হোমো... সেপিয়েন্স | অলোকপর্ণা | আঙ্গিক ব্লগ


Not all heroes wear capes

সবরকমের চলে যাওয়াই অভিমানী। তিনি চলে গেলেন এতিম করে দিয়ে। কিছু মানুষের বায়োলজিক্যাল মা বাপ ছাড়াও মা বাপ গজায় এদিকে ওদিকে। কখনো কোনো গাছ, যে ছায়া দিয়েছিল, কখনো কোনো বই, যে ছায়া দিয়েছিল, কখনো কোনো মানুষ- যে ছায়া দিয়েছিল। তবে কি সবাই কেবল আশ্রয় খোঁজে? মাছের আশ্রয় জল, পাখির আশ্রয় আকাশ, তোমার আশ্রয় আয়না, আর মাঝে মাঝে এমানুষ- সেমানুষ। তিনি চলে গেলেন ৩০ মে, ২০১৩। জীবনে সেইপ্রথম এতিম হতে হল। তিনি তোমায় চেনেননি, জানেননি, দেখেননি কারণ প্রশ্নই ওঠে না- তুমি তাঁকে চেনো, জানো, দেখেছো দুরদর্শনে, কারণ তিনি প্রশ্ন তুলেছিলেন। কেন তাঁর ম্যানারিজম অন্য মানুষের “আমোদ” হয়ে উঠবে। তিনি প্রশ্ন তুলেছিলেন। তুমি জেনেছিলে, তবে প্রশ্ন তোলা যায়! তখনকার মত সেটুকুই কাফি ছিল। তিনি চলে যাওয়ার নয় দশদিন পর দেখলে লেডিস সঞ্জয় পাড়ায় ঢুকছে, মাথা এমাথা ওমাথা কামানো। যারা জিজ্ঞেস করলো তারা জানলো সঞ্জয়ের মাথায় পোকা হয়েছিল। তুমি জানলে ও- ও এতিম হয়েছে নয় দশদিন আগে, তোমার মতই। সেদিন থেকে তুমি আর মৃত্যু বুঝলে না।

ছোটবেলায় মনে হত এটাই বুঝি তোমার সুপার পাওয়ার। মানুষ সুপারম্যান হয়, স্পাইডারম্যান হয়, ব্যাটম্যান, গ্রীন ল্যান্টার্ন বা ম্যান্ড্রেক। আর তুমি গে,- যদিও এই শব্দটা জানতে আরো বছর সাত অপেক্ষা করতে হয়েছিল। যেমন সুপারহিরোরা আত্মগোপন করে থাকে, বা থাকতে হয়, চুপচাপ নিজের বিশেষ ক্ষমতা লুকিয়ে রাখলে। না কেউ বলে দেয়নি তোমায় যে তোমার মা বাবা দাদা হোমোফোবিক হতে পারে। কিন্তু যেমন অজ্ঞাত কারণে ব্যাটম্যান ব্রুস ওয়েন, তুমিও তেমন ছোট্ট তুমি হয়ে থাকলে। পড়াশোনা করো, মা বাবার কথা শোনো, গান শিখতে যাও, পরীক্ষায় প্রাইজ আনো, বিড়াল পোষো, গাছের গায়ে হাত রাখো, একা একা নিজের জন্য গান গাও, একা একা হয়ে থাকো, কারণ একা হলে তবেই তুমি ‘তুমি’ হতে পারো, একা হলেই ক্লার্ক কেন্ট সুপারম্যান। অতএব তুমি ঢুকে এলে নিজের ভিতরে। আর বেরোলে না। কোনোদিনও বেরোলে না। জীবন কেটে গেল দেখো, যেমন জীবন কেটে যায়। ঘুম ভাঙতে হঠাৎ দেখলে ইউনিভার্সিটি, কোয়ান্টাম মেকানিকস ক্লাস ৩০২। ফাঁকা ঘরে কখন যেন তোমার সামনে দাঁড়িয়ে পড়েছে শ্রীরূপ, তোমার ক্লাসমেট, সারা গায়ে গভীর পশম নিয়ে। নিষেধের চেনা গন্ধ আসছে ওর গা থেকে। তুমি বেরোবে কি না ভাবছো, দরজা খুলে গেল হঠাৎ। টি. কে. এম হতবাক দাঁড়িয়ে আছেন দরজায়। উলঙ্গ তোমাদের দেখছেন। সেদিন রাতেই তোমাদের ফেরত পাঠানো হল। কিন্তু তুমি ফিরলে না। বাড়ি তো কোনোদিনই তোমার আশ্রয় ছিল না, তাই শিকড় গজায়নি। তুমি অন্ধকার রাতে এলে বা রাতের অন্ধকারে। অন্ধকার তোমায় লুফে নিল। দ্বিধাহীন। তোমার ছায়াটুকুও সে ত্যাগ করল না। তুমি হারিয়ে গেলে। কেউ জানল না তোমার সুপারপাওয়ার। “Not all heroes wear capes” বিড়বিড় করতে করতে তুমি কলেজ হোস্টেলের ছাদ থেকে লাফিয়ে পড়লে, ঠিক যেভাবে গথাম সিটিকে অন্ধকার থেকে বাঁচাতে অন্ধকারেই ঝাঁপ দেয় ব্যাটম্যান।


