সুদীপ রাহার তিনটি কবিতা | আঙ্গিক



অকথ্য


রাত্রের হাওয়াকে বলবো। টেবিলে রাখা খাবার জলের গ্লাসকে বলবো। যতগুলো ভাষা জানি, তাদের সবাইকে বলবো। প্রিয় গানকে বলবো। প্রিয় রাস্তা, টবের গাছে নতুন ফুল, ভোরবেলার পাখিকে বলবো।

কিন্তু, তোমাকে বলব না।

লোকাল ট্রেনের আলোকে বলতে পারি। টেক্সট মেসেজের মুছে ফেলা অক্ষরগুলো তো জানেই। দুঃখ পাওয়ারা জানে। ঘুমের বালিশ জানে। হাওড়া ব্রিজে দাঁড়িয়ে নিজেকে বলবো আবার। উপন্যাসের প্রিয় চরিত্রকে বলবো।

কিন্তু, তোমাকে বলব না।

বন্ধুরা জানলে জানবে। গীর্জার প্রার্থনা জানবে। দীর্ঘশ্বাস তো ইতিমধ্যেই জানে। আর হ্যাঁ, প্রতিদিন প্রতিদিন প্রতিটিদিনই নিজেকে বলবো। কষ্ট-হতাশা-খারাপ লাগারা তো একদিন না একদিন সব জানবেই।

কিন্তু, তোমাকে বলব না।

কেননা, তুমি বিশ্বাসই করতে পারবে না একটি অন্ধ মেয়েকে স্রেফ জ্যোতস্নার ধারণা দিতে চেয়ে এই মুনলাইট সোনাটা। যে চাঁদের আলোয় এখনও ভালোবাসা জন্মায় জ্যোৎস্নারই মতো। ভালোবাসা একটা বিশ্বাস। যে বিশ্বাস যখন তখন এসে দাঁড়াতে পারে তোমার পাশে। সেও অন্ধ। ঐ মেয়েটিরই মতো। তবু তার হৃদয়ের জ্যোৎস্নাটুকু দিয়ে সে তোমাকে দেখতে চায়। আর সে যত দেখতে চায়, তুমি তত লুকোচুরি খেলো। আর এই অন্ধ এ গলি ও গলি খুঁজতে বেরোয় তোমাকে। তোমার দেখা দিতে না চাওয়ার এই খেলায় জন্ম নেয় আরেকটি কক্ষপথ। সে পথ প্রেমের। সে পথে দুঃখই মানুষকে সবচেয়ে আনন্দিত করে, নন্দিত করে। আমার কাছে এই জ্বলে পুড়ে ঝাপসা হয়ে যাওয়াই নন্দনতত্ত্ব। হঠাৎ হাওয়া পেলে তোমার চোখের পাতার কাঁপন দেখে নিতে গিয়ে ওই সহজ চোখে চোখ পড়ে যাওয়াই আকস্মিক বসন্তকাল। যে বসন্তের কোকিলটি একবার ডেকেই মিলিয়ে যায়। মিলিয়ে যায়, কারণ ততক্ষণে চোখ সরিয়ে নিয়েছ তুমি। 

না। না। তোমাকে বলা যায় না।

না বলা প্রেম সবচেয়ে সুন্দর। দুঃখের কৈফিয়ৎ লেখবার খাতায় অনায়াসে একটা ঝড়ে পড়ে যাওয়া গাছের পাতা রেখে আসা যায়। না বলা প্রেমে গোঙানি থাকতে পারে, দুঃসহ ঈর্ষা থাকতে পারে। থাকতে পারে অকারণ ভালোলাগা। এইসবই হাওয়ার কাছে বলা যায়। একমাত্র জোনাকির আলো, এস্রাজের সুর, পাহাড়ি রাস্তার নীরবতাই এই অনুভূতিদের জায়গা করে দিতে পারে। তুমি তো আর আমার ইচ্ছেগুলোকে বসতে দেবে না তোমার কাছে। কেন চোখ লাল হয়ে গেল, কেন ঘুমোতে পারলাম না, এসব জানতে চাইবে না তুমি তো আমার কথা শুনবে না। তোমার নিজস্ব জানলায় ছিটকিনি তুলে নিশ্চিন্তে ঘুমিয়ে পড়বে তুমি। ঘুমোও। শান্তিতে। তোমার ঘুমের দৃশ্য থেকে উঠে এসে এই হাওয়াকে বলবো, তোমায় ভালোবাসি। ভোর হলে আজানকে বলবো, তোমাকে ভালোবাসি। খোলা জানলায় বসে নিস্তব্ধ রাত্রিকে বলবো, তোমাকে ভালোবাসি।

কিন্তু, তোমাকে বলবো না।



অসহ্য অভিশাপ


তারার পাশে তারা হয়ে শুতে গিয়ে দেখেছি বিকট শব্দ করে পড়ে যাই। গাছের পাশে গাছ হয়ে দাঁড়াতে গিয়ে দেখেছি মশায় ছেঁকে ধরে পা। পাহাড়ের পাশে পাহাড় হয়ে বসে  ঘুমে ঢুলে পড়ে গেছি। একদিন দেওয়ালে নিজের ছায়ার পাশে নিজেকে দাঁড় করিয়ে রেখে দেখলাম, সবাই সরে পড়ছে এক এক করে। তারার আলো কমে আসছে। কাটা পড়ছে গাছ। পাহাড় কেটে রাস্তা হয়ে গেল। আমি রইলাম আমার কাছে। নিজেকে দেখে দেখে সহ্য করার অভিশাপ নিয়ে।



নিজস্ব জানালা


দু মিনিট দপ দপ করে নিভে যায় কিছু তারা। আকাশ ঈষৎ ফাঁকা লাগে তখন। কয়েকজন প্লাস্টিকের মানুষ আমার জানলায় মোমবাতি জ্বালতে এসে ব্যর্থ হয় এবং শেষমেশ পারলে আমাকেই ফুঁ দিয়ে নিভিয়ে দিয়ে চলে যায়। যাবার পথে হলুদ ট্যাক্সি থেকে নীল আর খয়েরি রঙের কথা ছড়াতে ছড়াতে ওরা বাড়ির দিকে যায় - নাকি অন্য বিষণ্ণ জানলার দিকে যায়, আমি জানিনা। আমার জানার ইচ্ছেও নেই খুব একটা।

তবু এই জানলাই আমার সবচেয়ে প্রিয়। যে নিজে সারাক্ষণ পাঁজর দুটো খুলে বাইরের দিকে তাকিয়ে থাকে আর যা কিছু ঘরকুনো, দেওয়াল ঘেঁষে থাকা তাদেরও বারমুখো হতে সাহায্য করে। আমি তো দিব্যি হাত পা ছুঁড়ে বাইরে ঘুরে বেড়াই। মাচায় উঠি। কথা বলি। নেমে আসি। তবু জানলার মতো বাইরেটা দেখতে পারি না আর। হৃদয় খুলে দিয়ে দেখেছি, ধুলো বালি ঢুকে আসে। কিন্তু কোথায়? এদিকে আমার তো তেমন ঘর নেই! জানলা আছে, ঘর নেই এইরকম একটা জীবন নিয়ে নাহয় দু মিনিট ঐ তারাদের মতো দপদপ করা যায় কিন্তু কাঁহাতক আর আকাশের মতো ফাঁকা থাকা যায়?


মন্তব্যসমূহ

জনপ্রিয় লেখা