প্যালেস্টাইনের সিনেমা | সিদ্ধার্থ মাইতি | আঙ্গিক


য়েক সপ্তাহ আগেই প্যালেস্টাইন খবরে ছিল। রক্তাক্ত সে খবর। ৫০ বছরের বেশি ধরে অধিকৃত প্যালেস্টাইন! সে দেশ নিয়ে সিনেমা, সে দেশের মানুষের নিজেদের যন্ত্রণাকাতর প্রামাণ্য চিত্র, কাহিনি চিত্র দুই নিয়েই এই প্রতিবেদন।

প্রথমে দেখে নিই প্যালেস্টাইন নিয়ে সেখানকার লড়াকু জীবনযাত্রার অত্যাচারিত জীবনের ছবি।

The Present (২০২০)। ফারহা নাবুলসি। ১৯৬৭-র আরব ইজরায়েল যুদ্ধের সময় ফারহার মা কুয়েত হয়ে প্যালেস্টাইন থেকে পালিয়ে লন্ডন এসেছিলেন। বাবা এসেছিলেন ইজিপ্ট থেকে লন্ডনে সিভিল ইঞ্জিনিয়ারিংয়ে পিএইচডি করতে। মায়ের প্রতিবাদী চরিত্রের প্রভাব পড়েছিল ফারহার জীবনে।  লন্ডনের পুরুষ শাসিত স্টক এক্সচেঞ্জে ফারহা লড়ে যাচ্ছিলেন। মা সবসময় মনে করিয়ে দিয়েছেন প্যালেস্টাইন আমাদের পিতৃভূমি। ১৯৮৭-র ইন্তেফাদার আগে ওঁরা সপরিবারে প্যালেস্টাইন ঘুরতে যেতেন। তারপর এই ২০১৪ সালে ফারহা ওয়েস্ট ব্যাংকে গেছিলেন। এবং সে এক ভয়াবহ অভিজ্ঞতা। এবং কোন এক বন্ধুর প্রস্তাব ছিল ইন্ডিপেন্ডেন্ট উওম্যান ফিল্মমেকার হয়ে ওঠার।  ওয়েস্ট ব্যাংক প্যালেস্টাইনের অঙ্গ ইজরায়েলের নয়৷ তৎসত্ত্বেও একশোখানা চেকপোস্ট, হ্যাঁ শুধু ওয়েস্ট ব্যাংকেই একশোখানা চেকপোস্ট। জেরা আর তল্লাশি। চারদিকে পাঁচিল পাঁচিল পাঁচিল। আবাসিকদের থেকে জীবিকার জায়গার মাঝে পাঁচিল। এবং চেকপোস্ট। ইস্কুলে যাওয়ার পথে পাঁচিল। এবং চেকপোস্ট... প্যালেস্টাইনবাসীদের জন্য চলাচলের আলাদা রাস্তা। আলাদা নাম্বার প্লেট তাদের গাড়ির। ফারহা নেবলুস দেখে এলেন এক অসহায় মাকে। মাঝরাতে তার তেরো বছরের মেয়েকে তুলে নিয়ে গেছে সেনাবাহিনী। চেকপোস্টে বসে কাঁদছেন মা। ফারহা সিদ্ধান্ত নিলেন ছবিই বানাবেন। ছবির নাম The Present! কুখ্যাত চেক পোস্ট নাম্বার তিনশোতেই শ্যুটিং হল। চেকপোস্ট থেকে খানিক দূরের বাড়ি। বাবা আর মেয়ে মায়ের জন্মদিনে উপহার কিনতে বেরিয়ে চেকপোস্টে আটক হলো বাবা। কিশোরীর সামনে শুরু হলো জেরা ও তল্লাশির নামে অমানবিক অত্যাচার।  কিশোরীর চোখের সামনে তার বাবার অকল্পনীয় অসহায় অস্তিত্ব! এই নিয়েই কুড়ি মিনিটের কাহিনি চিত্র। এক জীবন্ত দলিল। অস্কারের জন্য মনোনীত হয়েছিল এই ছবি। অবশ্যই ক্যামেরা এখানে হাতে হাতে ফেরে। চেকপোস্টের আধো অন্ধকারে বাবার ওপর প্রত্যেকে আঘাতে নির্যাতনে ক্যামেরা কেঁপে কেঁপে ওঠে। কিশোরীর চোখে জমা হয় একটা দলিল!

