কবি প্রশান্ত মল্ল’র সাক্ষাৎকার এবং একগুচ্ছ কবিতা | আঙ্গিক


মূল ধারার বাংলা কবিতা থেকে প্রশান্ত মল্লের সৃষ্টি খানিক আলাদা। গ্রামের নির্জন শ্মশান, মেঠো পথ, কালী সাধনা, বৈষ্ণব দর্শন — এসব নিয়ে তিনি মায়ার জগৎ নির্মাণ করেন। ‘গৌর নিতাই গাছ’, ‘ভাঁজো লো কলকলানি’ এবং ‘মাকাল ঠাকুর’ — তিনটি কাব্যগ্রন্থই সমাদৃত। ভূষিত হয়েছেন বিনয়পদকে। যদিও প্রচার থেকে দূরে থাকতেই ভালোবাসেন পূর্ব বর্ধমানের ক্ষীরগ্রাম নিবাসী এই কবি। করোনাকালে যখন গণপরিবহন বন্ধ, ঘরে বসে জীবন ওষ্ঠাগত, তাঁকে একদিন ফোন করলেন আঙ্গিকের বন্ধু শ্রেয়ণ। প্রাণ খুলে আড্ডা দিলেন। তারই সংক্ষিপ্তসার এখানে রইল।

প্রশ্নঃ কবিতার জগতে আপনি কীভাবে পা রাখলেন?

উত্তরঃ ৭৮-৭৯ সালের কথা। আমাদের এখানে একজন কবিতার চর্চা করতেন। নাম সুব্রত চৌধুরি। তাঁর থেকেই আমার ঝোঁক এসে গেল কবিতায়। বিভিন্ন কাব্যগ্রন্থ পড়তে লাগলাম। তারপর ধীরে ধীরে লিখতাম। সেই লেখা দাঁড়ায়নি। আমারও ভালো লাগেনি একটা সময়ে৷ এভাবেই এগিয়ে গিয়েছি।


প্রশ্নঃ আপনার কবিতায় ভারতীয় দর্শন, তন্ত্র সাধনা উঠে আসে। তখনকার লেখাতেও কি এইসব উপাদান ছিল?

উত্তরঃ না। তখন খুব শক্তি চট্টোপাধ্যায় পড়তাম। তাঁর যে লিরিক্যাল ব্যাপারটা ছিল — একই কথা বারবার বলা, কিছু আঞ্চলিক শব্দের ব্যবহার — এগুলো আমার লেখাতেও আসত। তার মধ্যে কিছু ভালো কবিতাও ছিল৷ সেগুলো সব হারিয়ে ফেলেছি। এখন ভাবি, সেগুলো থাকলেও খুব একটা ক্ষতি হত না, আমাকে বোঝা সহজ হত। কয়েকটা এখনও পাওয়া যাবে স্থানীয় পত্রপত্রিকায়। ‘যোধন’ বলে একটা পত্রিকা ছিল, আমরাই করেছিলাম আশির দশকে। এখন নাম হয়েছে ‘আজকের যোধন’। তাতেও আমার কবিতা প্রকাশিত হত। 


প্রশ্নঃ শক্তি চট্টোপাধ্যায় ছাড়া আর কার কবিতা ভালো লাগত?

উত্তরঃ শক্তি পড়তাম, সুনীল পড়তাম, শঙখ পড়তাম। তারপর হঠাৎ একদিন মণীন্দ্র গুপ্তকে পেয়ে গেলাম। ‘লাল স্কুলবাড়ি’ কাব্যগ্রন্থ খুব ভালো লাগল।  এই সময় থেকেই লেখা বদলাতে থাকে।


প্রশ্নঃ তন্ত্র, বেদান্ত কিংবা বৈষ্ণব সাধনার যে নির্যাস আপনার কবিতায় পাওয়া যায়, তার শিকড় কীভাবে এল? 

উত্তরঃ ঠিক কীভাবে এল বলতে পারব না। এখন লক্ষ করছি একটা যেন পরিকল্পনা হয়ে গিয়েছিল। যেমন ‘গৌর নিতাই গাছ’ কাব্যগ্রন্থে বৈষ্ণব দর্শন। ‘ভাঁজো লো কলকলানি’-তে পাবে তন্ত্র। আবার ‘মাকাল ঠাকুর’-এ দেখবে বেদান্ত দর্শন। সবকিছুর মধ্যে একটা শাশ্বত ব্যাপার আছে। যা আমি অনুভব করি। তবে আমি কিন্তু তন্ত্রের বই পড়িনি। মুকুন্দরাম চক্রবর্তী পড়েছি, ভারতচন্দ্র পড়েছি, বৈষ্ণব কাব্য পড়েছি — তার প্রভাব হয়তো পড়েছে।


প্রশ্নঃ আপনি যেখানে থাকেন, সেই ক্ষীরগ্রামেও তো আধ্যাত্মিক ঐতিহ্য আছে। আপনার কবিতায় নিশ্চয়ই পড়েছে তার প্রভাব!

