সমাজের চোখ আর আমাদের মেয়েরা | সাম্য | আঙ্গিক পত্রিকা

ফাঁদে পড়া পতঙ্গ খাবার উপযোগী না হলে মাকড়সা জাল কেটে তাকে ছাড়িয়ে দেয়। মানুষ যতদিন প্রকৃতির অনুগামী ছিল তারাও সেটাই করত। প্রকৃতির যখন সে শাসক হয়ে উঠতে চাইল, তখন সে বন্য প্রাণীদের বশে আনা শিখল। মানুষ সভ্য হয়ে উঠল। অন্তরের আদিম অসভ্যতা রয়ে গেল। ছল করে, ফাঁদ পেতে, অস্ত্র সাজিয়ে বাঘ শিকার করে যে আনন্দ, বুনো হাতিকে পোষ মানিয়ে যে আনন্দ, ধর্ষণ করেও বোধহয় সে আনন্দ মেলে। মেয়েটির (ক্ষেত্রবিশেষে পুরুষের) অসহায় চিৎকারের মাত্রা যত তীব্র হবে, যত সে নিষ্ফল ছোটাছুটি করবে, যত জোরে সে হাত-পা ছুড়বে তাকে তাড়িয়ে বেড়ানোর, বশে আনার তত আনন্দ। দেহের উপর কর্তৃত্ব স্থাপন করেই ধর্ষক পুরুষটি (ক্ষেত্রবিশেষে নারী) তৃপ্তি পায় (যেহেতু ভারতীয় আইনে পুরুষের ধর্ষণ হয় না আর নারী মাত্রেই প্যাসিভ সার্ভিস প্রোভাইডার, ধর্ষণের মতন একটা অ্যাক্টিভ ব্যাপার স‍্যাপারে তারা থাকতেই পারে না তাই তাদের ব্র‍্যাকেটের মধ‍্যেই রাখা হল, যতদিন না তারা সমতা লাভ করে ব্র্যাকেটের বাইরে বেরোনোর অধিকার অর্জন করে)। নিজের হতাশা, প্রতিদিনের হেরে যাওয়া থেকে মুক্ত হয়ে সে হঠাৎ বিজয়ী হয়ে ওঠে। ধর্ষক ছেলেটিকে, ভবিষ্যতের গর্ভে থাকা সমস্ত ধর্ষককে পিতারা শেখাননি প্রিয় নারীকে ছুঁলে, ছুঁয়ো এমনভাবে সে ছোঁয়া যেন তার হৃদয় জুড়ে থাকে জীবনের শেষ দিন পর্যন্ত। 

পাশাপাশি হাত ধরে চলা ভোগবাদী, ধনতান্ত্রিক, পিতৃতান্ত্রিক সমাজে শিশুর চোখ তৈরি হচ্ছে প্রতিনিয়ত মানবীকে তাঁর বুদ্ধিমত্তা, তাঁর শিল্পসত্ত্বা, সংবেদনশীলতা, ব্যক্তিত্ব বাদ দিয়ে স্রেফ দেহাংশের সমষ্টি হিসেবে, বিনোদনের বস্তু হিসেবে দেখায়। ঘটা করে পালন করা উওমেন্স ডে গোলাপি বেলুন সাজিয়ে, প্লাস্টিক সার্জারি ক্লিনিকে ওই দিনটিতে স্তন সুডৌল করবার বিশেষ ছাড় বলে দেয় আসলে হচ্ছে না কিছুই। শুধু ভাষা পাল্টাচ্ছে, পাল্টাচ্ছে না সমাজের চোখ। ফিনল্যান্ড দেশটা বোধহয় এ পৃথিবীর বাইরে কোনো কাল্পনিক দেশ, যেখানে প্রাইমারি স্কুলে ছেলেদের শেখানো হচ্ছে পুতুল খেলা, সেলাই করা, উল বোনা আর মেয়েদের শেখানো হচ্ছে খালি পায়ে বরফের উপর হাঁটা, লাফানো, দৌড়ানো। লিঙ্গ সাম‍্যের দিকে এগোতে হলে নাড়া দিতে হবে যে গোড়াতেই। কিন্তু ধর্ষণ! সে কি থামবে? ফিনল্যান্ডে থামতে পারে। আমার দেশে? তখন ওই ব্র্যাকেটে থাকা মানুষগুলো বাইরে বেরিয়ে এসে পাল্লায় ভারী হবে না তো?