এবার আমরা চলে যাই লন্ডন থেকে আমেরিকার ওহাইও। চেরিয়ান দাবিস জন্মেছেন এই শহরে। বাবা উদ্বাস্তু। মা জন্মেছেন জরডনের কাছে এস সল্টে।তারপর চলে এসেছিলেন ওহাইও শহরে। আট বছর বয়সে বাবা-মার সঙ্গে প্যালেস্টাইন যাওয়ার পথে চেক পোস্টে বারো ঘণ্টা আটক থাকলেন। দাবিস এবং তাঁর কচি বোনেদের ও তল্লাশির নামে উলঙ্গ করা হল। দাবিস উপলব্ধি করলেন একজন প্যালেস্টাইনিয়ান হওয়ার অর্থ কী! অথচ তাঁরা আমেরিকার মানুষ। চেরিয়ান দাবিস আমেরিকার আদব কায়দা আচারে নিজেকে গড়ে তুললেও প্রতিদিন বুঝতে পারছিলেন আমি Arab in America!

গাল্ফ যুদ্ধ শুরু হল ডাক্তার বাবার রোগী কমতে লাগলো। আশেপাশের লোকজন মাকে Arab Bitch অভিধা দিল। সিক্রেট সার্ভিসের লোকজন তাঁর কল্পিত ভাইয়ের খোঁজে শুরু করলো অত্যাচার। সেই ভাই নাকি সাদ্দাম হোসেনের বাহিনীতে যোগদান করেছে। তার বোন আমেরিকান প্রেসিডেন্টকে খুনের ষড়যন্ত্রে লিপ্ত। অবাস্তব সব অভিযোগ।  তখন থেকেই তাগিদ হলো দুনিয়াকে জানাতে হবে আমেরিকায় আরবদের অবস্থা এবং আরবে আমেরিকানদের বাস্তব পরিস্থিতি। দুটো ছবি তৈরি হলো। Amreeka এবং May in The Summer!

 
Amreeka ২০০৯-এ নির্মিত এক ঘণ্টা সাঁইত্রিশ মিনিটের ছবি। মুনা স্বামী পরিত্যক্তা ব্যাংক কর্মচারী। হাদি ইস্কুলে পড়ে কিশোর। এ ছবিতেও শুধু পাঁচিল আর চেকপোস্ট। প্রতিদিন বেথেলহেম থেকে কাছের শহরের কর্মক্ষেত্রে ইস্কুলে যাতায়াতের পথে একের পর এক চেকপোস্টে তল্লাশি এবং জেরা। আচমকা সুযোগ এসে গেছিল আমেরিকা যাওয়ার। কিশোরের চোখে উল্লসিত স্বপ্ন আমেরিকা! স্বপ্নের আমেরিকা!  মুনাকে ইচ্ছের বিরুদ্ধেই প্রায় আমেরিকা যেতে হচ্ছে। চেকপোস্টে হাতে ধরা ক্যামেরায় কাতারে কাতারে গাড়ি। বেরিয়ে যাওয়ার পথে চেক পোস্টের কাছে এক কিশোরের হাতে কালো কাপড়ে তৈরি মস্ত আরবি ঘুড়ি! মুনা অভিবাসন দপ্তরে প্রশ্নের মুখোমুখি, What is your occupation? মুনার উত্তর, Yes for the last forty years! এবার আবার প্রশ্ন, what do you do? উত্তর, Oh I am a bank worker!  ইলিনয়ে বোনের বাসায় উঠতে না উঠতে বুঝলেন জামাইবাবু ডাক্তার কিন্ত আরবি বলে রোগী কমছে। মুনা কাজের সন্ধানে যেখানেই যাচ্ছেন প্রত্যাখ্যাত হচ্ছেন এবং পেছন ফিরলেই শুনছেন Arab Bitch!

 
‌হাদি ভুলে যাচ্ছে তার প্যালেস্টাইন ইতিহাস। কয়েক সপ্তাহের মধ্যেই মাকে বলছে, Fuck up! I hate Palestine! হাদির মাস্তুতো বোন শিখিয়েছে Forget Arab, Irak, Palestine! মুনা রেস্তোরাঁয় সেলস গারল কাম সুইপার হয়ে বোনের সংসারে কিছু দিতে প্রাণপাত করছেন। মুনা নিজেকে খুশি দেখাতে চায় নিজেকে। কিন্তু তার ইতিহাস! ক্লোজ মিড ক্লোজ মিড লং এইভাবেই ক্যামেরার ফ্রেম। ট্রলি বা ক্রেনের ব্যবহার নেই-ই প্রায়। সারাক্ষণ আপনার মনে হবে আপনি পাঁচিল ঘেরা বন্দি। মুনা চরিত্রে Nisreen Faour শ্রেষ্ঠ অভিনেত্রী পুরস্কারের জন্য মনোনীত হয়েছেন। ২০০৯-এ কান ফিল্ম ফেস্টিভ্যালে FIPRESCI CRITICS AWARD পেয়েছে।

