অরিত্র চ্যাটার্জির তিনটি কবিতা | আঙ্গিক
অরিত্র চ্যাটার্জির তিনটি কবিতা
এই ঘর
কতকটা দেশ কাল অনায়াসে পেরিয়ে এসে
এই একচিলতে ঘরে লোকটা আটকে আছে অনেকদিন হল।
কবে একদিন চিঠি চলে আসবে, জিপসিদের কায়দায়
আবার গুটিয়ে ফেলতে হবে তাঁবু,
এসব জেনেও, সে তার ছায়া টাঙিয়ে রেখেছিল দেওয়াল জুড়ে
কখন তা ফ্যাকাশে হয়ে গিয়েছে, চোখে পড়ল দিনান্তে এসে
নিঃশব্দে এসব তাকে অতিক্রম করতে হবে, সে খুব সন্তর্পণে ভাবে
প্রায় ফাঁকা একটা ঘরের নিরিখে এখন তাকে অদ্ভুত বেমানান দেখায়
ছবিতে সোজা সাপটা লোকটা ক্রমশ অনেকটা ঝুঁকে পড়ে দেখে
খাটের তলায় এককোণে বসে আছে একটা জেদি বেড়াল
তার সবুজ চোখের আলোয় ঝাপসা স্মৃতিগুলো যদি আবার জেগে ওঠে
আর ঘিরে ধরে লোকটাকে, নিজের ছায়া হারিয়ে ফেলা একটা লোক…
সে তখন কী করবে, আসুন এই নিয়ে আমরা একটু ভাবি
আর ভাবি ওই খাটের তলায় ওই ছোট্ট বেড়ালটার কথা
শত প্রলোভনেও যে আজকে বেরোতে চাইছে না কিছুতেই
পড়ন্ত বিকেলের অভিমুখে এই ছবিটা আপনার আর ভালো লাগছে না
হয়ত ওদের একটু একা থাকতে দেওয়া দরকার,
এই ভেবে আমি আপনি ক্রমশ নেমে যাচ্ছি সিঁড়ি বেয়ে,
ঘরটা চলে যাচ্ছে ছবির বাইরে দ্রুত এবং যেভাবে লোকটাও…
লোকটা জানে, ঘরের বাইরে বেরোলে ঘরের ভেতরে সে মারা যাবে অচিরেই…
কলকাতা ২০২১
বিকল দুপুরের পাশে বসে আছে ডেভিড
শীত লেগে লেগে তার ছায়াখানি এখন
শীর্ণ, আদতে বাতিল যানবাহনের দেবতা
দেখে মনে পড়ে ভালো লেগেছিল তাকে
শৈশবে, মনে পড়ে, ডেভিড, এই তার নাম
ভালো লেগেছিল খুব, অথচ এখন বাতাসে
ত্রসরেণু কেমন, অহেতুক সংশয় পেয়েছে
দেখো বিকল দুপুরের পাশে ছায়া নিয়ে
ডেভিড, একটি সারমেয় তাকে ভালোবেসে
পাশে বসে আজও- প্রাচীন আলোকচিত্রের ন্যায়
এরকম যা কিছু সুন্দর, সুন্দর হলুদ রিবন হাইস্কুল,
সবুজাভ কুয়োতলা, ইন্দুভিলা নাম্নী একদা দ্বিতল বাটী
তোমার এই জন্মলব্ধ বাস্তবতা- যা কিছু সম্ভাবনারা
ক্রমশ প্রতিহত করেছে, তাই তুমি একে বারেবারে
দূর থেকে দেখো, আর আত্মপ্রতিকৃতি ভেঙ্গে প্রণাম জানাও
তার উদ্দেশ্যে প্রার্থনা কর যেন এভাবেই তোমাকে কখনো
আবারও ডেকে নেয় এই আপাত সময়হীনতার দেশ…
দোতলার গান
হাইওয়ের ওপরে একটা খুব পুরনোমতন গাড়ি
আবারও থেমে যাচ্ছে কোনো অপ্রত্যাশিত বাঁকের সামনে
আর প্রাচীন উপকথা থেকে উঠে আসা ঘোড়সওয়ারেরা
ক্রমশ ঢুকে পড়ছে এইসময়ের একটা সরাইখানায়
অবশিষ্ট মদ হাতে যেখানে কয়েকজন ক্লান্ত ভাঁড়
মনোরঞ্জন করছে মালকিনের, অদূরেই জনৈক মাতাল
ধরে নেওয়া যাক সে কানে খাটো, এসব দেখেনি
বরং ভেবেছে একমনে, সোডার মধ্যে এত বেশি মৃত্যুর গন্ধ
কেন সে পাচ্ছে আজকাল, ঘোড়সওয়ারেরা ফিরে যায়
অন্যমনস্ক জেনারেল, গ্লাস শেষ না করেই উঠে পড়েন
চলুন কতকটা তাঁর পিছু পিছু যাওয়া যাক, রাস্তায় আবার
রাস্তার ওপাশে রাস্তা, অবিন্যস্ত ফ্ল্যাটবাড়ি, আমরা পেরোই
নির্জন পার্ক, তার এই দৃশ্যের ভেতর আর কেউ নেই
শুধু বিকেল ভঙ্গিমার ঠিক মাঝখানে একটি ক্লান্ত তরুণী
নিদ্রিত প্যারামবুলেটরের সাথে গল্প করছে একাই
জানলার ওপাশ থেকে আমরা খানিক তফাৎ রেখে দেখছি
অনতিদূরেই কেউ একটা কাঁদছে, তার শব্দ ছাপিয়ে দোতলার
ওই অস্পষ্ট গান আজ আবার আমাদের কানে ভেসে আসছে…
মন্তব্যসমূহ