বর্ষবরণের রাতে রাজধানী দিল্লিতে ঘটে যাওয়া মর্মান্তিক দুর্ঘটনা আর তার পরবর্তী চাপান উতোর, দোষারোপ, পাল্টা দোষারোপ অভিযুক্তদের আড়াল করার চেষ্টার সঙ্গে সমান্তরাল ভাবে চলতে থাকে, যে চলে গেছে সেই মেয়েটির পরিচয়, ছবি প্রকাশ, চরিত্র বিশ্লেষণ। মেয়েটি মদ খেয়েছিল কিনা, কোথায় কোথায় গিয়েছিল, কার সঙ্গে গিয়েছিল সে সবকিছু জানা এবং সংবাদ মাধ্যমে প্রকাশ করে দেওয়া জরুরি হয়ে পড়ে। আড়ালে থেকে যায় মুখ ঢাকা অভিযুক্তরা। সংবাদ মাধ্যমের মাধ‍্যমে মেয়েটির আত্মীয়, পড়শি, সরু গলি, পাড়া পৌঁছে যায় কাশ্মীর থেকে কন‍্যাকুমারী। অপরাধীদের আত্মীয় পরিজন, তাদের সামাজিক স্থান, প্রতিপত্তি, তাদের বেড়ে ওঠা কোনও প্রশ্ন চিহ্নের মুখে পড়ে না। এক মানবীর দেহ গাড়ির তলায় ঘষটে নিয়ে গেলে চরিত্রে আঁচ পড়ে সেই নগ্নিকার, যে হাতগুলি একা মেয়েকে ছোঁ করে তুলে নেয় সেই নগ্নকারীদের নয়।কোথায় যেন আমরা মিল পাই সাম্প্রতিক ইতিহাসে এ রাজ্যের হাঁসখালি তে ঘটে যাওয়া ঘটনাটির সঙ্গে। নদিয়ার একটি অজ গ্রাম সমস্ত সংবাদমাধ্যমে জায়গা করে নিয়েছিল সেসময়ে। সংবাদ মাধ্যমে মেয়েটির চরিত্র নিয়ে কিছু তত্ত্বকথা সে সময়ও শোনা গিয়েছিল। হাঁসখালিতে ধর্ষণ হয়েছিল যার সে একটি মেয়ে ছিল। তাকে বাড়িতে পৌঁছাতে এসে বাড়ি ঘর পুড়িয়ে দেবার হুমকি দিয়েছিলেন যিনি তিনি একজন মহিলা এবং ভয় পেয়ে চুপ করে যিনি থাকলেন তিনিও একজন মহিলা। প্রকাশ‍্য মঞ্চে তত্ত্বকথা যিনি শুনিয়েছিলেন তিনিও। কিন্তু শাসক এবং শাসিতের মাঝে যা থাকে সে শুধু ক্ষমতার প্রবাহ। লিঙ্গ সাপেক্ষে একাত্ম হওয়ার বোধ সেখানে কাজ করে না। বাড়ি ঘর পোড়ানোর হুমকিকে যে লঘু ভাবে নেওয়া যায় না গ্রামে-গঞ্জে সেটা আমরা সাম্প্রতিক অভিজ্ঞতা থেকে জানি। তাই নিজেরাই দেহ পুড়িয়ে দেওয়া, বিষয়টাকে চেপে যাওয়া কোন ভয় থেকে সেটা আমরা জানি। পুলিশ প্রশাসন কোন সুতোয় বাঁধা সেটাও আমরা জানি। তাই ঘটনাকে নিজেদের ভবিতব্য মেনে চুপ করে থাকার অসহায়তা সহজেই চেনা যায়।

যে চলে গেছে তার প্রতি ভালোবাসা (আদৌ যদি থেকে থাকে) কোনও রাগের জন্ম দেয় না বরং যারা রইলেন তাদের জীবন, সম্পদের ভয় প্রকট হয়ে দেখা দেয়। তাই পরিবারের প্রতিক্রিয়ায় অবাক লাগে না। মস্তিষ্কের ভেতরে হাতুড়ি মারে মায়ের লজ্জা। যোনি থেকে রক্ত বেরানোর অর্থ তিনি বোঝেন। মেয়ে রক্তে ভেসে গেলেও মা মেয়ের বাবাকে, নিজের বরকে জানাতে পারেননি, লজ্জায়। যোনি মেয়েদের লজ্জা। তার পবিত্রতা রক্ষার দায় যার যোনি তার। পবিত্রতা চলে গেলে মান যায় তার, তার পরিবারের। এই শিক্ষাই দেয় পিতৃতন্ত্র। অন্যায়ের প্রতিকারের দাবি নিয়ে হাজির হওয়ার শিক্ষা বা সাহস পিতৃতন্ত্র জোগায় না। প্রতি প্রশ্ন করতে শেখায় না, আমার যোনি আমার, সমাজের নয়। পরিবারের মান যোনিতে বহন করবার দায় আমি কেন নেব? কিন্তু হায়! আমার মা এমন করে ভাবতে শেখেননি। তিনি শিখেছেন মেয়েদের সহ্য করতে হয়। মেয়ে হলে ব্যথায় কাতর হওয়া যায়, ব্যথার কারণ নির্মূল করার জন্য হাসপাতালে যাবার প্রয়োজন নেই। শরীরের যন্ত্রণা মেয়েদের সহ্য করতে হয়। মেয়েদের শরীরকে, শরীরের সমস্যাকে গুরুত্ব দিতে নেই। এটাই নিয়ম।