Mayor

প্যালেস্টাইনের পরিচালক মির মোহম্মদ যাকুবির প্রামাণ্যচিত্র Revolution Till Victory এডিট করতে করতে প্যালেস্টাইন সম্পর্কে আগ্রহী হয়েছিলেন ডেভিড ওতাস। আমেরিকান নাগরিক ডেভিড তার আগে কয়েকবছর কায়রোতে পড়াশোনা করেছেন, গবেষণার কাজ করেছেন। প্যালেস্টাইনের চলচ্চিত্র নির্মাতাদের ছবি এডিট করেছেন আর পাশাপাশি দেখেছেন সারা দুনিয়ায় কাছে প্যালেস্টাইন মানেই সন্ত্রাসবাদী হিংসায় আচ্ছন্ন কিছু মানুষ! এলিয়া সুলেইমান প্যালেস্টাইন সিনেমার অভিনেতা এবং পরিচালক। তাঁর Divine Intervention দেখে হতবাক হয়েছেন। মৃত্যু ধ্বংস আর আর্তনাদের মাঝেও মানুষ বাঁচছে। সুলেইমান অনবরত এক একটা ডার্ক কমেডি বানিয়ে চলেছেন। এমন একটা সময়ে ডেভিড রামাল্লাহর মেয়র মুসা হাদিদ-এর কথা জানতে পারলেন। আইন মোতাবেক রামাল্লাহ্ র মেয়র খ্রিস্টান ধর্মাবলম্বী হবেন। যদিও রামাল্লাহ্ অধিকৃত প্যালেস্টাইনের অঘোষিত রাজধানী! যে কোন প্যালেস্টাইন ছবি নির্মাতাকে মুসার কথা জানতে চাইলেই শুনেছেন উনি এক অদ্ভুত মানুষ। মহান ব্যক্তি। ওঁকে না দেখলে বিশ্বাস করা যায় না।


ডেভিড সিদ্ধান্ত নিয়ে বসলেন one man army হয়েই তিনি মুসা হাদিদের ওপর প্রামাণ্যচিত্র বানাবেন। এক ঘণ্টা ছাব্বিশ মিনিটের ছবির তিনিই ক্যামেরার দায়িত্বে, এডিটর তিনি। অবশ্যই সংগীত পরিচালনা এবং পরিচালনা। তাঁর। তিনি দু বছর থেকে গেলেন রামাল্লাহ্ য়। হয়ে উঠলেন রামাল্লাহ্ র অধিবাসীদের নিকট আত্মীয়। মেয়র কার্যালয়ের প্রত্যেক কর্মী, কাউন্সিলর তাঁকে সহযোগিতার হাত বাড়ালেন। মুসা চাননি ছবিটি তাঁর জীবনী হয়ে উঠুক। ওতাসও চাননি কি রামাল্লাহ্ বা মুসার ওপর প্রামাণ্যচিত্র। দলবল নিয়ে শ্যুটিং করলে আন্তর্জাতিক সংবাদ এজেন্সির কয়েক ঘণ্টার ঝটিকা সফরের খণ্ড চিত্র হয়ে ওঠার ভয় ছিল। এঁদের যে কোনও প্যালেস্টাইনবাসী অপছন্দ করে।


রামাল্লাহ্ র চারপাশে ইজরায়েলি সেনার বিরাট বিরাট ব্যারাক। অবরুদ্ধ! রামাল্লাহ্! মেয়র আন্তর্জাতিক কূটনীতিক সমাবেশে জানান একটা কবরস্থান করতে পনেরো বছর লাগে তার অনুমতি পেতে। যিউদের জন্য একটা ধর্মস্থান করার অনুমতি জোটে না।

