ঋতুপর্ণা খাটুয়ার কবিতাগুচ্ছ | আঙ্গিক অনলাইন
দূরে চটকপুরে, এক আধবার
এক
চটকপুরের হোমস্টেতে শুয়ে আছি
আমার ’পরে ছায়া পড়ে পাহাড়ের—
হতভম্ব প্রায়, এছাড়া উপায়ই বা কী!
যেনতেন প্রকারেণঃ আমি ঘুমের নাটক
করে, কম্বলের কোণাটা আরেকটু জড়িয়ে
থাকি। রিজার্ভ ফরেস্টের ঝিঁঝি ডাকের
সাথে ঘুরতে থাকে পাহাড়ের পায়ের শব্দ।
শিশু মেঘ ইতস্তত ঘোরে
এলাচ রঙের আলো ভেঙে
টিনের চালে দেবদারু পাতার মতো বৃষ্টি নেমে আসে
দুই
এবড়ো খেবড়ো পাথর আর অনাবৃত মাটি—
সাঁই সাঁই সোজা পথে উঠে যাওয়ার পরিবর্তে
প্রচণ্ড শরীরী কসরত করে এলাম চটকপুরে—
রাস্তার পাশে জংলাফুলগুলি পিস প্যাগোডার
দ্রিমদ্রিম তালে গাইছিল। ওরা গান থামিয়ে
অপটু সন্দেহের চোখে আমায় জরিপ করে
আলোচনা করল নিজেদের মধ্যে। অমেয়
পাহাড়ে সমতলের কেউ এলে ওরা ভয় পায় —
তিন
এবারে সব ঠিক ছিল। ছকে রেখেছিলাম
নিজের গতিবিধি। তবে এসব ছকের ভেতর
টুং, সোনাদা, চটকপুর কেউই পড়ে না।
একটি শর্টকাট চড়াই বেয়ে ওরা প্রতিদিন
ওঠানামা করে। সবজি, তেল, চাল সকলকিছু
নিয়ে যায় এক আধবার। সকাল সন্ধ্যায়
হোমস্টের খামারে পোষা টার্কিরা ঝগড়া করে—
বোর্ডারদের জন্য হাঁড়িতে চাল ফোটে।
চড়চাপড়ে ফুলে ওঠে কিছু হাতরুটিও
আমি হোমস্টের বারান্দায় বসে থাকি
প্রায় ন্যাড়াগাছের মাথায় ঘাসের মতো পাতা
দেখে, অবাক হবার স্কোপ থাকলেও হই না।
বাড়িতে ভিডিওকল করে পাহাড়ের শোভা
পাঠিয়ে দেয় একাকী যুবক—
এমতাবস্থায়, মোটাসোটা কুকুরটা গা ঘেঁষে আসে।
দূরে পাইনবন নির্বিকার। বড়ো নির্বিকার। ওখানে
কালো আরও গাঢ় হয়। পোষা টার্কির
মাংস জম্পেশ হতে পারে, এই সুস্বাদু চিন্তায়
লকলকিয়ে ওঠে জিভ। সুড়ুৎ করে ঘন জঙ্গলের
এলোমেলো বাঁশপাতার আওয়াজ টেনে নেয় কান।
বারান্দার ’পরে ঘাসের ভেতর সাদা ও গোলাপি
ফুলগুলোকে খুবই সুন্দর মনে হয়। এমন এলোমেলো
সাজলে কতকিছুই ভালো লাগতে পারত, এসব ভেবে
মন চেয়ে থাকে দূরে— দুর্বোধ্য নীলে — বুদ্ধির
ওপারে যদি অপার সৌন্দর্য থাকে,
আলুথালু চোখে চেয়ে থাকা যায় একটা দুটো
দিন। চোখের অন্ধকার নামা ইস্তক—
চার
গাঢ় সবুজ পাহাড়ী বন ভেসে যাচ্ছে সাদা সোলানাম ফুলের আলোয়।
কোনও এক মেহফিল বসেছে, তা বোঝা যাচ্ছেই—
আমি অনাহূত এক অতিথি, নিজের ডেনিম ব্যাগ
পিঠে চাপিয়ে চলছি।
পাইনবন! পাইনবন!
