রামধনু রূপকথারা ও নব্বইয়ের দশকের কলকাতা | পর্ব ১ | ড. অভিষেক বব চক্রবর্তী | আঙ্গিক
রামধনু রূপকথারা ও নব্বইয়ের দশকের কলকাতা - পর্ব ১
ড. অভিষেক বব চক্রবর্তী
“সাম্য রসের উপাসনা
না জানিলে রসিক হয় না”
- লালন শাহ
নব্বইয়ের দশকের কলকাতায় সামাজিক পরিসরে তখন সমান্তরাল–কামনা ঘিরে সুগভীর নৈঃশব্দ। সমান্তরাল কামনা অর্থে বিষমকামের বাইরে এমন কিছু কামনা, যার মধ্যে রয়েছে সমকাম, উভকাম, রূপান্তরকাম, বিপরীতবেশধারণ প্রভৃতি। এক কথায় ছোট করে বলা চলে, LGBTQIA+ (Lesbian Gay Bisexual Transsexual Queer Intersex Asexual এবং অন্যান্য)। তখনও ভারতীয় দণ্ডবিধির ৩৭৭ ধারায়, এসব “অ-প্রাকৃতিক”, শাস্তিযোগ্য অপরাধ। সনাতনী ভারতীয় ঐতিহ্যের ও মূল্যবোধের ধারক-বাহক হিসেবে দাবি করা গোষ্ঠী, “বিদেশ থেকে আগত অপসংস্কৃতি”-র ধুয়ো তোলা স্বঘোষিত নীতি-পুলিশ, এই গোষ্ঠীগুলির মধ্যে পিষে যাওয়া সমান্তরাল প্রেমে বিশ্বাসী মানুষরা নিজেদেরকে সে সময় অন্তরালেই রাখতেন। সামাজিক সুরক্ষাই মূল কারণ ছিল এই অন্তরালের। ১৯৭০ বা তারও আগে থেকে এ আন্দোলন শুরু হলেও, নব্বই-এর দশকের শুরুতেও LGBTQIA+ বা “সমকামিতা” (সমাজের একটা বড়ো অংশের মানুষের কাছে সে সময় LGBTQIA+ ব্যাপারটাই স্থূল অর্থে সমকাম ছিল।) বিষয়ে সে ভাবে, কোনও আলোচনাই হত না। সমাজের অধিকাংশ মানুষই ছিলেন নিরুচ্চার। তার কারণ এই নয়, যে তারা “সমকামিতা” সম্পর্কে অজ্ঞাত ছিলেন। সমকাম, উভকাম ইত্যাদি কামের অতি প্রাচীন ধারাগুলি, যা যুগ যুগ ধরে বয়ে চলেছে ফল্গুধারার মতো, তা সকলেই জানতেন এবং জীবনের কোনও না কোনও পরিস্থিতিতে প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে এর সম্মুখীন হননি, এমনটাও নয়। কিন্তু, আমরা প্রত্যেকেই কোনও না কোনও ভাবে প্রান্তিক হয়েও বিশেষ বিশেষ অবস্থায় নিজেদেরকে উন্নততর কল্পনা করে অন্যের থেকে নিজেকে দূরে সরিয়ে রাখি এবং মনে করি, নিজেরাই নৈতিকতায় সেরা এবং এক্ষেত্রেও এমনটাই ঘটেছিল।
আসলে, এর পিছনে রয়েছে যুগযুগান্তর ধরে চলে আসা এক জটিল রাজনীতি। উৎপাদন এবং শ্রমের মধ্যে বহুদিন হল এক সমীকরণ কাজ করছে, যার মূল প্রভাবক প্রজনন। এই উৎপাদনের দু’টি প্রধান উপাদান, নারী এবং পুরুষ। তারা শ্রমিক, শ্রম দান করেন।
এই চক্রটিই সমাজ তথা রাষ্ট্রের মূল-ভিত্তি। এখন, সমস্যা হল, এই প্রজননক্ষম শ্রমিকদের উৎপাদন-কর্মে ইচ্ছুক হওয়া, এই আবহমান কাল ধরে বয়ে চলা প্রক্রিয়া বহমান রাখার জন্য একান্ত প্রয়োজন। ফলতঃ সন্তান উৎপাদিত হয় না, এরকম যৌনতার রাষ্ট্রের কোনও প্রয়োজন নেই, প্রয়োজন নেই ধর্মীয় সংগঠনগুলিরও। সে কারণেই “অস্বাভাবিকত্ব”-এর অছিলায় নানান বিধিনিষেধ, দণ্ডের অবতারণা। সমান্তরাল কামনাগুলি যে কেবল এবং কেবলমাত্র কোনও সংখ্যালঘু ব্যক্তিসমষ্টির কামকেন্দ্রিক জীবনচর্চা নয়, বরং লিঙ্গ-বিষয়কচর্চা (যৌনতা নয়, যৌনতা শব্দের উৎপত্তি যোনি থেকে, যা শুধুমাত্র নারীর কামকেই প্রকাশ করে, পুরুষ বা তৃতীয়লিঙ্গ বা লিঙ্গ-অনির্নিত মানুষের নয়) প্রত্যেক মানুষের ব্যক্তিজীবনের অবিচ্ছেদ্য অঙ্গ, এই সহজ ও চিরায়ত সত্যটিকেই ভুলিয়ে দেওয়া হয়েছিল।
আসলে যৌনতা-কে আমরা মোটামুটি ভাবে দু’ভাগে ভাগ করে ফেলেছি। (যদিও Desmond Morris তাঁর “The Human Zoo” গ্রন্থে যৌনতাকে দশটি ভাগে ভাগ করেছেন) “প্রজনন-মুখী যৌনতা” (Procreational Sex), যা বংশবিস্তারে সহায়ক এবং “আশ্লেষ-মুখী যৌনতা” (Recreational Sex), যেখানে মানুষ প্রজননের তোয়াক্কা করেন না, শুধু আনন্দের জন্যই যৌনতা বা কাম। কাম-কে গবেষকগণ মূলতঃ দেহ-কেন্দ্রিক বলেছেন। বলেছেন কাম লিঙ্গ-চর্চা চায়, আশ্লেষ চায়। আবার, প্রেম মূলতঃ মন-কেন্দ্রিক। প্রেমে সংযম সুস্পষ্ট, কাম অনেকটাই অসংযমী। আবার, ফ্রয়েড বলেছেন কাম এবং প্রেম একই উপাদানে গঠিত, পার্থক্য কেবল লক্ষ্যে (aim)। বাঙালির লালল শাহ-ও বলেছেন, “বলবো কি সেই প্রেমের কথা/ কাম হ’ল সেই প্রেমের লতা”।
তারপরেও, শুচিবায়ুগ্রস্ত বাঙালি মধ্যবিত্ত পরিসরে কামের তুলনায় প্রেম শব্দটি অনেকাংশেই বেশি গ্রহণযোগ্যতা পেয়েছে। প্রেম “নিকষিত হেম, কামগন্ধ নাহি তায়”। যেখানে কাম-ক্রিয়ার পরেই স্নান সেরে শুচি হতে হয়, সেখানে সেই কাম যদি হয় সমান্তরাল-কাম, ভয়াবহ বিরূপ প্রতিক্রিয়া ঘটবে, সহজেই অনুমেয়।
ক্রমশ...
ঋণ-স্বীকার
মন্তব্যসমূহ