‌শহরের শিশু থেকে বৃদ্ধা প্রত্যেকের আপনার মানুষ মেয়র। রামাল্লাহ্ শহরের যে কোন সংকটে অকুস্থলে মেয়র নিজে চলে যান।হাত লাগিয়ে কাজ করেন। ডেভিড দেখেছেন অবরোধ হিংসা সন্ত্রাস মৃত্যু সব কিছু নিয়েই রামাল্লাহ্ র মানুষকে মেয়র বেঁচে থাকার স্বাদ, সুস্থ স্বাভাবিক যাপনের রসদ যুগিয়ে চলেছেন। হ্যাঁ, হিংসা সন্ত্রাস অবরোধ নিয়েই শিশুরা তাদের বাবা মা সব্বাই বাঁচবেন। জেরুজালেমে তাদের অধিকার ভুলবেন না কেউ। প্যালেস্টাইন তাদের পিতৃভূমি, এ তারা সারাক্ষণ মনে রাখবেই। কারণ সীমা ঘিরে আছে প্রতিদিন উঁচু হতে সেনাবাহিনীর ব্যারাক! কোনও একদিন রাতে ব্যারাক থেকে সাঁজোয়া গাড়ি নিয়ে ইজরায়েলি সেনারা আসে। শহরের কেন্দ্রের মেয়র অফিস সিটি হাউসের সামনের রেস্তোরাঁয় ঢুকে পড়ে সেই সেনার দল। কয়েক মিনিট তারা  অকারণ অনধিকার গোলমাল করে। মেয়র তাঁর সিটি অফিসের সহকর্মীদের নিরাপদে রেখে নিজে সামনে থাকেন। ভিনদেশী সাংবাদিক সেনাদের ছড়িয়ে দেওয়া টিয়ার গ্যাসে নাজেহাল হলে মেয়র শুশ্রূষা করতে ব্যস্ত হয়ে পড়েন। ডেভিড জানতেন তিনি প্রামাণ্যচিত্র করছেন কিন্তু মানুষ উপাখ্যান চায়। গল্প৷ শুনতে চায়। তাই ক্ল্যাসিক্যাল হলিউড সেই মতো করেই শুরু করেন তিনি। ক্লাইম্যাক্স গড়ে ওঠে যখন সেনাবাহিনী হানা দেয়। রেস্তরাঁর বোবা কর্মচারীকে যখন সেনারা মারধোর করছে মেয়র স্বগতোক্তি করেন বেচারা! বোবা মানুষটা কিছুই জানে না। ওরা ওকে কেন মারছে!

সেনাবাহিনীর খামখেয়ালি সন্ত্রাসের শেষে মেয়র আন্তর্জাতিক সাংবাদিকদের জানান, I know Palestine is Occupied! But what witnessing Ramallah  these days is an attempt to humiliate us! And to show us they are always here.. But this will always our response.. Whatever you do this land is ours this  city is ours..All your attempts to control us will fail! এই গাঢ় বিশ্বাসের মানুষটিই মেয়র এবং ডেভিস যদিও তাঁর সাক্ষাৎকারে বলেন terminal illness-এ আক্রান্ত মানুষকে নিয়ে এক সময়ের পর বাইরের লোকেরা মজা করেন, হাসিঠাট্টা করেন কারণ তাঁর অনিবার্য মৃত্যু অত্যন্ত স্বাভাবিক একটা নিষ্পত্তি। occupation of Ramallah is also like terminal illness, they laugh about peoples reaction!
ডেভিড যে মেয়রকে দেখাতে পেরেছেন আপনার আমার মনে হবে লড়াই মানে কান্না নয় হাসতে হাসতে লড়ে যাবো। দুবেলা মরার আগে মরবো না ভাই মরবো না।

ডেভিড সংগীত আবহ পরিচালনা করেছেন। ধার করেছেন জাপানি লোকসংগীত ও ধ্রুপদী থেকে। ছবি নির্মাণের আগে থেকেই ডেভিড তাঁর চেতনায় বহুদিন আগে শোনা সংগীতের সঙ্গে মেলাতে শুরু করেছিলেন। তাঁকে প্রভাবিত করেছে চেক নিউ ওবের। তাঁকে ভাবনা জুগিয়েছে ইরানের পরিচালক আবের কিরিওস্তামি। যাক তাতি। ত্রাভানিয়া ব্রাদার্স–
একটা ব্ল্যাক কমেডি যে প্রামাণ্য চিত্রের সীমানায় ঢুকে পড়ল আপনারা দেখলে বুঝবেন! ডেভিড বলছেন প্রামাণ্যচিত্র কেন গল্প উপাখ্যান বলবে না! তথাকথিত fictions এ যদি প্রামাণ্য খাঁটি বাস্তবকে সাজিয়ে তোলা যায় সেটাও fiction movie হয়ে উঠবে...

যে যে ছবি নিয়ে যা যা বলেছি ইন্টারনেট থেকেই। যে কেউ সে সবের হদিস চাইলে পাবেন। সম্পাদক চাইলে এই একই ছবি (মানে যে তিনটি ছবি নিয়ে লেখা পড়লেন), যদি কেউ প্রত্যেকটা দেখে নিজের মতো লেখেন, তিনটে ছবি নিয়ে যদি ন’জনও উৎসাহী হয়ে নিজেদের দ্যাখা লেখেন, তবে মজার ধারাবাহিক হয়। সিনেমা নিয়ে এ পরি কৌতূক এর আগে হয় নাই।

মন্তব্যসমূহ

দেবাঞ্জন দাস বলেছেন…
প্যালেস্তাইনের ছবি নিয়ে লেখাটা পড়লাম। কিছু অতৃপ্তি থেকে গ্যালো। কিন্তু হ্যাঁ ছবিগুলো দ্যাখার ইচ্ছে তৈরি হল--এটাই পাওনা এই লেখার। লেখককে ধন্যবাদ।

জনপ্রিয় লেখা