কবিতা ও ইয়াবু পাখিরা | শংকর লাহিড়ীর গদ্য | আঙ্গিক


যেন আমার কাজই তাই। নানাভাবে কবিতাকে রচিত হয়ে উঠতে দেখা। নানা মাধ্যমে সেই উচ্ছ্বাসটুকু দেখানো। বিশ্বভুবন জুড়ে, সংসারের খুঁটিনাটি জুড়ে। শুধু নিজের রচনা নয়, অন্যত্র যাকিছু রচিত হচ্ছে, ফুলবাগানে, শস্যখেতে, বন্দরে, বেডরুমে, খনিগর্ভে। প্রান্তিক জনজাতিতে, লোকাচারে, আদিম গুহায়, জলস্রোতে, সুদূর নীহারীকায়। এমন কি যখন সে ঘুমিয়ে পড়েছে। তার পায়ের নূপুর, আলুথালু পোশাক। ‘কবিতা ঘুমোও তুমি, মুখার্জীও ঘুমিয়ে পড়েছে’- লিখেছিলাম আমি।     

আমরা যে কবিতায় কিছু খুঁজি, তা কি সম্যক জেনে, নাকি না জেনে? সে কি ছন্দবোধ, সে কি কোনও প্রাচীন টোটেম, আত্মজ্ঞান, জন্মসূত্র, সৃষ্টিরহস্য? নাকি শৈশবের হারিয়ে যাওয়া কোনও স্মৃতি অথবা সরগম? কাকে খুঁজে চলেছ কবি?- আমি জিজ্ঞেস করেছি। কোনও অকস্মাৎ জলঘূর্ণি? অথবা কোনও নতুন শব্দশৃঙ্খলা? অথবা হয়তো শুধুই একটা আশ্রয়, একটা হালকা ভাসমান বুদবুদ, যা ধরে রাখে চেতনাকে, ভেসে যায় সব সীমানা পার হয়ে। যায় আর কোথায়! নিজের গভীরে যে প্রশ্নহীন নীরব অনন্ত আছে, হয়তো যেতে চায় সেদিকেই। 

হায়, মাত্র তিনটে অক্ষরে ধরা আছে অসীম, অনন্ত, ইত্যাদি শব্দগুলো। অথচ তাকে সাজাবে বলে কত লক্ষ কোটি শব্দ সংযোজন করে ফেলেছেন কবিগণ।                     

স্বদেশ সেনের কবিতায় আছে এমনই এক অজানা জায়গার কথা, যার নাম ‘বড়িয়াতু’, যেদিকে বাস চলে যায়। স্বদেশ লিখছেন— ‘সিরাপ খাও / পাখির মত চোখ বোনো / বাস যাচ্ছে যাক বড়িয়াতু বড়িয়াতু কোথায় বড়িয়াতু’।  

দীর্ঘ আটত্রিশ বছর আমি সিংভূমে ছিলাম, কিন্তু কখনও বড়িয়াতু যাওয়া হয়নি। তার চেয়েও আক্ষেপের যে, আমার আজও ভানুয়াতু যাওয়া হয়নি, যেখানে আমি কতদিন যাব ভেবেছি। দক্ষিণ প্রশান্ত মহাসাগরের ধু-ধু জলরাশির মধ্যে প্রবালপ্রাচীরের আশেপাশে, ঝিনুকের মতো ছড়ানো কয়েকটা দ্বীপ, মোট আশিটা। সেই নিয়ে ভানুয়াতু দেশ। এই সেই প্রাচীন মেলানেসিয়া অঞ্চল, যার ব্যাপ্তি পাপুয়া নিউগিনি থেকে শুরু করে ফিজি দ্বীপপুঞ্জ অবধি। সমুদ্রবেষ্টিত অজস্র দ্বীপ, যার মধ্যে ঘুমিয়ে আছে সুপ্ত কত আগ্নেয়গিরি। আমার তো যাওয়া হয়নি, আমি তাই মাঝে মাঝে মানচিত্র খুলে দেখে নিই তাদের। যেভাবে আমি কঙ্গো আর ক্যামেরুনের পিগমিদের লক্ষ্য করি। দেখি তাদের যূথবদ্ধ নাচ, শুনি তাদের পলিফোনিক কন্ঠের গান। তেমনই সুন্দর এই সমুদ্রবেষ্টিত দ্বীপবাসী মেলানেসিয়রা। সূর্যাস্তে সমুদ্রসৈকতে প্রাচীন মেলানেসিয় সুন্দরী।  জীবনানন্দ দেখেছিলেন এশিরিয়া, মিশর আর বিদিশার সুন্দরীদের; হাওয়ার রাত কবিতায়। আর আমার নজরে পড়েছিল মাঝসমুদ্রের এই মেলানেসিয়া অঞ্চল। এখান থেকেই আরও পূর্বদিকে বিস্তৃত হয়ে আছে পলিনেশিয়া অঞ্চল, যার মধ্যে আছে তাহিতি দ্বীপপুঞ্জ; চিত্রকর পল গঁগ্যার আঁকা সেইসব তাহিতি সুন্দরীরা।    

