সংসার-ঘাট | আকাশ গঙ্গোপাধ্যায়ের গুচ্ছ কবিতা | আঙ্গিক


১)

যেদিকে তাকাচ্ছি দেখতে পাচ্ছি নিজেকে আর আমারই ছড়িয়ে রাখা জঞ্জাল। আয়নার চুল বাড়ছে, দাড়ি বুকে ঠেকে যাচ্ছে, সেখানে কপালের চেয়ে কিছু দূরে ডানদিকের কোণে আঠার দাগ। আমাদের লাল রঙের সংসার আয়নায় আটকে মা স্নানে ঢুকেছেন। 

সংসার বলতে একটা গোটা বাড়িতে মায়ের হাতের নাগাল যতদূর। তার উপরটুকু সমস্ত দেওয়াল জুড়ে আমার হয়ে ওঠা। বৃত্তের কোনও শুরু নেই, নেই কোনও শেষ। তবু আমরা যেখানে নাগাল পাই ধরে নিই তাই দিয়েই শুরু আর সেখানে এসেই শেষ সমস্তটা। সংসার পৃথিবীর জটিলতম সুরঙ্গ এখানে গ্রীষ্ম আর বর্ষার প্রবল রাজনৈতিক মতবিরোধ!  


২)

বেড়ে ওঠার মধ্যে অবাক সব বিষ্ময় আমাদের। প্রতিটা সিঁড়ি ওঠার সঙ্গে সঙ্গে জেনে ফেলা আগের সমস্তকিছু ভুল। আঠারো হলে এডাল্ট হব, ‘বড় হলে জানবে’র কাছে সমর্পিত আছে বহুকিছু। অথচ নিষেধাজ্ঞা না থাকলে তেমন উৎসাহ জাগতই না সেসবে। পইপই করে এড়িয়ে চলা শব্দ একদিন মুখে নিয়ে বাড়ি ফিরে আসি। মনে হয় যেন স্বর্গসুখ। যে এই মোক্ষের সন্ধান দেয় একমাত্র সে বন্ধুটি ছাড়া জীবনে আর সকলেই বিশ্বাসঘাতক। 

এমন সমস্ত মনখারাপ থেকে সূর্য ডুবে যায় দোকানের শাটার। সূর্য উঠেও আসে তবে দোকান খোলে না। ছমাসের অফিসের রাস্তায় তিনবার হাতবদল। রয়ে যাওয়ার মধ্যে কেবল শাটার লাগোয়া রেকর্ড বিক্রেতা। যে দোকান দেওয়ালের মতো দেখতে। গানের কলার ধরা যায় না বলে এই লোকটিকে তাড়িয়ে দিতে পারেনি দোকানমালিকেরা। গান কি কোনও বিশেষ সেলাই? ঠাকুমার বৃহদন্ত্রের মতো বেশি বয়সে জড়িয়ে ধরবে নিজেদের?

 

৩)

ভাঙা রেডিওর হাত গজাতে দেখছি স্বপ্নে। নিজের ইচ্ছায় চ্যানেল বদলাচ্ছে সে। মাঝেমধ্যে বিশ্রী আওয়াজে মনে হয় ঘুমাতে না পেরে ছটফট করছে দিদি। মাইগ্রেন? 

যে মৃত্যু সুখকর নয়, তাদের ব্যাখ্যা দিতে তারা দেখিয়েছেন মা। আজও আকাশ জুড়ে দেখছি সেই মৃতদেহের ভিড়। কত কত কাছের মানুষ শুধু আলো দিয়ে যাচ্ছেন মনখারাপে! আদল দেখে চিনতে পারি না কোনটা কে!

এই, আছি আর নেই এর মাঝে যেটুকু আগুন তাতে সবাই সবাইকে ঠেলে দিচ্ছি ক্রমশ। আর জানতে চাইছি কতক্ষণ লাগবে? অভ্যাস বলে দিচ্ছে চুল্লি গরম থাকলে মিনিট পঁচিশ, হালকা শরীর! ভারী হলে বেশি লাগে খানিক!

 

৪)

পড়ে রইল নাভি। শোকে ক্লান্ত বিশেষ্যরা এগিয়ে যাচ্ছে ক্রিয়ার দিকে! বাক্য ওলট-পালট হয়ে যায়। কে কী গোছালো আর কী কী ফেলে গেল রাস্তায়, হিসাব থাকে না! অগ্রজের স্মৃতি আগলাতে চলে যায় মুখেরা। প্রতীক্ষালয়ে বদলে যায় গল্পের বিষয়। 

জীবন যদি এক বৃত্ত হয় তবে মৃত্যুর শেষও নিশ্চিত নতুনভাবে শুরু। সংসারের নির্দিষ্ট কক্ষপত, নিজের বিশ্বাসের চারিদিকে ঘোরা। নতুনত্বের মধ্যে নিজের ভিতর আরও একটা নিজেকে খুঁজে পাওয়া! প্রতিটা ঘটনায় যেন আয়নায় দাঁড়িয়ে রয়েছি। শুধু জানি আমি ডানহাত নাড়লে সে বাঁহাত নাড়বে না কিছুতেই! 

 

৫)

বৃষ্টি পড়লে মনে পড়ে বহু ঘাম ঝরানো ফেলে এসেছি এই পথে। একটি সংক্রমিত ছবি, রাজপথে পুলিশ ভ্যান থেকে বৃষ্টিতে বাড়ানো হাত। জলের ফোঁটা তালুতে ডেকে নিচ্ছে কয়েদী। হয়তো তার হারিয়ে যাওয়া ছাতা কুড়িয়ে পেয়েছিলাম কোথাও! অপরাধও কি চলে আসেনি আমার কাছে? তবে কীসের শাস্তি পাচ্ছে এখনও সে?

 এমনই এক বিদ্যুৎ চমকানো রাতে ঘুম ভেঙে দেখেছি দু’ফালা হয়ে গেছে জিভ। মাথার কাছে প্রাক্তনীর বাসা, তাতে চুপচাপ ঘুমিয়ে দুই সন্তান তার। কী অপরূপ গন্ধ তাদের! স্নেহ নাকি লোভ? কীসের টানে এগিয়ে যাচ্ছি বুকের ভরে? সরীসৃপেরা দুঃস্বপ্নে কি তবে মেরুদণ্ড দেখতে পায়?

মন্তব্যসমূহ

সঙ্ঘমিত্রা হালদার বলেছেন…
লেখাগুলো ভালো লাগল আকাশ।

জনপ্রিয় লেখা