পারলে নিজেকেও ছেড়ে চলে যেতাম | হ্যালসির কবিতা | অনুবাদ: হিয়া মুখোপাধ্যায় | আঙ্গিক


অ্যাশলি নিকোলেট ফ্র‍্যাঙ্গিপেন ওরফে হ্যালসি মার্কিন সংগীত জগতের এক সম্ভাবনাময় নক্ষত্রের নাম। ১৯৯৪ সালে জন্মানো এই তরুণ গায়িকা ও গীতিকার মাত্র তিনটি অ্যালবাম প্রকাশের মাধ্যমেই ইতিমধ্যে জনপ্রিয়তার শীর্ষে পৌঁছেছেন। 'কালার', 'গ্যাসোলিন', 'ক্লোজার' অথবা 'উইদাউট মি'র মতো গানের জন্য তিনি একাধিকবার মিউজিক বিলবোর্ডে প্রথম স্থান নিয়েছেন। ২০২০ সালে হ্যালসি 'আই উড লিভ মি ইফ আই কুড' নামে তার নিজের প্রথম কাব্যগ্রন্থ প্রকাশ করেন। অনূদিত সবকটি কবিতাই সেই কাব্যগ্রন্থের অংশ। গান ও কবিতা ছাড়াও হ্যালসি আত্মহত্যা প্রতিরোধ, মহিলাদের বিরূদ্ধে ঘটে চলা যৌন নির্যাতন ও জাতিবিদ্বেষবিরোধী রাজনীতির মতো বিভিন্ন প্রগতিশীল সামাজিক আন্দোলনে নিয়মিত অগ্রণী ভূমিকা গ্রহণ করেন। কবিতাগুলি অনুবাদ করেছেন হিয়া মুখোপাধ্যায়



সুড়ঙ্গ
সম্ভবত আপনাকে ততটাও চিনি না।
কিন্তু জানি আপনার গন্ধ অনেকটা
পুরোনোর দেওয়ালের গায়ে বেড়ে ওঠা
অনিন্দ্য ভিজে ঘাসেদের মতো।
আর জানি হাতার ফাঁক দিয়ে বের হয়ে আসা
আপনার দু-হাতের তালু
কত অসহ্যরকমের ভালো
আর জানি হাওয়ায় বিপদসংকেত বেজে উঠলেই
আপনার মাথার ঠিক পিছনে
শ্যাওলাটে আর ভীষণ নিরাপদ
একটা সুড়ঙ্গ জেগে ওঠে
আর এটুকু জানি যে আপনার কাঁধের দুই খাঁজে
আমার গালদুটো ঠিক মাপে মাপে এঁটে যাবে
আর চেনার বলতে এতটাই, স্রেফ এতটাই।


পোকা
আমি বিশ্বাস করতাম 'মিউজ' শব্দটার অর্থ আমি বুঝি,
কিন্তু ওর সাথে আলাপের আগে।
অনুপ্রেরণা তো এর আগেও!
অনুসন্ধিৎসাও তো কত!
কিন্তু ঘুণাক্ষরেও 'মিউজ' কাকে বলে বুঝিনি
যতক্ষণ না ও ওর গোলাপি ঠোঁটদুটো
আমার ঘাড়ের বিপজ্জনক কাছে নিয়ে আসে
আর আমার কানের ফুটোয়
অজস্র কিলবিলে পোকা ঢেলে দেয়।

আহা ওরা বেঁচেবর্তে থাক।
শরীর বেয়ে বেয়ে ওরা পৌছে যাক
আমার মস্তিষ্কের নরমতম কোষে।
ঘর বাঁধুক।
বংশবিস্তারও।
আর সংখ্যায় বাড়তে বাড়তে
একদিন সরাসরি আমার আত্মায় কামড় বসাক
যতক্ষণ না ওর স্মৃতিগুলো
দগদগে ঘায়ের মত ফুটে উঠে
আমার অসহ্য নিরাপত্তাহীনতায়
পচন ধরিয়ে দেয়।

আমি মুখ খুলতেই
টাইমস নিউ রোমানে লেখা অজস্র অক্ষর
একরাশ পতঙ্গের মত উড়ে বেরিয়ে এলো
আর সামান্য একটা নোটবুকের
ছাপানো রেখাগুলো
আমার কবজি মুচড়িয়ে
নৃশংস কোনো দস্যুর মতই,
৪৮ ঘণ্টা বন্দি করে রাখলো আমায়।

