শাশ্বতী সরকারের পাঁচটি কবিতা | আঙ্গিক পত্রিকা
মাটির খুরিতে চা খেলে বহু সাবধানে ধরতে হয়
বৃদ্ধ বয়সের প্রেমিকের শিরাওঠা হাতের মতো বটতলায় সকালে বসে চায়ের দোকানে
যেন ইচ্ছামৃত্যু ধরে আছি হাতের ছোবলে
*
বাঁধানো ঘাটের কাছে বসে ঈশ্বর বিড়ি টানছেন খুব
পেয়ারাতলায় ছায়া পড়ে আছে আলখাল্লার কাছে
এখনও ছেলের দেহ ছেড়ে দেয়নি ডোম,
তার হাতে কড়কড়ে দু'হাজার তুলে দিতে হবে
গেল সতের সনে বউ মারা যেতে এই ঘাটে বসে কান থেকে খুলে বিড়ি টানা
আর এই
পরের বছর কি মৃত্যু হবে তাঁরও?
ঈশ্বর এই কথা ভেবে শেষটানে ধরালেন পেয়ারাতলার ছায়া, চাদর ওই মাটিতে লুটায়,
দাউদাউ ধরে ওঠে আলখাল্লা, দাড়ি
পার হওয়া যাবে কিনা না জেনেই লাফ দিল গ্রন্থের বাঘ
কাঁটাঝোপে,
মনসার বনে হলুদ রুমাল পড়ে আছে
সারা গ্রামে মাত্র দুটি লোক, আমি ও আমার গ্রন্থের বাঘ
কখনও আমি পেরতে চেষ্টা করি তাকে,
কখনও সে আগুপিছু না ভেবে আমাকেই তাক করে লাফ দেয় নিজের ভেতর
*
স্বর্গের কাছাকাছি দীনুদা-র চায়ের দোকান। তিনটে বয়ামে তিনরকম বিসকুট। বেঞ্চির
পায়ার কাছে থাবা পেতে বসে থাকে ভুলু, ঘন ঘন লেজ নাড়ে, কখনও
ঝিমায়।
দীনুদা-র চায়ের গন্ধ সুবিখ্যাত। আমাদের পৃথিবীতে এখনও তার কথা বেশি লোকে জানে
না। অসফল পরীক্ষার্থী,
রোজের অফিসযাত্রী, আর আসে রিকশাচালক । তাসের
আসরে তারা কিছু যশোলাভ করেছে ইদানীং।
রেডিয়োয় জর্জ বিশ্বাস গাইতে আসেন, স্বর্গে আষাঢ় নামে। উচ্ছ্বসিত অন্ধকারে
জ্বলে ওঠে একফোঁটা লন্ঠনের আলো। অল্প ঝুঁকে বাষ্পে ভরা চশমায় দীনুদা ফুটন্ত জলে
ফেলে দেন তেজপাতা, টুকরো এলাচ।
আমার ইংরেজি শেখার লোভ হয়। বেশ ছোটোবেলা থেকেই শিখে যাব, মেঘ কে বলে ক্লাউড। জল হল
ওয়াটার। পড়ছে=ড্রপিং। অভিমান কে কী বলে? তোমাকে হারিয়ে ফেলছি
সুজাতা, মিসিং ইয়ু? আমার হেলেন কেলার
ছিলেন। দুমলাটে হাতে এঁটে যায়, সুন্দর চোখের হেলেন কেলার,
কোঁকড়া চুল। মিস সুলিভান আসবার আগে তিনি শিকারী বন্দুকের গরম নল,
কুকুরের উষ্ণ নিশ্বাস ছুঁয়ে বুঝতেন আজ ওদের মুখ খুশি আছে কিনা। একটা
কথা থেকে কাপাস তুলোর ফেটে পড়া বীজের মতো ছড়িয়ে যাই। শিকার বললেই মনে পড়ে হরিণের
কথা, যে সবুজ, কচি ঘাসের কাছে তৃপ্তমুখ,
নদীতে এসে জলপান করছে সারারাত ছুটে চলবার পরে, তার হরিণীকে জাগিয়ে দেবে কোন সাধে, নব উল্লাসে! এক
জীবনানন্দ থেকে গেছিলেন।
আমার বানান ভুল করতে ইচ্ছে করে। পাখি না পাখী। বাড়ি নয়, বাড়ী। দেশ, দেশ, দেশের কী বানান? অশ্রুর
কী বানান হে জাগরূক? একদিন সব সঙ্গে কেটে সাথে লিখে দেব,
কোনও, আরও নতুন পাগলামির দিকে যেতে যেতে ফিরে
দেখি কাটাকুটিতে ভরে গেছে পেয়ারাডালের নিচে ক্লান্ত শীতকাল।
ভাষা ভোলার দিকে যাই। অন্ধকারের বানান জানি না। চোখ, যা দৃশ্যের কাছে অপার করেছে,
সাধ করে, মৃত্যুকে হেঁটে আসতে দেখি। বেড়ালের
মুখে ঘুরে ঘুরে বেড়াই ফিরিয়ে দেওয়ার নয়টি হাত।
মন্তব্যসমূহ