শরীরের ক্ষত শুকানোর পরও যে স্নায়বিক, রাসায়নিক পথ বেয়ে ধর্ষণ আঘাত হেনেছিল তার অভিঘাত মানুষটির চেতনাকে, সত্ত্বাকে কতটা, কতদিন ধরে দংশন করে চলে বেঁচে থাকলে তা কোনও পরিসংখ্যানে ধরা পড়ে না। নিজের রক্তের মধ্যে শুয়ে শুয়ে আমার মেয়ের কী অনুভুতি হচ্ছিল। আমার চতুর্দশী কিশোরী - হয়তো তার জীবনে এসেছিল প্রথম প্রেমের রোমাঞ্চ। কিংবা আসেনি। হয়তো সেই ভালোবাসার ডাকে সাড়া দিতে গিয়েছিল সে। কিংবা যায়নি। অনেক তত্ত্বের মত হয়তো এ-ও একটি তত্ত্ব। টেলিভিশন চ্যানেলে যাকে দেখা গিয়েছিল তাকে চতুর্দশীর প্রেম বলে ভাবতে কষ্ট হয়। প্রেম হলেও কি তা ভাগ করে নেওয়া যায় অন্য অনেকের সঙ্গে! প্রবঞ্চনা! না ঘৃণা? তার কি রাগ হয়েছিল এক মুহূর্তের জন্যেও? শরীরের সবচেয়ে নরম জায়গাটায় ক্ষত নিয়ে, যন্ত্রণা নিয়ে সে যখন বাড়ি ফিরছিল - বাড়ি - ভালোবাসা, যত্ন, নিরাপত্তার আশ্রয় - সে কি একবারও ভেবেছিল পরের দিনটা তার আর দেখা হবে না। একটা সকাল তার জীবনে আর কখনও আসবে না। "লজ্জায়, ভয়ে ওর বাবাকেও বলতে পারিনি। রক্তে বিছানা ভিজে যাচ্ছিল। মেয়ে যখন আর যন্ত্রণা সহ‍্য করতে পারছে না, তখন ভোরের দিকে আমি গ্ৰামের এক হাতুড়ে ডাক্তারের কাছে গিয়ে পেটে ব্যাথার ওষুধ নিই। ফিরে এসে দেখি মেয়ে মারা গিয়েছে।" ফিরে এসে দেখি মেয়ে মারা গিয়েছে!  যন্ত্রণায়, নিজের রক্তের স্রোতে অচৈতন্য হওয়ার সময় কোন কষ্টটা তার বুকে বেজেছিল বেশি? অভিমান হয়েছিল কি তার মায়ের উদাসীনতায়? ভেবেছিল কি তাকে আশ্রয় দেওয়া মানুষগুলো একটু তৎপর হলে সে এমন জ্ঞান হারাত না? সে কি চিনতে পেরেছিল মৃত্যুকে? আর এক মেয়ে, সে কি টের পেয়েছিল যমদূতেরা এখন আসে বোলেরোতে? অন্তিম সময়ে বুঝেছিল কি সে নতুন বছরটা তার জীবনে আসবে না আর কখনও, বাড়িতে কচি মুখ দুটোর কাছে ফেরা হবে না আর কোনও দিন?

আমাদের মেয়েরা আজ ছাই হয়ে গেছে। ছাই হয়ে উড়ে গেছে তারা। রেখে গিয়েছে জরুরি প্রশ্নগুলোকে। আমরা কি শেখাতে পেরেছি আমাদের মেয়েদেরকে ভাবতে, আমার যোনি আমার, তাতে অধিকার শুধু আমার। শরীরটা আমার খেলনা নয়, আমারও আছে চিকিৎসার অধিকার। আমার শ্রম দেখতে পাও না তাও আমার আছে সম্পত্তির অধিকার। আমরা কি পেরেছি তাকে শেখাতে প্রতিকারের দাবি জানাতে? রাগ করতে? রাগে জ্বলে উঠতে? আমরা কি পারছি আমাদের ছেলেদের শেখাতে 'পুরুষ মানুষ' থেকে পুরুষ খসিয়ে আগে মানুষ হতে? আমাদের মেয়েদের কারওর একটা রিনরিনে স্বরও যদি কোথাও ওঠে আর আমাদের ছেলেরা তাতে গলা না মেলায়, কলম যদি আমাদের চুপ মেরে যায়, তুলি যদি রং দেখে থমকায় তাহলে পরিচয় যেন হয় অমেরুদণ্ডী শ্রেণির জগতে, মান হুঁশ সম্বলিত জীব শ্রেষ্ঠ হিসেবে নয়। 

(লেখক - সাম্য। মতামত লেখকের ব্যক্তিগত)

মন্তব্যসমূহ

জনপ্রিয় লেখা