মানুষ ঘরবন্দি, প্রকৃতি শ্বাস নিল প্রাণভরে | সম্পাদকীয় | আঙ্গিক ১০ বছর পূর্তি (২য় পর্যায়)
১৯৭০ সালে নিউইয়র্ক শহরে পৃথিবীর স্বাস্থ্য রক্ষার দাবিতে রাস্তায় নেমেছিলেন প্রায় কয়েক লক্ষ মানুষ। প্রত্যেকের দাবি ছিল পরিবেশ রক্ষার জন্য আরও কঠোর আইনি ব্যবস্থা নিতে হবে। ভাবলে অবাক লাগে এই কর্মসূচির প্রধান উদ্যোক্তা ছিলেন ২৫ বছর বয়সী ডেনিস হেইস নামের এক ছাত্রী। সেই বছর থেকেই বিশ্ববাসী ২২ এপ্রিল দিনটি ওয়ার্ল্ড আর্থ ডে হিসাবে পালন করছেন।
পৃথিবী মানেই শুধুমাত্র মানুষ নয়। একইভাবে বাস করছে প্রচুর উদ্ভিদ এবং অন্যান্য প্রাণীবিশেষ। কিন্তু তাদের রক্ষা নিয়ে সারাবছর অনেকেই চিন্তিত থাকেন না। এই কারণেই বছরের পর বছর কমে আসছে গাছ, জঙ্গলে হ্রাস পাচ্ছে বিভিন্ন প্রজাতির জীব, গাড়ি চলাচলের কারণে চারদিকে দূষণের মাত্রা ভয়াবহ। মানুষের বাঁচার পৃথিবীতে মানুষই সমস্ত দূষণ নিয়ে আসে। আর তা রক্ষা করার দায় বর্তায় কাদের উপর? এ তো গেল সব বর্তমান কিছু দিক। কিন্তু ১৯৬২ সালে লেখা একটি বই বিশ্ববাসীর চিন্তাধারায় আঘাত মারে। মানুষ ভাবতে শুরু করেন। র্যাচেল কার্সন, তাঁর লেখা ‘সাইলেন্ট স্প্রিং’ বইটিতে দেখান পরিবেশের উপর কীটনাশকের ক্ষতিকর প্রভাব। সে সময় তুমুল আলোড়ন তোলে বইটি। জন্ম নেয় আধুনিক পরিবেশ আন্দোলনের।
জীবন চালিয়ে যাওয়ার জন্য পৃথিবীর প্রাকৃতিক সম্পদের বজায় রাখা অত্যন্ত প্রয়োজনীয়। মানুষ বিশ্বের সবচেয়ে বুদ্ধিমান প্রাণী। কিন্তু মানুষই এই নীল গ্রহের প্রতি যত্ন নিতে ভুলে যায়। জনসংখ্যা বৃদ্ধির কারণে বসবাস ও কৃষিজমির জন্য ব্যাপক হারে গাছ কাটা হচ্ছে। হারিয়ে যাচ্ছে বহু বন্য পশু-পাখি। শুধু তাই নয়, বিশ্ব এখন পারমাণবিক বর্জ্যের দায় কাঁধে নিয়ে আছে। ঝুঁকির মধ্যে রয়েছে বেশ কিছু পারমাণবিক বিদ্যুৎ কেন্দ্র। পৃথিবী এখন রেডিয়েশনের ভয়ে প্রকম্পিত।
ভাবলে অবাক লাগে, ২২ এপ্রিল, ২০২০ দিনটি বিশ্ব মানচিত্রে আমুল পরিবর্তন এনে দিয়েছিল। করোনা ভাইরাসের জেরে পাল্টে গিয়েছিল মানুষের জীবনযাত্রা। প্রকৃতি ভুলে যেতে বসা মানুষ তখন জানলায় হাত রেখে ছুঁয়ে নিইয়েছিল আকাশ। গাছ বড়ো হলে কীভাবে প্রতি সকালে গোটা ঘরময় সে ছায়া দিয়ে যায়, তা জেনে নিয়েছিল। চোখে হারাচ্ছিলেন তার প্রিয়জনকে, প্রিয়স্মৃতিকে। রাস্তায় আর মানুষ ছিল না। তাই তো প্রকৃতি তার দুই হাত তুলে আনন্দে মেতে উঠেছিল। দিনদুপুরে রাস্তায় দেখা গিয়েছিল ময়ূরের অবাধ্য চলাচল, সন্ধের রাস্তায় ঘুরে বেড়িয়েছিল একদল হরিণ, কুকুররা তাদের পাড়া ফিরে পেয়েছিল, পাখিরা বুঝে নিয়েছিল গাছে গাছে থাকার অধিকার, সারারাত পাখিদের কলতানে প্রাণ পেয়েছিলেন বহু মানুষ, জল দূষণমুক্ত হওয়ায় মাছেরা তাদের হারানো জমি ফিরে পেয়েছিল – শুধু একটাই শব্দ ‘করোনা’। মানুষ ঘরবন্দি, প্রকৃতি শ্বাস নিল প্রাণভরে। মানুষ তার শিকড়ের টান অনুভব করেছে আবার।
করোনা শেখাল, একটি গাছই হোক আমাদের একমাত্র বন্ধু। আমরা শিখলাম কি?
সুমন সাধু
সম্পাদক, আঙ্গিক পত্রিকা
এবারের সংখ্যার প্রচ্ছদঃ শুভজিৎ নস্কর
মন্তব্যসমূহ