অসতো মা সদ্‌গময়

ও কেমন মেয়েলি,- “মেয়েলি”, যেমন বৃষ্টির পর গাছের পাতারা হয়,- সবুজ, চকচকে, নরম। নরম কিছু দেখলেই হাত নিশপিশ করে, করে না? বাবল র‍্যাপ? ওই ছোট্ট একটা “ফট্‌”,- ব্যক্তিগত বিগব্যাং। ওকে বাবল র‍্যাপের মত লাগে। দুই আঙুলের মধ্যে ধরে পিশে না দিলে তাই খিদে মেটে না।

ও কেমন পুরুষালী,- “সুখ” বোঝে “সুখ”? দাও “সুখ” ভরে, সব “অ- সুখ” সেরে যাক। তমসো মা জ্যোতির্গময়। পৃথিবীটা ইন্দ্রজিৎদের জন্য নয়, বুঝতে হবে। না বুঝলে বুঝিয়ে দেওয়া হবে, বোঝাবেন কুলগুরু, খাপ পঞ্চায়েত, ক্লাসমেট, ক্লাসমেটের দাদা, নিজের দাদাও, দাদা না থাকলে নিদেনপক্ষে বাবা। কেউ না কেউ এই দায়িত্ব পালন করবেনই। না করলে বহির্সমাজ করবে। সমাজ না করলে রাষ্ট্র,- হিটলার করেছিলেন, করে দেখিয়েছিলেন। এই তো সেদিন সুব্রহ্মনিয়ন স্বামীও বললেন ৩৭৭ সংক্রান্ত জাতীয় আশঙ্কার কথা। যুগে যুগে ইহাই হয়ে এসেছে। যদা যদা হি ধর্মস্য... এভাবেই একদিন “পিঙ্কি প্রামাণিক” নামটা শুনলে তোমার আর এশিয়াডে সোনা মনে পড়বে না,-

স্কলার “কিন্তু” গে,


দারুণ গায় “কিন্তু” হোমো,


ব্যাপক আঁকে “কিন্তু” লেসবো।

আবার একই সূত্রের সমানুপাতিক সম্পর্কের দরুন সিদ্ধান্তে আসা যায়-

ও তো ভালো লিখবেই, “কারণ” ও লেবু,


ও তো ভালো নাচবেই, “কারণ” ও গে,

তো ঋতুপর্ণ- গিন্সবার্গ- টিউরিং- ফ্রেডি মারকারি সূত্রানুসারে প্রমাণিত হল “ওদের” অতিমানবতা।

কমফর্ট জোন দেখতে আদতে কচ্ছপের খোলসের মত। আর সেই খোলসের ভিতরের কুর্ম অবতার আদি অনন্ত হতে এ মহাপৃথিবী ধারণ করে আছে। অতএব এতসব “কিন্তু” ও “কারণ” সুবিধানুসারে নিজের অভিধানে ভরে রেখো,- সময়ে সময়ে আয়নায় নিজেকে অবমানবের মত দেখালে ওইসব “কিন্তু” ও “কারণ”গুলো বের কোরো মুখ ঢাকার জন্য।


বাজিল কাহার বীণা

মেয়েটাকে দেখে অনেকেই। ছোট চুল, চুলে ব্রিলক্রিম, হাতে রিস্ট ব্যান্ড,- যা তখনো জাতে ওঠেনি, বুক সামান্য, কাছে গেলে ঘামের ঝাঁঝাল গন্ধ এসে সারাগায়ের রোম খাঁড়া করে দেয়, সবচেয়ে বড় কথা ভয় নেই। ওর সাথে এক বিছানায় শুলে মা বকবে না, কারণ “ভয়” নেই। রাস্তায় হাত ধরে হাঁটলে পাড়া প্রতিবেশীর চোখ টাঁটাবে না, ক্লাস ১২ অবধি নির্ঝঞ্ঝাট প্রেম চালানো যাবে, কলেজে উঠে সিনিয়র দাদার সাথে সম্পর্কে জড়িয়ে পড়লেও ও কিছু বলবে না, বলতে পারবে না, হাত কাটবে কিন্তু কাউকে দেখাবে না, ঘুমের ওষুধ খাবে কিন্তু কাউকে জানাতে পারবে না, একা একা আরো একা নিজের ভিতরে ঢুকে আসবে, চুল বড় করবে, বাকিদের মত হওয়ার জন্য, কিন্তু পারবে না,- কিচ্ছু করতে পারবে না। কারণ সব সম্পর্কের নাম ভারতীয় সংবিধান এখনো দিয়ে উঠতে পারেননি। আর ধর্ষণে শুধু শরীরের অধিকার, মন তো ধর্ষিত হয় না। সেই পেনেট্রেশন খতিয়ে দেখার কোনো মাপকাঠি নেই, না তোমার হাতে না ওর হাতে। অতএব ও “নিরাপদ”।