উত্তরঃ ক্ষীরগ্রাম হল যোগাদ্যাপীঠ। সতী মায়ের বৃদ্ধাঙ্গুষ্ঠ পড়েছিল। কৃত্তিবাসের লেখাতে উল্লেখ আছে। এখানে আমি এখানে বেড়ে উঠেছি। আমার অভিজ্ঞতার ছাপ কবিতায় পড়েছে। অভিজ্ঞতার বাইরে কিছু লিখতে পারি না। 

প্রশ্নঃ আপনি নিজে যোগসাধনা করেছেন?

উত্তরঃ আমি প্রকৃতিকে দেখতাম। নদীর ধারে বসে থাকতাম। পুরোনো মন্দির, গাছের তলায় পাথরের উপাসনা — এগুলো খুব টানত। এখনও লকডাউনের সময় সাইকেল নিয়ে বেরিয়ে যাই। নদী দেখি। পঞ্চমুণ্ডির আসনে বসা বা শবসাধনা — এগুলো করিনি কখনও৷ কিছুটা জানা, কিছুটা শোনা আছে এসব ব্যাপারে।  কবিতায় কাজে লেগেছে৷ আমি রামকৃষ্ণ মিশনে দীক্ষা নিয়েছি স্বামী গহনানন্দের কাছে। বর্ধমান শহরে যে বাড়ি করেছি, নাম রেখেছি ‘গহনানন্দালয়’। মিশনের শেখানো যোগধ্যান করি নিয়মিত। 


প্রশ্নঃ তাহলে তো আপনি আমার গুরুভাই। আমিও স্বামী গহনানন্দের কাছে দীক্ষিত।

উত্তরঃ খুব ভালো। খুব ভালো। সন্ন্যাসীরা ধ্যান করেন মায়া কাঠানোর জন্য। কবি তো মায়া কাটানোর সাধনা করে না। মহামায়াকে ছুঁয়ে থাকি আমরা।


প্রশ্নঃ আপনার প্রথম কাব্যগ্রন্থ বেরোল কখন?

উত্তরঃ হিন্দুস্তান কেবল থেকে বেরিয়েছিল। তখন সেখানে চাকরি করি। প্রকাশ করেছিল ‘উত্তরকাল’ নামের এক পত্রিকা। 


প্রশ্নঃ কলকাতার কবিদের সঙ্গে আপনার যোগাযোগ আছে?

উত্তর : মণীন্দ্রদা, রঞ্জিত সিংহের সঙ্গে ছিল। শঙ্খবাবুর কাছে যাব ঠিক করেছিলাম। কিন্তু তিনি চলে গেলেন। দেবারতিদির সঙ্গে যোগাযোগ আছে। ‘মাকাল ঠাকুর’ তাঁকেই উৎসর্গ করেছি।

প্রশ্নঃ কবিতা নিয়ে পরবর্তী কোনো পরিকল্পনা আছে?

উত্তরঃ কিছু কবিতা ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে। দেখি বই করা যায় কিনা। এখন লেখা আসছে না। আবার অনেক সময় ১০-১২টা কবিতা একসঙ্গে চলে আসে।  তখন নানা বই পড়ি। 


(এখানে প্রশান্ত মল্ল’র কয়েকটি কবিতা দেওয়া হল। কিছু প্রকাশিত, কিছু অপ্রকাশিত।)


