পুনর্বার কবিতাগুচ্ছ | সংযুক্তা বন্দ্যোপাধ্যায় | আঙ্গিক


পুনর্বার কবিতাগুচ্ছ/ সংযুক্তা বন্দ্যোপাধ্যায়

অথচ উদ্যান আজ শোভমান ফুলে
দ্যাখো,
 ওগো ভিখারিণী-প্রাণ, সে-গত নিশীথে
খেলা করেছিল মেঘে কবেকার জিভের বিদ্যুৎ
আর তুমি ভীত
খাঁচা খুলে পাখিদের পাঠিয়েছ পরদিনের সকাল-সমীপে

নষ্ট ডিম, খড়কুটো সরিয়ে ঝরিয়ে
ভাঙা বাসাগুলিদেরও সাজালে উদ্যানে
কিছু কি দুরাশা ছিল,
 ছিল নাকি স্বপ্নযোগে উন্মাদের হাসি
ওগো তুমি বাগানবিলাসী,
এক-পা দু-পা ফেলে চলে এলে
মেঘে কার দ্রংষ্টা চমকালো কু-স্বপ্নে তোমার
চোরকাঁটা কাপড়ে আর অতিশয় তৃণাঙ্কুর পায়ে লেগে আছে
তবু এসে বসেছ আবার পথে ও পথের প্রান্তে
দুই চোখে,
 মাথার ভেতর জেগে রইল বিদ্যুতের ফলা

ভয়সকল মোচন করেছে আজ তোমার উদ্যান
শাদা দন্তরুচি,
 তাকে বর্ণে লিখে দিও
ওই, ওই কষ বেয়ে গড়িয়েছে ধারা

দ্যাখো, পাগলিনী, আজ সেজেছে উদ্যান ফুলে
রক্তমুখী যেমতি তুমিও


আশা, সেও বাকি নেই আর
এখন গঙ্গার মাস, ছলোচ্ছল জল
হা গোড়ালি ভিজে যাচ্ছে, জলে ওই ভেসে যাচ্ছে শব
পূতিগন্ধময়ী ডোম্বী, চণ্ডালিকা
হা আমার ভয়ের ধিক্কার

ধিক্কার, ধিক্কার লেখা পথে পথে
পথিমধ্যে এ কী জলস্রোত
কী হল, কাহার হল এ-প্রকার প্রশ্নযোগে
বায়ুভূত ঘূর্ণ্যমান রথ উড়ে যায়

কী উড়েছে, দাঁড়াও দাঁড়াও
আগে দেখতে দাও ওই সর্বস্বটি কার
পরে ভাঙি ঘট

অস্থি শেষ, নাভি শেষ
হা আশার মর্মখানি
রেখেছি ব্যাদানে


কী বা রঙ্গময়ী রাত
কী রঙ্গে লেখাটি রাখি মৃত্যুর শরীরে
পা-দুটি পাতার আড়ে
পক্ষীভ্রমে ছুটে আসছে তীর
দ্যাখো আজ ভেসে যাচ্ছে কুলমান
দুই কুলের মাথা খেয়ে
রাস্তায় নেমেছি নারীগণ

ধরে বেঁধে আনো নারীগণে
জ্বালো দেখি রঙ্গমঞ্চখানি
ভাঙা মঞ্চে ধুলোট উৎসব
মেয়েলোক ফুর্তির পরান

ফূর্তিভরা বিধবা-শরীর
পথিপার্শ্বে সার দিয়ে দাঁড়ানো
মাথার ওপর খোলা রাত
ফোঁটা ফোঁটা রঙ্গ ঝরে পড়ে

রাত্রিমুখে জন্ম লেখো, নাম
নিচে নামো যতদূর বয়ে যাচ্ছে জল
জলের উৎসব আজ রাস্তায় রাস্তায়
ছড়িয়ে গিয়েছে রঙ্গ দিকে দিকে
লেখার পাতায়