তো তুমি ওর ঘনিষ্ঠ হলে, ওর হাত নিজের বুকে নিয়ে রাখলে। সারারাত ভিজলে, ভেজালে। ভোর হতে তোমরা “রুমমেট”। ফাঁকা ক্লাসঘরে ওকে নিচে আসতে দিলে, নিজেকে শূন্য করে দিলে ওর মুখের মধ্যে, সে মুখগহ্বরে বিশ্বরূপ দর্শন হল তোমার, ক্লাসরুম থেকে বেরিয়ে তোমরা “বেস্টফ্রেন্ড”।

মাঝে মাঝে বোর লাগলে তুমি কথা বলো ওর সাথে, ওর ব্যাকুলতা তোমায় আরাম দেয়। কই এভাবে তো কেউ চায়নি কোনোদিন তোমাকে, একবছর পর বলেই ফেললে একদিন, “তুই মেয়ে হলে তোকে বিয়ে করতাম...”, ও কিছু বলল না। সহজ, তাই তুমি ওর নিস্তব্ধতা অবজ্ঞা করে গেলে। সেই নিস্তব্ধতা কবে যে ওর গায়ের চামড়া হয়ে গেছে, তুমি তা জানো না।

ভীড়ের মধ্যে ওকে দেখো তুমি, তারপর না দেখার ভান করে পাশ কাটিয়ে বেরিয়ে যাও,- যদি কেউ দেখে ফেলে, যদি কেউ ভাবে ও তোমার “ওইসব”। ও আটকায় না তোমাকে। তোমাকে আহত করা বা কলঙ্কিত করা ওর “জীবনধর্ম” নয়।

তুমি মিসেস সুজয় সেন। অথচ রাতে ঘুম নেই।

তুমি মিসেস সুজয় সেন। গ্যারেজে গাড়ি দাঁড়িয়ে থাকে।

তুমি মিসেস সুজয় সেন। মেয়ে তোমার ইয়েলো বেল্ট।

তোমারও এক “বন্ধু” ছিল, তখনো তুমি মিসেস নও।

ছুঁয়ে দিলেই সোনা হতে, তখনো তুমি মিসেস নও।

খেয়ালখুশির 69,- যখন তুমি মিসেস নও।

এখন মন ভালো নেই। অথচ তুমি মিসেস সেন।

লুকিয়ে তাকে স্টক করো। অথচ তুমি মিসেস সেন।

ঘুমের ওষুধ পাহাড়প্রমাণ।

অথচ তুমি মিসেস সেন।

এবং স্ট্রেট।


Who you are when nobody's watching?

মনে আছে একবার তোমাকে “দেখতে” এসেছিল নিচু ক্লাসের ছেলেরা? “গে” কেমন দেখতে হয় জানতে। অথচ চিনতে পারেনি। অনেক খোঁজার পর পাশের বাড়ির বুবুন বলেফেলেছিল, “ওটা তো টুবাইদাদা!” সেই থেকে নিজেকে চিরিয়াখানার বাঘ বলে মনে করো। অথবা ঈগলপাখি। কোথায় যেন ঈগল দেখে লিখেছিলে, “যে যত ওপরে সে তত একা।” বোঝোনি ওপরে তাই একা, না কি একা তাই ওপরে। আকাশের দিকে তাকাও। নখের দাগ কেটে সেখান দিয়ে উড়ে গেছে জেটপ্লেন। দাগ দিয়ে বলে গেছে “আকাশটা আমার”। সেই দাগ উপর্যুপরি হাওয়ায় সরে সরে গেছে এদিক ওদিক।... খুব জোরে হাওয়া দিলে উড়তে ইচ্ছে হয় তোমার। একা একা। নিজেকে একা ভেবে সুখ পাও যেমনটা পায় আর সবাই। টের পাও “একা” শব্দটার কোনো লিঙ্গ নেই, যৌনতা নেই। -ভাগ্যিস।

তবে এসো, আয়নায় এসো, চোখে চোখ রেখে জিজ্ঞেস করো,

“যখন তুমি নিজের মত, তখন তুমি কে?”

“যখন তুমি নিজের মত, তখন… তুমি কে?”

মানুষেরা জবাব দেয় না। মানুষেরা উত্তর খুঁজে ফেরে।

মন্তব্যসমূহ

জনপ্রিয় লেখা