বুদ্ধদেব দাশগুপ্ত এবং কয়েকটি ফোন... | সম্পাদকীয় | আঙ্গিক


সিনেমা বুঝতাম না তখন। টিভিতে যা হত দেখতাম। তারপর থিয়েটারে ভর্তি হলাম। তার কিছু বছর আগে মুক্তি পেয়েছে ‘লাল দরজা’ বলে একটি ছবি। থিয়েটারের লোকজন দেখালেন। দেখলাম। কিন্তু বুঝিনি কিছুই। তবে ওই একটা ছড়া মনে মনে রয়ে গিয়েছিল। আমাদের ছোটোবেলার খেলার ছড়া। “ছোটি মোটি পিঁপড়া বোটি/ তেরে মামা লাড্ডু লায়া/ লাল দরজা খোল দে, লাল দরজা খোল দে”। ছবির পরিচালক বুদ্ধদেব দাশগুপ্ত। তাঁর চলচ্চিত্রের সঙ্গে পরিচয় হবে কলেজজীবনে। খানিক নিজের প্রয়োজনেই পরপর দেখব ‘বাঘ বাহাদুর’, ‘তাহাদের কথা’, ‘চরাচর’, ‘উত্তরা’। তারওপর দেখব ‘জানালা’, ‘আমি ইয়াসিন আর আমার মধুবালা’। সিনেমা নয়, রূপোলি পর্দায় কবিতা লিখছেন বুদ্ধদেব। আড়ালে যে এক গভীর কবিসত্তা কাজ করে, বুঝলাম ‘কফিন কিম্বা সুটকেস’ বইটা পড়ে।

সিনেমায় কবিতা আর কবিতায় সিনেমা — আমার জীবনে বুদ্ধদেব দাশগুপ্ত এলেন বন্ধু হয়ে। যা ভাবি, যা দেখি, যা করি— সবেতে ওই লাল দরজার পিঁপড়েগুলো। কেউ গায়ে ওঠে, কেউ রেলগাড়ির মতো চলে যায়, কেউ খুব বিরক্ত করে। বুদ্ধদেববাবু শেখালেন জীবন কত বৃহৎ, কত আশ্চর্যের। তাই বিশেষ কোনো ব্যাকরণে ফেলা যাবে না তাঁর শিল্পকে। ‘তাহাদের কথা’য় শিবনাথ জঙ্গলের মধ্যে আয়না খুঁজে পায়, ‘টোপ’-এ রাজা আসেন জলে ভেসে, ‘উড়োজাহাজ’-এ মৃত মানুষদের আশ্চর্য বেঁচে থাকা থাকে। বুদ্ধদেব দাশগুপ্তের প্রয়াণ আমাদের সকলের ব্যক্তিগত ক্ষতি। ম্যাজিক রিয়েলিজমের মধ্যে দিয়ে কীভাবে ঘর করা যায় আর সেখানে টানটান করা বিছানা, চাদর, বালিশ, আদর সবই থাকে ভিন্ন মেজাজে।

আঙ্গিকের দশ বছর পূর্তি সংখ্যার কাজ শুরু করেছি। বুদ্ধদেববাবুর কবিতা চাই। ওঁকে ফোন করলাম। ধরলেন। ভাঙা ভাঙা গলা। বললেন, ‘কবিতা দেব সুমন। লিটল ম্যাগাজিনে কেউ লিখতে বললে খুব ভালোলাগে। কিন্তু আমি একটু অসুস্থ। ঠিক পাঠিয়ে দেব।’ তারও কিছুদিন পর মেসেজ করলাম, কবিতা পাঠালেন না এখনও! উত্তর এল না। ৮ ও ৯ তারিখ মিলিয়ে মোট তিনবার ফোন করলাম। ধরলেন না। ১০ তারিখ সকালে খবর পেলাম, মারা গেছেন।

