আদিদেব মুখোপাধ্যায়ের দুটি দীর্ঘ কবিতা | আঙ্গিক


রবীন্দ্র সরণী, 09:00


শান্তনুকে দেখি; অটোর ফাঁকায় ওর মুখ; ... ভাঙা বাড়িটা ছেঁচড়ে যায়, ব্লেড দিয়ে গালে টান দেওয়ার চিড়চিড়... অল্প, ঠিক দু’ফোঁটা রক্ত; ...শান্তনুকে ‘ঐ দ্যাখ বাড়িটা কেমন ভেঙে’ বলাতে, মুখ এগিয়ে দেয়; অনেকখানি হাওয়া... হা-হা চোখে আর মুখে লাগে – শান্তনু ক্রমশ ফেটে ছড়িয়ে পড়ল, বেলুনের মতো ওর মাথাটা বেড়ে উঠছে – এরম আরো ভাবনা... অটো ক্রিঁচ্চচ ক’রে শব্দ ক’রে ওঠে। পায়ের তলা দিয়ে কিছু গোল, রোঁয়াওলা আর ছোটো-ছোটো জিনিস গড়িয়ে যায় – সামনে ঝুঁকে পড়ে—

খাদ এবং ক্রমশ আরো খাদ... আমি মুখটা বাড়িয়ে যতটা দেখবার দেখছি; আঁধার, আগুন, রক্ত... ব্যান্ডপার্টির জুলুস, দামামা... চোখ ঝলসে যায়, আলোরা ফেটে ছোটো বুদবুদ হয়েছে – নীল  বুদবুদ... সোনালি বুদবুদ... কয়েকটা ভারি মাথা – বহাল সার্জেন্ট দূর থেকে ‘রোককে!’ ব’লে উঠছে – ভাঙা বাড়িটা খিদেয় রাক্ষস... বোবাও এখন চিৎকার করে-

শুধুই ইঁটগুলো পড়ে থাকে; - সময়গুলো। চাঙড় ভেঙে পড়েছে যত্রতত্র - ‘সাবধান!’ বলতে যাই আর এদিকে অটো আমার কোনো কথাই শুনবে না মনে হচ্ছে – শান্তনু ঠোঁটে আঙুল দিয়ে চুপ করতে বলে, ওর পাথর-মুখ আমি শ্রদ্ধায়, বিহ্বলতায় খুবলে নিতে চেয়ে আঙুলগুলো বাঁকাই – শক্ত ওরা নরমে বসে যাবে... একটা ছায়াকে দেখি হুড়মুড়িয়ে ভেঙে পড়তে... ও ঠাকুর   

গোঙানি... ইচ্ছে... সুখ – এছাড়া কী? আমরা মাগীবাড়ি অবধি যেতে রাজি, লোভে প’ড়ে মৃত্যু অবধি গেছি! আঁধার, রক্ত, আগুন, হর্ন, মাথা, মাথা, মাথা – এসব নয়; সিল্কের শাড়ি, ড্যাম্প দেওয়াল, শুকনো গাঁট, মরা চোখ... এসব নয়; – মৃত্যু খুব ঠাণ্ডা, ঘুমকাতুরে! শান্তনু হারিয়ে গেছে – তাকে ফিরে আসতে বারবার ডাকি; শার্ট-প্যান্ট ঘামে ভেসে যেতে থাকে। দুফোঁটা রক্ত – কার?... বারবার মুখ ফেরাই, দেখতে পাই না- 

চুল থেকে টপটপ টপ ক’রে জল গড়ায়; শিরার মধ্যে ঘুরপাক খায় সরু ছুঁচ... ভলক দিয়ে রক্ত বেরিয়ে যাচ্ছে। আমি হাঁটু গেড়ে কাঁদতে বসি ... ‘কেন? কেউ মরে গেছে?’ কারা জিজ্ঞেস করে আমায়। - ভাঙা বাড়িটা, ওর হা-হা করতে-থাকা সাংঘাতিক খিদে, এক বিশাল বোবা দমবন্ধ অন্ধকার... এ ছাড়া কিছু মনে আসে না, মনে পড়ে না, মনে লাগে না। ...বাড়িটা হা-হা করে। 



সুখ সম্পর্কে 


আঃ পরম আমায় তুমি স্বয়ং পরম ক’রে তোলো।

আজও আঘাত, চিন্তা, গুনগুন...  ইতিহাস একটা মনোটোন   জগৎ এক ফাঁকা পরম কিছু নয়

শুধু - গুহাগর্তের অন্তরে জ্বলজ্বলে চোখ যেমন – অসম্ভব বাসনা রয়ে গেছে।

একটি অলৌকিকের কত মাস অপেক্ষা! – আমায় একবার বিদেশ যেতে হবে। তুমি চাও আর তুমি এক লক্ষ বিদেশ ঘুরে আসো। 

এই বাস্তব ভঙ্গুর, ছিদ্রওলা, কৌণিক, অবতল। শ্বাস প্রশ্বাস তোমায় আলো ক’রে আছে। ...রিক্ত শীত, ঠোঁটের মামড়ি।

বাঁচো, ঘুরে ঘুরে দ্যাখো নিজেকেই, নাচের ভঙ্গিতে থাকো আর বাঁকা জগৎ এক অপরিসীম আয়নায় চুরমার হয়ে যাক। শিরশির জাগে, কারো গ্রীবা তুমি ফিরিয়ে দাও, ...খোঁপার আঘাত, ফুল, নিঃশ্বাস।

বিছানায় শুয়ে থাকি আর বারবার সে চুলের গন্ধ নিয়ে যায়। - জানলায় গলন্ত আলো। আর কী শাদা। শিশুর খুশি দুলে ওঠে। স্বরবর্ণ, চোখের জল।

এ অনেক ভালো যে এখনও বেঁচে আছ। কেননা মরে ‘থাকা’ যায় না, তার সঙ্গে ‘নেই’–এর সম্বন্ধ।  হারানো গন্ধ। 

মাঝে মাঝে একটা দরজা খুলে যায়। প্যাসেজগুলো পেরিয়ে আসা। বাসনের সুর, ঝনঝনানি? ভেঙে পড়ার শব্দ।

লেখা বড়ো সর্বনাশা খেলা। হাত পুড়বার ভয়, মর্ষকাম!

কান্না ছাড়া আর কিছুই থাকে না...  তার সামনে তোমরা জোর হারিয়ে একেকটা লহমা হয়ে যাও। - অজস্র, অজস্র কান্না। 

এই জীবনে কিছুদিন ছুটি কাটাতে এলে। ছুটি শেষ হলে আবার বাড়িতে ফিরে যেতে হবে। কত সহজ।

সুন্দর এই ছুটি, সুন্দর স্বপ্নের এই আগুন যা থিরথির ক’রে দেওয়ালে কাঁপে।

দূরের বাড়িতে আলো জ্বলে ওঠে আর এই শাদা, লাজুক আলোই টুকরো টুকরো হবে যখন সময় রাত, যখন তোমরা অসহায়... যখন বৃষ্টি, বৃষ্টি, বৃষ্টি।

ছোটোবেলা থেকে নৌবহর উঠে দাঁড়াবে। আকাশ ছোঁওয়া আলোর স্তম্ভ; তোপের গুড়ুম; হাসি... ছেঁড়াখোঁড়া; মুখ... ঘোলাটে; হাতছানি...?

ঘুম আমাদের মা... সবাইকার গর্ভ।

পায়ের ছাপ এত অবধি। বাকি জল ধুইয়ে দিচ্ছে।  

মন্তব্যসমূহ

জনপ্রিয় লেখা