তো, বড়িয়াতু নয়, আজ আমার মন বলছে ভানুয়াতু, ভানুয়াতু। দ্বীপের নাম পেন্টিকোস্ট। প্রাচীনকাল থেকে এঁরা কবিতা লেখেন। কাগজে কলমে নয়— মাটিতে, সৈকতবালুতে, আঙুল দিয়ে আঁকা নানা ছবি ও সংকেত চিহ্নে। এইসব চিত্রকলা ও রচনা চলে আসছে অনেক প্রজন্ম ধরে। প্রথমে বালির ওপরে কয়েকটা সরলরেখা দিয়ে একটা গ্রিড বা নকশা এঁকে নেওয়া হয়। তারপর এক আঙুল দিয়ে শুরু হয় মূল অঙ্কন বা একটি কবিতা। এক ভীষণ ব্যতিক্রমী স্যান্ড আর্ট। আঙুল ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে বিস্ময়কর জটিলতায় তৈরি হয় একটা ছবি এবং ছবি শেষ না হওয়া পর্যন্ত একটানে আঁকতে হবে, মাটি থেকে তোলা যাবে না আঙুল। ইউনেস্কো এই স্যান্ড আর্টকে বিশ্বের একটি ‘ইন্টাঞ্জিবল হেরিটেজ’ আখ্যা দিয়ে সম্মানিত করেছে। নানা ধরণের সব অঙ্কন, যার মধ্যে খুব প্রচলিত হোল- সমুদ্র কচ্ছপ। আর আছে নানা জটিল নকশায় লেখা যথেষ্ট সাংকেতিক ও বিমূর্ত কত বিষয়, যাকে বুঝিয়ে না দিলে শুধু আপাত সৌন্দর্যটুকু দেখেও মুগ্ধ হওয়া চলে।    

আমি বসে বসে তাদের ছবি আঁকা দেখছি। সমুদ্রতীরের রূপোলি বালুতে, অথবা উঠোনের কালো মাটিতে। মাটির উঠোনে পা ছড়িয়ে বসে আছে লোকটা। শুধুমাত্র তর্জনি দিয়ে সে দাগ কেটে চলেছে। যতিহীন টানা বক্ররেখায় আঁকা খুব জটিল একটা ছবি। অনেকক্ষণ সময় নিয়ে এঁকে, সে চুপ করে তাকিয়ে রইলো। তারপর বোঝাতে লাগলো ছবিটা। এই দেখ, মাঝখানে, এটা একটা আয়না। কাচের আয়না। আর এইপাশে দেখ একটা পাখি, এর নাম ইয়াবু। এটা সামুদ্রিক পাখি। এর শরীর শ্যামবর্ণ আর মাথাটা লাল রঙের। এইপাশে একটা নারকেলের খোলায় পাখিটা স্নান সারছে। দেখ, এইদিকের নারকেল খোলাটা। ইয়াবু পাখিটা এখানে স্নান করছে আর আয়নায় মুখ দেখছে। দেখো, কেমন জলে ডুব দিয়ে উঠে মাথা ঝাঁকাচ্ছে। আর ওইদিকের খোলার পাখিটার নাম আউইরি। এর মাথার অর্ধেকটা শুধু লাল। ওই ইয়াবু পাখিটা যখন স্নান সেরে মাথা ঝাঁকায়, তখন এই আউইরি পাখিটার গায়ে জলের ছিটে লাগে। তাই এর মাথা পুরোটা লাল নয়, শুধু অর্ধেকটা লাল।

আমি কিছুই বুঝলাম না। চুপ করে তাকিয়ে রইলাম। অদ্ভুত একটা ডিজাইন। কিন্তু এর মধ্যে কোথায় পাখি, কোথায় লাল রঙ, কোথায় তার স্নান সমাপন, কিছুই তো আমি দেখতে পেলাম না। শুধু সে হাতের আঙুল দিয়ে আঁক কেটে গেছে বালিতে। এইসব কবিতা আর ছবি সে শিখে এসেছে বংশ পরম্পরায়। একদিন সে শিখিয়ে দেবে তার সন্তানকেও; শৈশব থেকে শুনে আসা, আর স্বপ্নে দেখা ওইসব পাখিদের কথা। আজ আমারও মনে পড়ে গেল, বন্ধু রুমাল বইয়ে আমার একটা কবিতাঃ


পাখি যেন

সন্ধ্যা নামে বুলেভার্ডে, ঘুম পায়—

স্বপ্নে দেখা সিনকোনা বাগানে 

                 মনে পড়ে লেগেছে আগুন;  

কারা যেন লজ্জাবস্ত্র ফেলে গেছে, যেন ওরা নীল ম্যাগপাই

দীর্ঘ বেণী, খোলা চুল, রেটিনায় 

                             আলোর জোনাকি। 

পাথরে পাথর হয়ে পড়ে থাকে ঐ সন্ধ্যা, 

বুকের বোতামে,

               বুকের গভীরে ওরা কয়েন লিশেন

সাদা নার্স অ্যাপ্রন ফরমালিনের পাখি ওরা

শুয়ে থাকে বুলেভার্ডে, এ-বয়সে অসময়ে, ক্রাচে। 

স্বপ্নে দেখা সেই পাখি, সন্ধ্যা নামে ঘুমে থরথর

যেন ওর নীল ডানা, ওরা যেন মর্গে পাহাড়ি

মেয়েরা এসেছে সেজে, শবদেহ নিয়ে যাবে তারা।

কীভাবে আগুন লাগে লজ্জাবস্ত্রে, আর শীত নামে

বুলেভার্ডে  দীর্ঘ বেণী,

        পাখি যেন, স্বপ্ন সিনকোনা।

  

আমরা যে কবিতায় কিছু খুঁজি, তা কি সম্যক জেনে, নাকি না জেনে? সে কি এক রহস্যময় বিন্যাস? সে কি কোনও প্রাচীন টোটেম, আত্মজ্ঞান, জন্মসূত্র, সৃষ্টিরহস্য?            

মন্তব্যসমূহ

জনপ্রিয় লেখা