সুমন সাধু’র চারটি এলোমেলো উচ্চারণ | আঙ্গিক


তাকে যেতে দাও

হঠাৎ একটা মৃত্যু কী বার্তা নিয়ে আসে? শৈশব নাকি যুববেলা? কিছু মৃত্যুর পাশে চুপটি করে বসে থাকে এই দুটি শব্দ। এই মৃত্যুকে দেখেছিলাম বারো বছর আগে, আমাদের পুরোনো বাড়ির উঠোনে। যে বারবার মরে গিয়ে বলত, আমি মরে গেলে তুই কাঁদবি? তোর বাবা-মা কাঁদবে? বারো বছর আগে হেসেছিলাম খুব। আজও কি হাসি পাবে আমার? যে মরে গেল আর যাকে মরে যেতে হল, এই সমাজ দুইয়ের মানে এক করবে কীভাবে? মৃত্যুর অন্ধকারে লুকোনো আছে সেই সুতো, যা ক্রমশ সরু হয় রোজ। রোজ সুতোর গিঁট আলগা হলে এবার মনে হয় মৃত্যু আমাকেও জড়িয়ে শুয়ে আছে। যে চলে যাচ্ছে না বলে, তাকে যেতে দাও, তাকে যেতে দাও, তাকে কাঁদিও না। নিশ্চয় দেখা হয়ে যাবে কোথাও...


কী

কীভাবে যেন একটা আস্ত শহর গিলে নিচ্ছে গ্রীষ্ম। অফিসের ছাদে দেখি লু বয়। মোবাইলের ওয়েদার আপডেট দিচ্ছে আজ ঠিক ৬টা ১০-এ সূর্যাস্ত। তারপর একটা গুম মারা হাওয়া। একা একটা জার্নি। ঠিক সেইসময় কানে বেজে চলেছে নিখিল ব্যানার্জির কী উদাত্ত সেতার। পাশ থেকে অচেনা কেউ বলে ওঠে, “ওহে, নিখিল কি সন্ধেয় শোনা যায়!” কী জানি! কী জানি-টাও তো কী বিস্তৃত। অটোর পথে বর্ণময় ফুটপাতে আরও বিস্তৃত হাওয়া। এই যাতায়াতের পথেই ঠিক একবছর আগে যখন প্রেমে পড়েছিলাম, বারবার সূর্যাস্তের লম্বা স্পেসে ডুবে যেতাম। আর তো বেরিয়ে আসা গেল না! কেন এমন হাওয়া দেয় চারপাশ! মনে মনে ঝটপট হাওয়ার সেলিব্রেশন। কী কান্না এই হাওয়াদের। বাড়ি এসে স্নান সেরে যেই জিরোতে যাই, দেখি চারদিক অন্ধকার করে এসেছে। কবুল করে ফিরে যাচ্ছে পাড়ার বাচ্চারা। রোজ রাতেই একটা অলীক প্রেম আসে বটে। কীভাবে যে বুঝে যায় কী কী বদভ্যাস, কী রঙের বিছানার চাদর। পাশে কেউ নেই কেন? পাশ থেকে কেউ কি ডাকছে? এই একটুকরো চিল শকুনের দেশে একটা বিষ লেপ্টে যাওয়ার হাওয়া। সেই একটা অলীক অধ্যায়, শরীর নেই, মুখে রা নেই, পালিয়ে যাওয়া নেই।

কীভাবে যেন আস্ত একটা শহর গিলে নিচ্ছে গ্রীষ্ম। লু বয়। শুধু লু বয়। এখন শুধু ফেরার সেলিব্রেশন। কে কোথায় কীভাবে ফিরছি কেউ জানি না। কিন্তু এই যে ফিরছি ফিরছি ভাব, সেটাও তো একটা সাহস। সূর্য ডোবার সাহস। অলীক মানুষের প্রেমে ডোববার সাহস।


