একটি অভিসারী বই- সুস্নাত চৌধুরী




মুদ্রণশৈলীনান্দনিক প্রকাশনার নির্দেশিকা
কামরুল হাসান শায়ক
প্রচ্ছদ- রাজীব রাজু
পাঞ্জেরী পাবলিকেশন্স লিমিডেট
দাম ৬৫০ টাকা


সেদিন কলেজস্ট্রিটে হঠাৎই দেখা হয়ে গেল তরুণদার সঙ্গে। তরুণ পাইন। তরুণদার এগিয়ে দেওয়া প্যাকেটের অবশিষ্ট একটিই সিগারেট মুখে দিয়ে ধরাতে-না-ধরাতে হাজির সৌম্যেনদা। সৌম্যেন পাল। এইসব মানুষের জোটে অর্বাচীন ছাত্রের মতো কান খাড়া করে দাঁড়িয়ে থাকায় আমার কোনোদিনই কোনো কুণ্ঠা তো নেই-ই, বরং লোভ আছে ঢের! সেদিন তিন জনেই দাঁড়িয়ে রইলাম অনেকক্ষণ। কথা চলল। বই, ছাপা, প্রচ্ছদ, লে-আউট, ইলুমিনেটেড ম্যানুস্ক্রিপ্ট, বুক ট্রেড – এমন অনেক কিছু। শীতসন্ধ্যায় হাওয়া বইছিল ভালোই, সে বাতাস ওঁদের স্পর্শ করে আমার গায়েও এসে পৌঁছোচ্ছিল।

কলেজস্ট্রিটের সন্ধেবেলাগুলোয় লুকিয়ে থাকে এমনই টুকরোটাকরা লাভ। তরুণদাই বললেন, তোমার কথা শুনে বাংলাদেশ বইমেলা থেকে বইটা কিনেই ফেললাম। তবে, নির্ঘাৎ এর পিছনে ফান্ডিং আছে। ফান্ডিং থাকলে তুমিও এমন বই করতে পারতে। না, তরুণদা। এইখানে আমি সহমত নই। হতেই পারে বইটি হয়তো ব্লুমস্‌বারি-র বই থেকে টোকা, কিন্তু আমার বক্তব্য অন্য। সরাসরি বলি, অর্থ নয়, এমন একটা বই করে ফেলার পিছনে সচেতনতা ও সদিচ্ছাই প্রধানত কাজ করে বলে মনে হয় আমার। বাংলা ভাষা নিয়ে এমন ক-টা বই আমরা এই বাংলায় সাম্প্রতিক অতীতে তৈরি করতে পেরেছি, যা ওপারের কোনো মেলায় দেদার বিক্রি হচ্ছে? পারিনি, কারণ আজ আমাদের এই কলকাতামুখী পশ্চিমবঙ্গের সে সদিচ্ছা নেই। নইলে দ্য প্রিন্টেড বেঙ্গলি ক্যারেক্টার অ্যান্ড ইটস ইভলিউশন-এর মতো বই লিখতে একজন বিদেশিনীর দরকার পড়ত না। ব্রিটিশ লাইব্রেরি কি সোয়াস-ফেরত বাঙালি তো আজ কম নেই, কিন্তু সেখানে এক জনও চিত্তরঞ্জন বন্দ্যোপাধ্যায় নেই। এই একবিংশে এক জনও অজর সরকার নেই, যোগেশচন্দ্র রায় বিদ্যানিধি নেই। এ আমাদের অযোগ্যতাই। যুগপৎ কারুণ্য ও বাকতাল্লা সম্বল করে বেঁচে থাকা এক হতভাগ্য জাতির যা হওয়া উচিত, ঠিক সেই অবস্থাতেই সেদিন দাঁড়িয়ে ছিল আমাদের কলেজস্ট্রিট; যেখানে আমরাও সেদিন দাঁড়িয়ে ছিলাম তিন জনে, তবে কোথাও হেলান না দিয়ে।