শ্যাওলা কাঠের নৌকা নেমেছে সদ্য—
দিকভ্রষ্ট মাঝি লুকিয়েছে কোন মসগাছের আড়ালে।
পোক্ত নাবিক এসে কাঠ ঠুকে জরিপ করে—
লোহার জাহাজে কাঠের ডেক। মদ্যপান তারি ’পরে!
সালশাতে তরুণীর কোমরে ঠেকে যায় যুবকের হাত—
পাইনবন! পাইনবন!
সাদা সোলানাম ফুলের মালা পরে
দাঁড়িয়ে আছি আমি। প্রস্তুত।
এবার হেঁটে উঠে যাব আলেয়া ছড়িয়ে —
আমার সাথে তোমাদের যোগাযোগের উপায় নেই
পাঁচ
দশটা ফুলগাছ লাগিয়েছি বলে,
একটি সাদাফুল ছিঁড়ে নেওয়ার
অধিকার আমার নেই। তাই
জড়ো হওয়া এযাবৎকালের পাপ
এখানে, এই রিজার্ভ ফরেস্টের
পাইনবনে রেখে আমি চললাম
সমতলে। আমার সাথে চলল
ধর্মের কুকুর সঙ্গীর মতো এক সহজ
ও সদ্যসঙ্গী — নবনির্মিত পাপবোধ
ছয়
আমার ভেতর উঁকিঝুঁকি দেয়
আসুরিক সত্তা, আধা শ্যাওলা-কালো বনের
ফাঁকে
ফাঁকে
যেভাবে আলো আসে আর যায়।
সাত
মেঘের দেশে কার ডাকে এসেছি, কে জানে!
তবু এলাম, আমি ফার্দিনান্দ ম্যাগেলান, কোনও নবতর দ্বীপে।
হয়তো এটাই ছিল হাতের রেখা-ম্যাপে—
ঠান্ডা বিয়ার গ্লাসের বাইরে গড়িয়ে পড়া জল হয়ে
পাহাড়ের কঠিন কোমর জড়িয়ে নেমে
আসছি, অন্ধকার গুহার দিকে
জন্মস্থলের অভিমুখে —
আরও কিছু আবিষ্কার বাকি
আট
গাড়ি এখন চা বাগানের সবুজ পথ ধরেছে।
কার্শিয়াঙের রাস্তায় মেঘও চলছে।
কত
উচ্চতা
থেকে
মেঘ আমায় দেখছে! আমি মেঘকে দেখছি।
ভাইয়ার হাতের স্টিয়ারিং বনবন করে ঘুরছে।
আমরা সকলে ঘুরে মরছি, একে অপরকে
দেখতে দেখতে বুঝতে বুঝতে ফেরার বয়স হচ্ছে।
নয়
পতপত শব্দে বৌদ্ধ মন্ত্র ছড়িয়ে পড়ছে পাহাড়ে।
চারপাশ ঠান্ডা। সবাই শান্ত। হাত রেখেছি গাড়ির কাঁচে—
একটি সাদা ক্যামোলাইন ফুলের আংটি।
যেন সদ্য বিয়ে করে ফিরছি !
যেন জংলা জীবনে থেকে যাওয়াও যেত!
যেন আপাতত একটি বন্ধন রেখে এলাম!
দশ
কার্শিয়াং থেকে নেমে শুকনা ফরেস্টের
মেদবহুল রাস্তায় গাড়ি চলছে। চলছেই।
চা বাগান সমতা মেপে দাঁড়িয়ে—
উষ্ণতা বাড়ছে—
রোদ পুড়ে কালো মেঘ
ও মেঘের হাত নেই পা নেই
শুধু খবরের মতো উড়ছে
কান পাতলে শোনা যায় ফৌজের বুটের গান
মন্তব্যসমূহ