মিঃ পটেটো


দূর দর্শনে আলুচাষের

বক্তৃতা দিয়েছিলাম

কিয়দংশ এখন বলছি।


আউস ধান তোলার পর

কৃষ্ণ বর্ণের সিক্ত মাটি

যখন শ্বেতবর্ণা গতরময়ী হবে

তখন খুর খুর করে লাঙল দিন।


কর্ষিত মাটি কৃত্তিকা নক্ষত্রের হিম

নিওলিথ জোছনা

স্নিগ্ধ সূর্য কিরণ পাক।


এরপর ক্রমাগত লাঙল আর মই

মই আর লাঙল দিন।

ঢেলাগুলো ভাঙুন

নেড়াগুলো বাছুন

মাটি মিহি হলে

ঊর্ধ্বমুখ অংকুর রেখে

আলুবীজ বপন করুন।

হরিপদ ক্ষমাকর পাথর 

সুখকর চাষের কথা শুনুন।

শোনার পর প্রাণের পরিবর্তন এল।


ওদের পদাঙ্গুল 

গুচ্ছমূল হয়ে

কংক্রিট ভেদ করে 

মাটির নিচে চারিয়ে গেল।

গুলফ হাতে গ্রীবা গুল্মাকার হল

বদনমণ্ডল হল ঢলঢল পল্লব।


রূপান্তর দেখতে 

বিধানচন্দ্র কৃষি ইউনিভার্সিটির 

সবজি বিজ্ঞানের প্রধান

সদলে এলেন


পটেটো স্পেসালিস্ট 

সুমিতা বললেন: বন্ধুগণ

ফটোসিনথিসিসে দক্ষ


কয়েকমাস পর শুনলাম

আন্তর্জাতিক কৃষি প্রদর্শনীতে

পাথরবাবু

মিঃ পটাটো হয়েছেন।


সিঙারন নদীর তীরে

পত্নীরা ভাবে

পতিগণ প্রেমিক না হয়ে কেমন 

কেমন পটেটো হয়ে যায়! 


সাপ


জলধারা গতিতে চলল

গোমূত্র গতিতে চলল

শুঁয়োপোকা ঢঙে ঘরে ঢুকল।


নিদ্রিতা যুবতী 

মূহুর্তে চক্রচিহ্ন ফণা মেলে

লেজে ভর দিয়ে

ধনুকাকারে পিছনে হেলে

তীক্ষ্ণ ছোবল মারল


তীব্র ঝলকানি

অতি তীব্র আওয়াজ

এক রাশ ধোঁয়া

এটমিক ছাতা মাথায়

ব্যাং দাদু আর খোকা

পোস্ট মডার্ন কয়

কুছু না

মেসোজোইক মায়া।



পাঠিকা মিলন


একুশ শতকের মেধাবিনী।


চর্যাচর্যবিনিশ্চয় খুলে

শবরীপাদের পদ পড়ুন।


এক ঢাল মেঘ মার্জনা করে

ঘটাকার খোঁপায় ডোম বধূ

হাজার বছরের গোধূলি গুঁজল।


আচমকা চোখাচোখি হল

চকিত দর্শন।

আড়চোখে চেয়ে

লজ্জায় চোখ সরাল

চঞ্চল দর্শন

একে অপরের দিকে 

নিষ্পলক চেয়ে রইল

স্থির দর্শন

ছেলেমেয়ের দেখা এক হলে

বৈষ্ণব কাব্যে দর্শন মিলন।


এই কথায় পাঠিকা

আদ্যন্ত বাংলা কাব্য পড়ে

আদি অন্তের অতীত আমাকে পড়তে লাগল।

আমার স্থূল আমি পড়ে

সূক্ষ্ম আমিতে ঢুকে

মন বুদ্ধি চিত্ত অহংকার হৃদয়স্থ করল।

কারণে পরমাণুকার দেখল।

মহাকারণে বিম্ব যেমন জলে মেশে

সেইভাবে নাম রূপ ছেড়ে

পাঠিকা কবিসত্তায় বিলীন হল।



চিন্ময় চিত্র


ব্যাঘ্র বিবাহ

ঝাড়খণ্ডের বনে।

ব্যাঘ্রকুমার পাদ্যার্ঘ্য

কুমারী হাসি দিল।

গাঁওবুড়ো দিল

মুরগির মাংস

মহুয়া মদ্য।

পানাসক্ত হরিপদ

পান করতে লাগল।


আমাকে দিল 

ঝাড়খণ্ডি সন্ধ্যা

চাঁদ

ফুরফুরে হাওয়া

নৈসর্গিক আয়োজন৷ 


নদীকল্লোল

উলুর মতো ভাসছে

আমন্ত্রিত পাখি

ঘাসবনে শিশির দানা সর্পচক্ষু

আনন্দে চকচক।

তৃণভোজী-মাংসাশী প্রাণীগণ

প্রসন্নবদন।

ঝিঁঝির সুরে

ঝোঁপের মাথায়

নীরবতা পুরোহিত

রূপকনেকে অরূপে 

মিলিয়ে দিচ্ছে।

এই পরিণয় দৃশ্য নিপুণভাবে আঁকলাম।


হাজার বছর পর শুনলাম

কুয়ালালামপুরের প্রদর্শশালায়

হাঁড়িমুখ হাঁড়িমুখীর সিঁদুরদান

শ্রেষ্ঠ হয়েছে।


(আঙ্গিকের পক্ষ থেকে সাক্ষাৎকারটি নিয়েছেন শ্রেয়ণ)

মন্তব্যসমূহ

জনপ্রিয় লেখা