ও তখন চামড়ায় সটান চাবুক চালিয়ে
আমার মাংস মজ্জা আর সবটুকু খুলে ফেলেছে,
আর আমার ভিতরের অসম্ভব লাল
তখন মিশ খেয়ে যাচ্ছে
বিদ্রুপের মত ওই অসহ্য লাল মার্জিনে।
গলা আর বুকের ওই বেগুনি কালশিটে
তবু সহনীয়
কিন্তু ওকে এই রূপে সহ্য করা অসম্ভব!
বস্তুত আমি ভয় পাচ্ছিলাম।
আতঙ্কে শিউড়ে উঠছিলাম।
কেননা ও আমায় লিখতে বাধ্য করছিলো।
আর আমি এই নিরুপম নৈরাজ্যের জন্য
প্রস্তুত ছিলাম না মোটেই।

মিউজ এর প্রকৃত অর্থ
একটা পরজীবী পোকা।
একটা মিথোজীবী অস্তিত্ব।
মিউজ, প্রকৃত প্রস্তাবে,
একটা ক্ষুধার্ত সত্ত্বাকে নিজস্ব চিৎকার থেকে
মুখে গ্রাস তুলে দেওয়া।


আমি লেখক হতে চাই!
আদতে ইচ্ছে নয়।
আদতে প্রার্থনাও নয়।
বিষয়টা সোজাসাপ্টা।
আদতে বিছানার নিচে একটা রাক্ষস
ঘুমন্ত অবস্থায় গোড়ালি কামড়ে
তোমাকে টেনে নিয়ে যাওয়ার সুযোগ খুঁজছে।
কানের খুব কাছে ভনভনে একটা মশা
তোমার চোখের কোটরে
ডিম পারার জন্য অপেক্ষা করছে।
আদতে যুগের পর যুগ
নিজেরই বিষ্ঠায় মাখামাখি হয়ে
কলঘরের দিকে নিষ্পলক তাকিয়ে
তুমি একাই মিনিটগুলোকে ঘন্টায় বদলে যেতে দেখছো।
আর ছমাস হয়ে গ্যালো তুমি বাবার সাথে কথা বলোনি
আর ছমাস হয়ে গ্যালো, অবাধ্য বাচ্চার মতো 
প্রেমিকের কাছে তুমি ঘ্যানঘ্যান করে চলেছো-
রূপোর বাসনের মত চেটে বা চুষে
তোমাকেও ঝাঁ চকচকে করে ফেলা হোক।
‘এই একটা পৃষ্ঠায় আমি আমার সর্বস্ব ঢেলে দিয়েছি!
দোহাই আপনাদের, বলুন আমি অতটাও অপদার্থ নই!’

আদতে ইচ্ছে নয়।
আদতে চোয়াল শক্ত করে
শিঁড়দাঁড়ায় অসহ্য টান নিয়ে
বিশ্বসংসারের মুখে থুতু ছুঁড়ে দেওয়ার বিবশ প্রবণতা,
আদতে বিশ্বাস করা যে এই অসভ্য পৃথিবী
তোমার অক্ষরগুলোর যোগ্য নয়
আর তুমিও এই অসভ্য পৃথিবীর জন্য
যোগ্য নও আদৌ।
আদতে আকাশচুম্বী একটা অহঙ্কার যা চিৎকার করে বলছে-
‘আমার স্তবকগুলো এমন এক অস্তিত্বর ভিতর উন্মুক্ত হোক, 
যেখানে ইশক আর ইবাদত মিলেমিশে এক হয়ে যায়।’
আদতে অসহনীয় এক আত্মঘৃণা
যা তোমাকে নিজেই নিজের ঠোঁটে
কামড় বসাতে বাধ্য করছে।
আর তোমার শরীর থেকে প্রতিটা অন্ত্র
ছিটকে বেরিয়ে আসতে চাইছে
আর কাঁধ ক্রমেই ন্যুব্জ হয়ে পড়ছে
আর ক্রমেই তুমি নিজের দৃষ্টিকে অবিশ্বাস করছো।

