কুন্তল মুখোপাধ্যায়ের গুচ্ছ কবিতা | আঙ্গিক


দম্পতি

দুইজন পাশাপাশি থাকি আমরা। দুটি টবে দুটি গাছ। হাওয়া দিলে এ ওর দিকে হাত বাড়াই। আর কিছু না। একই মেঝের উপর কোনো জ্যোৎস্নায় ওর ফুলের গন্ধে আমি আকুল হই, কখনও ও আমার লেবুপাতা শুঁকে দেখতে চায়।

একটু উঁকি দিয়ে দেখি, বিশাল বিশাল বৃক্ষ, তাদের ডালপালা। রাত্রিবেলা তাদের শরীর থেকে উড়ে এসে সাদা প্যাঁচা সারা আকাশ জুড়ে ঘুরে বেড়ায়। আমরা দুজনেই দেখি। ডাল নাড়িয়ে ওকে জিজ্ঞেস করি, ‘ঘুমাচ্ছ?’

যিনি আমাদের জল দেন, তাঁর উদ্দেশ্য বুঝি আমরা। তিনি শুধু আমাদের ফুল ও ফল দেখেন; একদিন হেমন্তের রাত্রিবেলায় যখন সারারাত কুয়াশায় আমার পাতা ভিজে যাচ্ছিল, আর তার কুঁড়ি নমিতস্নানে স্নিগ্ধ, অমনি দু-ফোঁটা অশ্রুপাত হল, সে বলল ‘নক্ষত্রের অশ্রু’ আমি বললাম ‘কেন?’

সে বলল মানুষ মরে গেলে তারা হয়ে যায়


বেদান্ত

কেউই কারোর কাছে হারতে চায় না। শুধু সাফ করতে চায়। ঝাঁটার উপরে চেপে উড়ে বেড়াচ্ছে তারা। সারারাত্রি। আকাশময়। বাথরুমে উঁকি দিচ্ছে, ইনবক্সে উঁকি দিচ্ছে, কোন পুরুষ সঙ্গমের আগে ব্যবহার করছেন গেরুয়া রঙের কন্ডোম ইত্যাদি।

আমি তাই পালিয়ে বেড়াই। ছায়ার ভিতরে লুকিয়ে পড়ি। আমি তাই শত্রুর মুখের সঙ্গে নিজের মুখেরই মিল খুঁজি। কিন্তু কোথায় পালাবো আমি। এই মহাবিশ্ব তো আমারই ভাবসম্প্ৰসারণ!

জামগাছের ছায়া আর দুপুরের নৈঃশব্দ্য বাড়িয়ে দিচ্ছে যে ঘুঘু-র একটানা ডাক — এগুলোও কি আমিই? কাঠবিড়ালি যেভাবে সেলসম্যানের মতো ব্যস্ত হয়ে ছুটে যায়, সেটা?

বউকে ডেকে বলি - তুমি আসলে মিথ্যা! সে অদ্ভুত চোখে তাকাতে তাকাতে ঘরের বাইরে চলে যায় ... গভীর রাত্রি বেলায় সাদা একটা প্যাঁচা বারবার উড়ে বেড়ায় আমার ছাদের আকাশে।

বাথরুমে  জানালার বাইরে তাকিয়ে দেখি ঝাড়ু নিয়ে ভেসে আছেন গান্ধিজি। ইনি আচার্য শংকরও হতে পারেন। বললেন - কী হে, আজ শুক্রবার ?


এলিয়েন 

আমি তুমি বা সে — এইসব দু-পা ওয়ালারাই আসলে ভিনগ্রহের মানুষ। সমস্ত প্রকৃতি আসলে সক্ষম, তুমি ছাড়া কেউ পোশাকও পরে না। বিষাদহীন পৃথিবীতে ফুল ফুটে ঝরে যায়, তার কোনো আফসোস নেই। অপচয় নিয়ে প্রকৃতিতে কারও কোনও আপসোস নেই। ঠিক এখানেই নিজেকে আমার এলিয়েন মনে হয়। আমি কি উদাস হবো? পরিযায়ী পাখির মতো কোনো দীঘির জলে সাঁতরে আসব? সমস্ত পশুরা জন্ম থেকেই সাঁতার জানে? মানুষ ছাড়া কি আর কেউ আত্মহত্যা করে? বিস্মিত হবার শক্তি আরও কারও নেই এই পৃথিবীতে! ঠিক এই জায়গাতেই নিজেকে আমার এলিয়েন মনে হয়। তাছাড়া খাবার আর শরীরের পিপাসা মিটে গেলে খিদে আমার অপচয়ের খিদে আমার ভণ্ডামির খিদে আমার অমানুষিক খিদে হে ঈশ্বর এত খিদে দিয়ে আমাকে পাঠালে কেন পৃথিবীতে। অন্তত পাথর দাও শক্ত পাথর তাই খেয়ে একপেট শুয়ে থাকি আকাশের নিচে

এলিয়েন ছাড়া কারও ঈশ্বর নেই পৃথিবীতে 


নর্দমা বাঁচাও

ড্রেনবাজি করা কোনো হরিণের কাম না। এটা পোকা আর কুকুরদের এলাকা। এখানে টয়লেট বলে কিছুই থাকে না। ড্রেনজন্ম পাওয়া পোকারা জুঁইফুল কৃষ্ণচূড়া থেকে দূরে থাকে কারণ অসুন্দরপসন্দ জীব তারা। খিস্তিস্বাভাবিক জীব।

আপনি, আমার পিতৃব্য, দেখলাম ড্রেন থেকে গা মুছতে মুছতে উঠে আসছেন। আপনি, আমার খুড়তুতো দাদা, লক্ষ লক্ষ পোকা গা থেকে সরাতে সরাতে আসছেন, আপনাদের আমি দেখেছি। তাই রাষ্ট্রপ্রধানের দাঁত দেখার দরকার নেই। আপনারা সারাদিন দুর্গন্ধ নিয়ে কাজ করেন। আপনাদের কাছে চাঁদ মিথ্যে, জুঁইফুল মিথ্যে, বিরহরোদন মিথ্যে। মুশকিল হল , আপনারা যে ড্রেনজন্ম পেয়েছেন সেখানে আমিও নেমে গেছি। সারাদিন দুর্গন্ধ ঘাঁটছি। ভুলে গেছি আমার হরিণ হওয়ার কথা ছিল।

আসুন দলবদল করুন। নর্দমা পাল্টে হাইড্রেন। সোকফিট পাল্টে অসম্পাদিত নালা, পিতৃব্য পাল্টে প্রতিবেশী, খুড়তুতো দাদা পাল্টে হাতকাটা মোহন। অসংগঠিত দুর্গন্ধের জীবনে আমি উলুকঝুলুক হরিণের ঝোল খেয়ে পেয়েছি খেঁকি কুকুরের মতো একটা মুখ আর ড্রেনজলে মাখামাখি একটা পোঁদ।

মন্তব্যসমূহ

Somenath Dey বলেছেন…
অসম্ভব সব লেখা। ভালবাসা
চয়ন দাশ বলেছেন…
দারুন লেখা । চমৎকার। আমার মতে এই সংখ্যার কবিতা বিভাগের অন্যতম বা সেরা লেখা। আমেজ তৈরি হয়ে গেছে একটা। কমেন্টটা করা জরুরি মনে করছি এই লেখাতে। তাই করছি। দারুন দারুন ....

জনপ্রিয় লেখা