দৃশ্যত শরীর

যে কোনো দমকা হাওয়ায় আমার বরাবর ভয়। রাংতামোড়া একফালি ঝড়ের দাপট এই বুঝি উড়িয়ে দেবে দৃশ্যত শরীর। পাখির চোখ হবে চিৎকার। যে কোনো পাণ্ডুলিপি জমা দেবার পরমুহূর্তেই আমি তোমার উদাস হব। তুমি গাইবে সারিবদ্ধ চিলের গান। সেই গানের সুর হয়ে বইবে ডানা ঝাপ্টানোর আওয়াজ। কুচো কুচো কাগজ উড়বে আকাশে। পাণ্ডুলিপি গোছানোর মুহূর্তে আমার ঘর কী বিরাট আয়তাকার। ঘন ঘন চা খাই। লেখা আসে। ঘন ঘন লেখা আসে। চা খাই। একের পিঠ চাপড়ায় অন্যে। পাণ্ডুলিপি তৈরি হওয়ার পরমুহূর্ত চাপা কষ্টের৷ একটা ফাঁকা শুনশান বারান্দা। রাস্তা দিয়ে আজ তো কেউ মাছ বিক্রি করতে গেল না! ফুল নিয়ে যে যায়, সে তো এল না! গুম মেরে যাওয়া এই আবহাওয়া নিয়ে কতদূরই বা যাওয়ার থাকে আমার। আজকাল ভাড়া বাড়িতে অতিথি আসে না। কে কোথায়! এদিকে এক একটা শূন্যে আমার রান্নাঘর, ডেস্ক ভর্তি হয়ে আসছে। শূন্যের ভিতর এত জাদু, এত হু-হু হাওয়া। তাদের কেউ অন্তত আজ আসুক। সারারাত জাগব।


গওহর জান

ঠাকুমা আমার রাঙা বউ। প্রতি মাসে একবার সাধ করে বলত, “ওগো শ্যাম, আমাকে দু'টাকার নঙ্কা এনে দাও।” শ্যাম ঠাকুমার দেওয়া নাম। শ্যামবর্ণ রোগা ছিপছিপে একটা ছেলে। আর ওই দুধে-আলতা প্রৌঢ়া আমার প্রথম প্রেম। একবার আমের আচার চুরি করতে গিয়ে ধরা পড়েছিলাম। ঠাকুমা লাঠি নিয়ে তেড়ে এসেছিল। ব্যাস, রাগ করে অনেকদিন ঠাকুমার ঘরে যাইনি৷ পুরোনো বাড়ি ছাড়ার সময়ে শেষবারের মতো সেই ঘরে ঢোকা। বিছানায় হেলান দিয়ে ঠাকুমা শুনছে গজল। একটা হাত রেডিওর উপরে, আরেকটা হাতে পাখা ঘুরছে। সেই প্রথম নিঃশব্দে অতিক্রম করেছিলাম একটা ফাটা গন্ডি। ডিঙোলেই হয়ত ঠাকুমা বলে উঠবে, “ওগো শ্যাম, দু'টাকার নঙ্কা এনে দাও।” তারপর বহু বহু বছর দুধে-আলতা ওই মহিলার সঙ্গে কথা হবে না আর। চরম গ্রীষ্মে কী অবলীলায় ঢুকে পড়তাম দোতলার ঠাকুরঘরে। একটা গুড়ের পাটালি হাতে দিয়ে চুরাশি বছরের ভাঙা গলায় গান ধরত ঠাকুমা। নজরুলের শ্যামাসংগীত। আর কী সহজে একটা উপোসী হিন্দুঘরে ঢুকে পড়ত মুসলমানি যুবক। আমি আর ঠাকুমা, দুজনের চোখ বন্ধ থাকত। আর একটা উদাত্ত পুরুষালি কণ্ঠে আমার গওহর জান গান শুনিয়ে যেত। শুনিয়েই যেত।


সুমন সাধু

মন্তব্যসমূহ

জনপ্রিয় লেখা