কাঠের চাপাটি মেরে মন্ত্রের মতো উচ্চারণে বলে উঠল ‘খাওনদাওনজিওংপিওং খাওনদাওনজিওংপিওং অক্সি অক্সিং ফুসংফিনিস’! এবং হাজির।

    –হে চিরঝগড়ু, প্রাণনাথ, দীনবন্ধু... নিচের দিকে তাকান। ওই দেখুন। সিমবায়োটিক এফেক্ট এ কী বিষ ছড়িয়েছে বিশ্বে। সব কেমন গুলেমিশে যাচ্ছে, হায় হায়। এবং কী দুর্দিন, রতনে আর রতন চিনতে পারছে না!


     নিরীশ্বর ও ভগবানের দৃষ্টি ছুটে গেল কেলেঙ্কারির মাঝ বরাবর সিমবায়োটিক একঝাঁক কিউমুলোনিম্বাস ভেদ করে, মহাকাশপুষ্ট নধর কচি কচি আলোকরেখার সঙ্গে পাল্লা দিয়ে রতনের কাছে।

     রক্তদান শিবির থেকে রক্ত দিয়ে ফিরে ফান্টুসের সেলুনে অনেকক্ষণ লাইন দেওয়ার পর, শেষমেশ রতন বসতে পেয়েছে। বেচারার মন প্রচণ্ড খিট খেয়ে আছে। রক্তদান শিবিরে গিয়ে নাম লেখাল। রক্ত দিল। তারপর যখন রক্তদান জীবনদানকারী মহানুভবদের নাম উচ্চারণ করা শুরু হল, ওর নাম উচ্চারণ করল কিনা রটাউন দে! এহেন আমাগো রতন। রোমানে ‘Ratan’ লেখার হেতু যদি ‘রাতান’ ‘রাটান’ বিভিন্ন ডাক শুনে শেষত, Rawtown লিখে রক্তদান শিবির থেকেই নিজের নামের সঠিক উচ্চারণ ঘোষণার সাধ রেখেছিল। নাহ্‌, তা হল কই। তাকে ‘রাতান’, ‘রাটান’, মায় ‘রটাউন’ বলার জন্য যে বীভৎস রাগ হয়, এমন নয়, কিন্তু, সেটা যে ভ্রম, এই ভ্রম শোধরানোর একটা চাপ রতন বয়ে বেড়ায়। এমনকী তাকে ‘রতন রতন পায়রাগুলি ঝোঁটন বেঁধেছে’ গেয়ে অপমান করার চেষ্টা করা হয়েছে, ‘রটেনে রটেন চেনে’ বলে তাকে লাস্ট বেঞ্চে পাঠানো অবধি হয়েছে, তবু কই তার রাগ তো হয়নি। কিন্তু, সবকিছুর একটা লিমিট থাকে। শিবিরে আজ ঠিক হল না।

   গায়ে কাপড়টা বিছিয়ে ফান্টুস সবে জল ছেটাতে গিয়েছিল রতনের মাথায়, ওমনি রতন বলে উঠল– দ্যাখ ফান্টুস, কারও স্টাইল নয়, আমাকে যেন আমি দেখতে লাগে। আয়নায় দাঁড়িয়ে রতন যেন রতনকে চিনতে পারে। কোনও হিরোটিরোর স্টাইল নয়। 

   ততক্ষণে আয়নার সামনে সিমবায়োটিকা ভাইরাস তার কাজে লেগে পড়েছে। ফান্টুস শতসহস্রভাবে সামলানোর চেষ্টা করেও, আয়নার মুখ দেখে রতনকে মেলাতে পারল না।

   প্রায় আধঘণ্টা পর, চাদর সরিয়ে চুলের ধুলো উড়িয়ে রতন শেষমেশ চোখ খুলল যখন, রতনকে তখন দেখতে হয়ে গেছে অনেকটা আয়নার মতো। 

     ফলস্বরূপ রতন বুঝল যে, কোনও বানানই তাকে উদ্ধার করতে পারল না। এহেন রতনের তেহেন দুঃখটিকে অন্য কোনও রতনই চিনল না। আয়নার সামনে রতন দেখল, রতন নয়, যেন রতনের নেতা দাঁড়িয়ে আছেন। রতনকে সে শাসন করতে চয়, রতন চায় তাকে ভোট দিতে।