মৃত্যুই বোধহয় একমাত্র সহজ পথ। বাকিটা ভেসে থাকা। ঝুলে থাকা। আটকে থাকা। কোনো সংখ্যা বেরনোর আগে আঙ্গিকের বন্ধুরা জিজ্ঞাসা করেন, এই সংখ্যার আকর্ষণ কী? এবার অনেককে বলেছিলাম, বুদ্ধদেব দাশগুপ্তের কবিতা। ‘আকর্ষণ’ শব্দটা যে কী ভয়ানক আর ক্ষতিকারক বুঝিনি। আজ এই লেখা লিখতে গিয়ে বুঝছি। আর কোনোদিন এই শব্দটা ব্যবহার করব না, কথা দিলাম স্যার।

পেশায় সাংবাদিক হওয়ার ফলে একবার সুযোগ হয়েছিল ওঁর একটি দীর্ঘ সাক্ষাৎকার নেওয়ার। গতবছর লকডাউনে ওঁকে ফোন করেছিলাম। কত কথা সেবার। কী লিখছেন, কী ভাবছেন, কী বই পড়লেন নতুন। বলেছিলেন, “আমার ছবি হাউসফুল হয় না দিনের পর দিন। যে দেশে বসে ছবিটা বানাচ্ছি, আমি চাই সেই দেশের মানুষ ছবিটা দেখুক। কিন্তু তার জন্য আমার কোনো অতৃপ্তি নেই।” গলায় অভিমান ছিল না। ছিল জেদ। আর আরও কাজ করার ইচ্ছাশক্তি।

ওঁর কাজ দেখে নতুন করে চিনি কুরোসাওয়া, তারকোভস্কি, কিয়ারোস্তামি-দের। বাংলায় ব্যাকরণহীন ছবি ক’জনইবা বানিয়েছেন! বুদ্ধদেব দাশগুপ্তের প্রয়াণ আমার ব্যক্তিগত ক্ষতি। সূচিপত্রের প্রথমেই জ্বলজ্বল করছে তাঁর নাম। থাক। একটা নাম মুছে দেওয়া কি অতই সহজ? কীইবা হবে মুছে দিয়ে? আপনাকে নিয়েই শুরু হোক আঙ্গিকের এই সংখ্যা।

কলকাতা চলচ্চিত্র উৎসবে নন্দন ১-এ দেখেছিলাম ‘উড়োজাহাজ’। দেখেছিলাম মানুষ নয়, কথা বলছে পাহাড়, বাঁশি, জল, গাছ। একজন মৃত মানুষের মুখে বুদ্ধদেববাবু সংলাপ বসাচ্ছেন, “কতো লোক কতো কী খায়, আমি তো শুধু একটু ভাত খেতে চেয়েছিলুম, ভাতের স্বপ্ন দেখেছিলুম! এখন বুঝতে পারি, এই পৃথিবীতে স্বপ্ন দেখা খুব খারাপ।” এটাই ছিল বুদ্ধদেব দাশগুপ্তের আশ্চর্য উড়ান। বাংলার মানুষ তাঁকে না চিনলেও বিশ্ব তাঁকে সম্মান জানিয়েছে। আর আমরা বাঙালিরা এরপর থেকে যেন গর্ব করে আজীবন বলতে পারি, আমাদেরও একজন বুদ্ধদেব ছিল।

(বুদ্ধদেব দাশগুপ্ত কথা দিয়েছিলেন আঙ্গিকের সাম্প্রতিক সংখ্যায় দুটি কবিতা দেবেন। আমরা সেই লেখা থেকে বঞ্চিত হলাম। সূচিপত্র আগেই তৈরি করা হয়েছিল, তাই ইচ্ছা করেই সেখান থেকে ওঁর নাম সরানো হল না। মনে মনে জানলাম তিনি আছেন।)


[সংখ্যাটি সম্পাদনার কাজে সহায়তা করেছেন সৌরভ দাস। তাঁকে আন্তরিক ধন্যবাদ।]

মন্তব্যসমূহ

জনপ্রিয় লেখা