গো-রাষ্ট্রের ‘গো’পন কথা- শ্রেয়ণ




এক ডজন গোরু ও অন্যান্য
লেখক- শুভাশিস মৈত্র
প্রচ্ছদ- অনন্য ঠাকুর
প্রকাশক- ধানসিড়ি
দাম- ১৫০ টাকা




নাগপুরে বসেছে গোপন বৈঠক। রাষ্ট্রপতি, প্রধানমন্ত্রী, প্রধান সেনাপতি সবাই বৈঠকে হাজির। এখন নাগপুরই দেশের রাজধানী কিনা। দেশ অর্থাৎ সংবিধান পালটে যার নাম হয়েছে ‘Cow Republic of India, সাদামাটা বাংলায় ‘গোরাষ্ট্র’। বাংলা অবশ্য এখন বলা নিষিদ্ধ, সবাইকে হিন্দিতেই কথা বলতে হয় বাধ্যতামূলকভাবে যদিও ইংরেজিটাকে লিংগুয়া ফ্রাংকা হিসেবে আনঅফিসিয়ালি রেখে দেওয়া হয়েছে, তবে নির্দেশ আছে, হিন্দির থেকে ধীরে ধীরে এগোতে হবে সংস্কৃতের দিকে। এইভাবেই একটা সময় ভারতীয়রা হাম্বা ভাষা আয়ত্ত করতে পারবে বলে গবেষকদের বিশ্বাস। তাঁরা ইতিমধ্যেই প্রমাণ করেছেন, ‘গবেষণা’ কথাটার আক্ষরিক অর্থ সেহেতু ‘গোরু খোঁজা’, তাই সব গবেষণা, সব জ্ঞানচর্চার পরম লক্ষ্য সেই গোরুতে বিলীন হওয়া। ব্রহ্ম স্বয়ং গো-স্বরূপ। তাঁরা জানিয়েছেন, বাঁদুরে কোনো প্রাণী নয়, গোরু থেকেই মানুষের উৎপত্তি। আর যেমন কলি যুগের পর আবার ফিরে আসে সত্যযুগ, একই ভাবে মানুষ একটা সময় আবার পরিণত হবে গোরুতে। ইতিহাসের চাকা এভাবেই ঘোরে।

বৈঠকের সভাপতিত্ব করছেন রাষ্ট্রীয় গোসেবক সংঘের মাননীয় সরগোপালক শ্রী মোহন ভৈরব। শুরুতেই তিনি বললেন, “গোসন্তানগণ, আপনারা সবাই জানেন, গোরাষ্ট্রের পবিত্রতাকে অসম্মান করেছে এমন সব বই, সিনেমা, গান, পেইন্টিং, ওয়েবসাইট সবকিছুকেই আমরা নষ্ট করে ফেলেছি। এই সবের সঙ্গে যুক্ত দেশদ্রোহীদের বেশির ভাগকে অনেক আগেই গো-খামারে পাঠানো হয়েছে, যাতে গোমাতার সেবা করে তাদের মস্তিষ্কের সংশোধন হয়। যারা আন্ডারগ্রাউন্ডে চলে গেছিল, চিরুনি তল্লাসি করে তাদেরও অনেককে আমরা ধরতে পেরেছি। বাকিদেরও শিগগিরই ধরে ফেলব। আমরা ফাঁসি নিষিদ্ধ করে যে নতুন ডিজিটাল মৃত্যুদণ্ড চালু করেছি, সেগুলো তাদের ওপর বলবৎ করা হবে। এগুলো সব পুরোনো কথা। তবে আমাদের গোয়েন্দা বিভাগ সম্প্রতি জানতে পেরেছে, আবার কোনো কোনো জায়গায় খুব গোপনে ওইসব জিনিসের চর্চা হচ্ছে। একটা স্যাম্পেল আমাদের গোয়েন্দারা উদ্ধার করতে পেরেছে, এই নিয়ে বিস্তারিত রিপোর্টও তৈরি করেছে সেনা দপ্তর। সেনাপ্রধান বিপিন বাজিরাও আমাদের পড়ে শোনাবেন সেই রিপোর্ট”।
সেনাপ্রধান বলতে দাঁড়িয়ে প্রথমে গ্লাস থেকে একটু জল খেলেন। তারপর আস্তে আস্তে শুরু করলেন, “গোমাতা জিন্দাবাদ। আমি প্রথমেই জানিয়ে দিতে চাই, অবস্থা যথেষ্ট গুরুতর। কারণ, আমাদের স্পাই যে বইটা উদ্ধার করেছেন, সেটা বাংলায় লেখা। গোপনে আবার বাংলা, তামিল, ওড়িয়া, সাঁওতালির মতো নিষিদ্ধ ভাষার চর্চা শুরু হয়েছে। এটাকে যেভাবেই হোক দমন না করলে পরিস্থিতি চলে যাবে হাতের বাইরে। বইটার নাম ‘এক ডজন গোরু ও অন্যান্য’। লেখক এখন কী অবস্থায় রয়েছেন, সেই খোঁজ আমরা শুরু করে দিয়েছি। অনেক আগের বই তো, তখনকার সব নথি এখনও ডিজিটালাইজ করা হয়নি, তাই আরও ২৪ ঘণ্টা সময় আমরা চাইছি। অনুগ্রহ করে আমাদের সেই সামান্য সময়টুকু দেওয়া হোক”।