    রতন আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে নিজেকেই ভাষণ দিতে শুরু করল।

     –আপনি তো ভাষার ফ্লুইডিটির দোহাই দিয়ে ছেড়ে দেন না, তেমনই আপনাকে ভাষার প্রতি জাত্যভিমান আছে কি না জিজ্ঞেস করা হলে আপনি হিসাব কষে দেখেন। সারা দিনে আপনি বাংলা ছাড়া কিছুই শোনেন না, হিন্দি বা ইংরেজি শুনলে কানচাপা দিয়ে দেন– এমন নয়। এবং এটা কোনও জাত্যভিমান নয়, ফ্লুইডিটিওর দোহাই দিয়েও ঢাকাচাপার পরিসর এখানেই নেই। যার যেমন উচ্চারণ, যে ভাষার সে মানুষ, তাকে সেভাবেই উচ্চারণ করতে হবে। ভাষার কোনও সিম্বায়োসিস চলবে না, চলতে পারে না। এটা ভাষার জাতীয়তাবাদ নয়, চাপিয়ে দেওয়া নয়, এটা ভাষার রাজনীতি, এটা ভাষার জাত্যভিমান।


    এহেন আমাদের রতন এতকিছু বোঝে, তবু সে নিরীশ্বরের মহত্ত্ব নিয়ে, ভগবানের দোহাই দিয়ে, জটিলতার-কমপ্লেক্সিটির বকুনি ঝেড়ে পদে-পদ্মে ছাপ দিয়ে আসে। সে ভাবে ক্লোরেল্লা পুঁতে দিলে অক্সিজেন কনসেন্ট্রেটরের আর কী প্রয়োজন। সে ফেসবুকে পোস্ট দেয়, গাছ কাটার জন্যই আজ শ্বাস নাই। কিন্তু, পাশের বাড়ির আমগাছের আম শূদ্র পড়শি না দিলে, হুজ্জত করে শূদ্রের গাছ উচ্চবর্ণের ঘরে কেন গলা ফাটিয়ে গাছ কেটে ফ্যালে। হ্যাঁ, এমনটা হয় বইকি। গ্রীষ্মের দাবদাহে উচ্চবর্ণের বসন্ত খেলা জেগে ওঠে গঞ্জ-গভীরে।

   তারিয়ে তারিয়ে রতন আম খায়। আঁটি ছুড়ে ফ্যালে দুয়ারে দুয়ারে। হাজার বছর পরে, যুদ্ধ ও শান্তির সিমবায়োসিসে সমস্ত বিপ্লব যখন বিচ্ছিন্ন, যখন সমস্ত মানুষ ভ্যাকসিন-হেতু সিরিঞ্জ ফুটিয়ে ফুটিয়ে হাত করে ফেলেছে কালো– তখন আর সেই কালো হাত গুঁড়িয়ে দেওয়ার কেউ নেই। 

    কেবল পড়ে আছে কিছু শুদ্ধ শ্রমের কৃষক, আছে কিছু সাদা রক্তের পুরোহিত। এখনও তাদের চেনা যাচ্ছে। চলছে অভিশাপ অভিশাপ খেলা। পুরোহিত বলেছে– তোকে অভিশাপ দিলাম তোর চাষ শেষ। কৃষকের জবাব– তাই হোক, আমি বাগান করব। নিজেদের ফসল ফলাব। তুই-ই ভাত পাবিনে।

    অতঃপর, চূড়ান্ত সিমবায়োসিস নেমে এসেছে পৃথিবীতে। দুয়ার সংলগ্ন মাটি খুঁড়তে পাওয়া গিয়েছে আমের আঁটি। অমূল্য রতনের দাবি, ওটা বোম। যুদ্ধের সময় পড়ে গিয়েছিল, ফাটতে পারেনি।

    কৃষক বলতে চাইছেন– বটে, বোমই বটে। তবে তফাত এই, ফাটলে পরে অক্সিজেন বেরত! 

    কিন্তু বলতে পারছে না। কারণ, তার কাছে তখন আর কোনও ভাষা নেই। আত্মরক্ষার ভাষা ছাড়া

মন্তব্যসমূহ

জনপ্রিয় লেখা