যে বই নিয়ে এত সাফাই গাইছি, তার সঙ্গে আমার প্রত্যক্ষ কোনো তাল্লুক নেই। আমি তার পাঠক মাত্র। ঢাকার বন্ধু বিধান সাহার ফেসবুক মন্তব্যের সূত্র ধরে সংগ্রহ করি বইটি। মুদ্রণশৈলী: নান্দনিক প্রকাশনার নির্দেশিকা। লেখক কামরুল হাসান শায়ক। পাঞ্জেরী পাবলিকেশন্স-এর স্টলে বইটি হাতে নিয়েই বিস্মিত হই। বিস্ময় লেগেছিল এই ভেবে যে, বাংলা ভাষায় অন্তত এমন একটা বই লেখা হল! ভেবে ভালো লাগছিল, এমন আরও বই তাঁরা নিয়ে আসছেন। পাঞ্জেরী-র প্রকাশনা বিষয়ক সিরিজ-এর এটি প্রথম বই।

গ্রন্থনির্মাণের সময় একটি বইকে কীভাবে গড়ে তুলব? কেমন পাতা নেব? কতটা মার্জিন ছাড়ব? কতটা লিডিং, কী মাপের হরফ, কী ধরনের বাঁধাই? বই বানানোর এমন হরেক বিষয় আলোচিত হয়েছে এখানে। সবচেয়ে বড়োকথা – তাত্ত্বিক নয়, ইতিহাস কপচানো নয়, এ বই একেবারে ব্যবহারিক পরিপ্রেক্ষিতে লেখা। বইটির উদ্দেশ্য হিসেবে শুরুতে লেখকের কথা-য় বলা হচ্ছে, ...প্রকাশনা জগতে শুধু পেশাজীবী মানুষ ও শিক্ষার্থীদের পাঠ্যগ্রন্থ হিসেবেই কাজ করবে না, বরং বাংলাদেশের প্রকাশনাকে কাঙ্ক্ষিত ও আন্তর্জাতিক মানে উন্নীত করতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করবে। শুধু বাংলাদেশে নয়, আমরা চাইলে এই বঙ্গেও বইটি গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠতে পারে না কি?

জানি, এই বই-এ ত্রুটিও ঢের। ভুল বানান, অতিরিক্ত বাঁকা বিসদৃশ ইটালিক্স। তবু অন্তত আজকের বাংলায় এমন বই বিরল। যেকোনো ভালো বই-ই সাধারণত অপসারী হয়। পাঠকের চোখ খুলে দেয়, দৃষ্টি প্রসারিত করে। এ বই-এর পাঠ প্রক্রিয়া উলটো! অভিসারী। পাঠকের দৃষ্টিকে আরও সংকুচিত করবে, ঘন করবে। কিন্তু এই নির্দেশিকা-কে গ্রন্থনির্মাণের বেদবাক্য ধরে নিলে চলবে না। বিষয়গুলো মাথায় নিতে হবে, তারপর কাজ করতে হবে নিজেকেই, স্বাধীনভাবে। সেদিন চলে আসার আগে তরুণদা বলছিলেন, এ বই মিলিয়ে কাজ করা কারো পক্ষে সম্ভব নাকি! ঠিক, সম্ভব নয়। তেমনটা করার চেষ্টাও উচিত নয় বলে মনে করি। এখানে বলা আছে রাস্তার কোন দিক দিয়ে হাঁটতে হবে, কিন্তু সেই রাস্তা ধরে হেঁটে কোন গন্তব্যে পৌঁছোবেন, তা তো পথিকই জানেন। যেমন শুধু পথিকই জানেন পথে কত বিপদ, তবু পথের দু-পাশ কী অপরিসীম সুন্দর। সেসব কথা এই বই-এ বলা নেই।


- সুস্নাত চৌধুরী
আঙ্গিক, বইমেলা সংখ্যা, ২০১৯ 

মন্তব্যসমূহ

জনপ্রিয় লেখা