লেখো রঙ্গ, জন্ম জলে যায়
শায়িত মৃত্যুর মাথা
উঠে আসছে ক্ষেত্র ভেদ করে
কী রঙ্গে কেটেছে রাত
কী বা রঙ্গে মৃত্যুর শরীরে
জেগে উঠছে জন্ম পুনর্বার


পান ও জরদার গন্ধে মনোমুগ্ধকর এ-সন্ধ্যায়
আঁচলের চাবিগোছা দিয়ে দরজা হাট করে খুলে
কীভাবে দাঁড়াল এসে বিকেলের অবশিষ্টটুকু

কোনভাবে রাগে অন্ধ স্ত্রীলোকের প্রায়
ধারালো বঁটির ঘায়ে দিন-রাত ভিন্ন হয়ে গেল
শিরশ্ছিন্ন মাছ
এইবার পাক হবে, সিদ্ধ হবে ক্ষুৎকাতর পাতে
পান ও জরদায় মেশা বিকেলশেষের পূর্বরাগ
মশল্লার ঘ্রাণে প্রাণ পায়

এইমতো দেখি আমি ছোটোবেলা
ছিপ ফেলি পুকুরে
আর অমনি উঠে আসে সার সার স্ত্রীলোক-পুতুলগুলি
মুখে বঁড়শিদাগ,
 ব্যথা
দু-পায়ের দাপে ব্যথা মুছে দিল সুফলা আঁতুড়
তোলা উনুনের আঁচ ধোঁয়ায় ধোঁয়াক্কার
শশব্যস্ত রান্নাঘর চকিতে ঝিকিয়ে ওঠা বঁটি
খণ্ড মাছ,
 খণ্ড খণ্ড আনাজ-কোটার আয়োজনে
মহোল্লাসে জেগে উঠে বিধবা সন্ধ্যাকে বুকে টানে
বলবান নিশীথ-পুরুষ

এইরূপ ঘটে স্ত্রী সংসারে
ভাঙে ও ছিটিয়ে ফেলে পুনর্বার গড়ে
চমৎকার মেয়েলোক সব

এই স্মৃতি, ছোটবেলা মনোমুগ্ধকর

 

অতঃপর ভবলোকে রাত্রি নেমে এল
নতচক্ষু গতিস্তব্ধ স্পন্দনরহিত
বীজন দিয়েছে কত হাতপাখা, গুমোটে সাহারা
সংসার সুখের, তাহে অধিকন্তু রমণীর গুণ
সন্ধ্যাকালে ছাই উড়ে যাবে আর
লোকে লোকে শোর উঠবে সে-গুণের জয়ের সংগীত
দ্যাখো রাস্তা ঝাঁকুনিবিহীন, ওই ছুটে যাচ্ছে রথ
সারাদিন তুমি মৃতবৎ
রচনা করেছ ঘর
ঠোঁটে যত কুটো, যত খড় বয়ে এনে
সেসকল যত্নের ওপর নেমে এল হুইসল রাত্রির
যাত্রীঘর ফাঁকা
দু-দিকে সিগন্যাল-বাতি রাঙা, ট্রেন
ত্রিশঙ্কু দাঁড়িয়ে

এসো, তাতে গতি দাও
আকাশবাতাস সব গুঁড়ো করে হাওয়ায় উড়িয়ে
লণ্ডভণ্ড সংসারমোচন
রাত্রিকাল হও, তুমি পাখি
তুমি সারা দিনমান যৎসামান্য মেয়েলোক
ওই উড়ে যাচ্ছ, ওই দূরে
জেগে উঠছে মধ্যরাত শিকলে নূপুরে
জেগে উঠছ রাত্রিমেঘ, কী অসাধারণ

মন্তব্যসমূহ

Amaniac বলেছেন…
আগেও পড়েছি, আবার পড়লাম,অপূর্ব!
-অলোকপর্ণা

জনপ্রিয় লেখা