কবিতাগুচ্ছ | সুজন সুপান্থ | আঙ্গিক, মে, ২০১৯



জুলাই-এর স্মৃতি

ঝুম জুলাই পেরিয়ে সবগুলো রাস্তাই কেবল জড়ানো কথার দিকে ছুটে যাচ্ছ। ছেড়ে এসেছি যে বর্ষা, সেখান থেকে কুড়িয়ে রেখেছি শোক, হেসে ওঠা কথার জীবনী। ফেরার কথা ছিল। তবু হেঁটে যাওয়া পথ ধরে দেখি, ঢুকে আছি বহু যত্নে রাখা ডালিমের ভেতর। ঠিক যেভাবে লালের ভেতরে একাকার হয়ে চুপচাপ বেঁচে থাকে ডালিমের দানা। ফিরে আসার সম্ভাবনায় টুপ করে উড়ে এল তেরঙা এক অচিন প্রজাপতি। তাদের শিরশিরানি ডাক ঘিরে আছে নিঃশ্বাসের মতো।

সম্পর্কের দূরাভাস বুঝতে গিয়ে তার ডানায় মেলে দিচ্ছি পুরোনোর ঝুনঝুন। এমন একটা শব্দ স্মৃতির ভেতর শুধু বেজে যাচ্ছে। বেজে যাচ্ছে, সেই কবে মনে রাখা জুলাই থেকে...



কথাদের ডানা

ভোর ফুটলেই দূরুহ হচ্ছে পথ, ভেঙে যাচ্ছে সেতু। তবু ভুলের নামতা নিয়ে বৃষ্টি কেবল এই শেষ ভোরের–ই পাঠ। আলো বানানো শিখেয়েছিল যে, তার পথ চলে গেছে চিহ্নহীনতার দিকে। সেদিকেই আজ পুরোনো আয়না নিয়ে দাঁড়িয়েছি। অনিশ্চয়তার ভেতর থেকে গুণে নিচ্ছি হাতের রেখা, বিনিময় করছি মোমের ছায়ার মতো মুছে যাওয়া হাসি ও কান্নার রং।

কথার দূরত্ব থেকে পুরোনো আয়নায় ঠিকঠাক এঁকে নেওয়া সিঁথিপথ বেয়ে ক্রমাগত সে নেমে যাচ্ছে নির্জনতার দিকে, নবধারা জলে। আর জলের ভেতর থেকে ভেসে ওঠা একটি ছায়া মা মা বলে ডেকে আটকাতে চাইছে হারানো মুখরতা।

অথচ দেখো, জুলজুল চোখে সমূহ কাতরতা নিয়ে ভেঙে যাওয়া সেতু পেরিয়ে আকাশের দিকে উড়ে যাচ্ছে কথাদের ডানা...



মা ও বিমূর্ত গণিত

মা আমার অঙ্ক জানতো না। তবু কী নিরুপম হিসাব মিলেয়ে দিয়েছেন পুরো জীবন। মার অঙ্ক খাতা ভরে গিয়েছিল বিয়োগ ও ভাগশেষ দিয়ে। এই শুধু, আর কোনো নামতা জানা নেই, আর কোনো কাটাকুটি নেই তার। মা শুধু বিয়োগ গুণে গুণে  রাখে।
এই যেমন নিজের ভাগের ডিম না খেয়ে রেখে দিত মা। সেখান থেকে ফুটে বেরোনোর কৌশল শিখেছিল চারটি মুরগির বাচ্চা। রোজ সকাল ও বিকেলে মা বাচ্চাগুলোকে আদার দেয়। বাচ্চাগুলো খুঁটে খুঁটে খায়। আবার নিজের মুখ থেকে কোনো বাচ্চার মুখে আদার ঢেলে দেয় মা মুরগি। মা আর আমি এসব দৃশ্য উঠোনে বসে বসে দেখি।

আদার খাওয়া শেষে মা গান ধরে—‘ও আকাশ সোনা সোনা...ও সকাল আলো আলো, এ শিশির ঝলমল।’ গান থামার আগেই আকাশ থেকে একটি সোনালি ডানার চিল ছোঁ মেরে নিয়ে গেল দুটি বাচ্চা। অস্থির মা, আকাশের দিকে আঁকশি তুলে সুর করে ডাকছে, আয় আয় টিঁটি আয় আয়।

অথচ বহুদূর আকাশের দিকে উড়ে যাচ্ছে চিল। উড়ে যাচ্ছে মায়ের সুর ও সুখ...



পার্কিনসন্স

জড়ানো কথায় ডেকে যাচ্ছে সারাদিন। গোপনে ছুঁয়ে আছে তসবিহ্র দানা, গোটানো আঙুল ছুঁয়ে আছে পুরোনো স্পর্শের মায়া। অন্য কিছুই মনে রাখছে না আর; অথচ বালিশের নিচে গুটিয়ে রেখেছে সোনামুখ, কিশোরবেলার প্রেম, পুরোনো চশমার আলো। সেই আলোয় দেখা এতগুলো মুখের একটাই ডাকনাম, শায়রা বানু। বুকের ভেতর দিয়ে ডাক পেরিয়ে যাচ্ছে আলনায় ঝুলে থাকা মাড় দেওয়া শাড়ি, শুশ্রূষার ছায়া। ভুল প্রেসক্রিপশনের হরফ আর অযত্নে পড়ে থাকা আয়নার অন্ধকার চিড়ে সেই ডাক কান্নার মতো গড়িয়ে যাচ্ছে শেষ স্টেশনের দিকে... 