তোমরা যখন ডুকরে ওঠো
'অথচ আমি তো লেখক হয়ে উঠতে চাই!’
আমার অন্তরাত্মা কেঁপে ওঠে।

আদতে তুমি চাইছো তোমার মাথায়
পয়েন্ট ব্ল্যাঙ্ক রেঞ্জে গুলি ছোঁড়া হোক।
আদতে তুমি জানোই না তুমি কী চাইছো।
তুমি চাইছো রক্তে ছটফটানো ঘিলু
আর বালিশে মাখামাখি হয়ে যাওয়া হত্যাচিহ্ন।
তুমি চাইছো তোমার সুষুম্নাকাণ্ড আর তরুণাস্থিসমূহ
একদলা জেলিতে বদলে যাক।
তুমি চাইছো অনুকম্পা যা ফেরতযোগ্য নয়।
আদতে তুমি ব্যর্থ প্রেমে পুড়ে যেতে চাইছো।

বিষয়টা সোজাসাপ্টা।
স্রেফ লিখে যাওয়া।


থাম্বলিনার রূপকথা
আমি কৃতজ্ঞ কারণ
তোমার কণ্ঠস্বর থেকে পিয়ানোর ৮৮টা বোতাম
ঝনঝনিয়ে সটান আমার কানে ঢুকে পড়েছে।
আমি কৃতজ্ঞ কারণ
যখন তুমি কোলে শুয়ে থাকো
চকোলেটের মত গাঢ়, শষ্যের মত অন্তরঙ্গ
তোমার একগুচ্ছ চুল
আমার আঙুল ছুঁয়ে যায়।
আমি কৃতজ্ঞ তোমার শিথিল ও অংশত ফাঁক করে রাখা
গোলাপি ঠোঁটদুটোর জন্য,
কৃতজ্ঞ তোমার রক্তাভ গাল,
সবুজ চোখ
রোদে ঝলসে যাওয়া নাক
বাদামের মতো ছিটছিটে ছুলির দাগ
আর চামড়ার নীচে নীলাভ-বেগুনি ওই শিরা উপশিরা;
রেনেসাঁর চিত্রে আঁকা দেবদূত শরীরের যেটুকু যা রং-
সেই সবটুকুর জন্য।
আমি চোখ বুজে কল্পনা করছি
এ মুহূর্তে তোমার দীঘল ও নরম চোখের পাতা
আমার সর্বাঙ্গ ছুঁয়ে দিচ্ছে।
আমি কল্পনা করছি ক্ষুদ্রাতিক্ষুদ্র একটা শরীর নিয়ে
চোখের পাতাগুলোকে চাঁদোয়ার মত টাঙিয়ে
আমি ঘুমিয়ে পড়ছি।
তোমার চোখের সাদায় অনায়াস ডুবসাঁতার আমি কল্পনা করছি।
ঠোঁটের ধনুক থেকে অনন্ত ঝাঁপ কল্পনা করছি।
হাসির উপপ্রান্ত থেকে 
পিটার প্যান আর সেই অলীক ঘড়িঘরের মত
দুই হাতে ঝুলে থাকতে চাইছি।
বাদামি ছুলির দাগে পা ডুবিয়ে
যথেচ্ছ হুটোপাটি করে নাচতে চাইছি অবিরাম।
হাঁটু গেড়ে কানের গভীরে ঢুকে পড়তে চাইছি
আর সমুদ্রের ডাক শুনতে শুনতে
সমুদ্রের ভাষায় ফিসফিস করতে করতে
লুকিয়ে থাকতে চাইছি আজীবন।

আমি কৃতজ্ঞ কারণ
শুধুমাত্র তোমার মুখ পৃথিবীর সবটুকু উচ্ছ্বাস
অভ্রান্তভাবে আমার বিছানায়,
অভ্রান্তভাবে আমার তালুতে,
বুকের ভিতরে এক অব্যর্থ ঢেউয়ের মতো,
অভ্রান্তভাবে আমার নিশ্বাসে
বয়ে এনেছে।

আয়না
কিম্ভূত অঙ্গভঙ্গী করে
আয়নার কাচ মুছে
আরো স্পষ্ট দেখতে চাইছি
নিজেকে।
নিজের শরীরে
নিরাপদ বোধ করার
চেষ্টা করছি অবিরাম।
বস্তুত আমার শরীরটাকে
নিজের মনে হচ্ছে না।
আয়নার আমিকে দেখছি।
খুব সম্ভবত
আমার ভয় করছে।

মন্তব্যসমূহ

জনপ্রিয় লেখা