মা বলে যায়নি পথের ঠিকানা। তবু প্লেন দূরে উড়ে গেলে বাবার জুলজুল চোখে জল নেমে আসে। জল মুছতে পারে না। তবু বালিশের ফাঁকে মুখ লুকিয়ে বিড়বিড় করে বলছে—শায়রা বানু নেমে একা একা কোন ঘরে গেল? প্রজাপতিদের দানাপানি নেই বহুদিন! ওদের পেটপুরে খেতে দিতে বলো, চুপচাপ। কমে যাক ডানার ধড়ফড়। আগে ওষুধ কিছু গুছিয়ে নিক। ধীরে, কেঁদেকেটে ফিরে যাওয়ার আগে প্রজাপতিদের ঘুম দিতে বলো রাতেরও অধিক... 



ডার্ক সাউন্ড

ক্রমশ সন্ধ্যা ফুরিয়ে এলে ভীষণ অন্ধকার, ঠিক সেপটিপিনের আড়ালে যতখানি ভয়াবহ থাকে। যতগুলো ভয়াবহ পেরিয়ে এতটা দূর ও দূরত্ব, দেয়ালের গা থেকে সেইদিকে ভেসে আসে কাঁটার গমক। গমকে গমকে নির্জন রাত, অন্ধ-অন্ধকার। নির্জনতা গুছিয়ে বসে আছি জেনে, জেগে আছে টিকটিকিদের বিলিকাটা সংসার। ঘড়ির কাঁটায় কাঁটায় ঘন হয় রাত, গোছানো সুরে ভেসে আসে টিকটিকিদের চিলতে কথা, গোপন আবদার।

আর এদিকে নির্জনতা ভেঙে ভেঙে বুকের ভেতর বেজে উঠছে পুরোনোর চুরমার।



প্রেম ও বহুবিধ নির্জনতা

স্মৃতিসরণি পেরিয়ে বাঁকা হয়ে যে পথটি চলে গেল শৈশবনগর, তার মধ্যবর্তী স্টেশনে বসে কী যেন ভাবছে শুষ্ক ঠোঁটের মেয়ে। তার মন খারাপের নিবিড়ে জমে উঠছে হরিণসন্ধ্যাকাল। এমন সন্ধ্যার ভেতরও কেমন ব্যথা জমে থাকে, ঘন কুয়াশার মতো। তবু দূর থেকে মশগুলে চেয়ে আছি ধূসরতার দিকে। জেগে উঠছে বহুবিচ্ছেদি প্রেমিকার মুখ, হাসি ভুলে যাওয়া শুষ্ক শুষ্ক ঠোঁট। স্মৃতি থেকে দুলে উঠছে আকরকণ্ঠ, তারামণিলতা। জেনো, এতটুকুই প্রেম, যার বহুবিধ নির্জনতা।

ও প্রেম, ও নির্জনতা, দেখো প্রেমিকের অভিমান থেকে কী করে জেগে উঠছে ঠোঁটের গোপন আর ছকের মতো মুছে যাচ্ছে সম্মুখ পথ; গভীর থেকে ছলকে উঠছে-না বলতে চাওয়া সমুদয় প্রাচীন কথা।

ও মেয়ে সন্ধ্যা পেরোনোর আগে অন্তত জেনে নাও, এই দিক বদলের দিকে জমে আছে কতখানি শীতকাল। ভুলে যাও পুরোনো ফাটলের দিন। ধূসরতা ভেঙে বিপরীতে আসো, খুঁজে নাও ঠোঁটের শিরীন।



বিষণ্ন জোকারের হাসি

নষ্ট ঘড়ির ভেতর দিয়ে ক্রমশ পেরিয়ে যাচ্ছে সময়, হাওয়ার বেগে। এমন সময়ে হুটহাট ঢুকে যাই জুয়াড়ির খোপে। তাস নয়, জানালার দিকে তাকিয়ে বারবার হেরে যাই বলে হেসে ওঠে জুয়াড়ি, হেসে ওঠে চুপে থাকা বিষণ্ন জোকার। শাফল ছাড়া তাসুরে বোঝে না অত, যতখানি জোকারের জানা—তাসের বদলে কী করে আগলে রাখি জুয়াড়ির নিজস্ব জানালা।

এই যে, এইখানে দাগ কেটে দিলাম। থিতু হব এখানেই তবে। একদিন সর্বস্ব হারিয়ে ওই জানালায় অকারণে হেসে ওঠা সমুদয় টিপকালো অন্ধকারের ভেতর গোপনে হেসে দেব বলে, হাতের পাতায় এঁকে রেখেছি হেরে যাওয়ার নকশা...

লালিত দাগে তাস হাতে হেরে যাই বলে করুণা ঝরানো হে তুমুল জুয়াড়ি, তোমার জানালার ললিত অন্ধকারের ভেতর আমি নিরুদ্দেশ হলে জোকারের হাসির অনুবাদে জেনে নিও—যাকে তুমি ঠিক হেরে যাওয়া বলো, ওটুকুই, ওটুকুই শুধু ছিল আমার নকশাকাটা হার, আর পুরোটা তোমার।

মন্তব্যসমূহ

জনপ্রিয় লেখা