এবার মুখ খুললেন গোহৃদয়সম্রাট উপাধিতে ভূষিত প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র যোগী। বললেন, “অত সময় দেওয়া যাবে না। বইয়ের নাম শুনেই স্পষ্ট যে ওটাতে গোমাতাকে অপমান করা তো হয়েছেই, তার সঙ্গে সঙ্গে গোরাষ্ট্রের বিরুদ্ধেও ষড়যন্ত্রের মালমশলা থাকতে পারে ওখানে। আপনি বারো ঘন্টার মধ্যে কাজ শেষ করুনআর বলুন, কী লেখা আছে বইটাতে”।

“স্যার, আপনি ঠিকই ধরেছেন,”, আবার শুরু করলেন বিপিন বাজিরাও, “তবে বারো ঘণ্টা খুবই কম সময়। আরেকটু সময় দিলে ভালো হত, তবে আমরা চেষ্টা করছি ছয় ঘণ্টার মধ্যেই কিছু একটা করতে। বইটাতে গো-প্রজাতন্ত্রের বিরুদ্ধে এমন সব কথা লেখা আছে, যা মানুষকে যে কোনো মুহূর্তে বিদ্রোহে প্ররোচিত করতে পারে। আমরা সেই বিষয়ে সিরিয়াসলি ভাবছি। গোটা বইটাই আমাদের আইডিওলজিকে ব্যাঙ্গ করে ঠাট্টা তামাশার ছলে লেখা, সেটা অবশ্য খোলসটা। লেখাগুলোকে ডিকোড করলে যেসব কথা বেরিয়ে আসে, তা আরও ভয়ংকর। সরাসরি বিদ্রোহে উস্কানি। যেমন ধরুন, বইটাতে একজনকে দিয়ে বলানো হচ্ছে, ‘গোরু আমাদের ভিত্তি, বানর আমাদের ভবিষ্যৎ’। বুঝতে পারছেন নিশ্চয়ই, শুধু এটা আমাদের চিন্তভাবনাকে কটাক্ষ নয়, এটা আসনে অভ্যুত্থানের প্ল্যান। বাঁদরের মতো তাণ্ডব করবে, ভেঙে গুড়িয়ে দেবে আমাদের সিস্টেম। গো-প্রজাতন্ত্রকে ধ্বংস করে আবার স্কুল-কলেজগুলোতে ম্লেচ্ছ ডারউইনের থিয়োরি ঢোকানোর ষড়যন্ত্র। একেবারে মোক্ষম চাল রয়েছে লেখাটায়যাদেরকে দিয়ে কথাগুলো বলানো হয়েছে, পড়লে মনে হবে তারা আমাদের লোক, কিন্তু আসলে তা নয়। ওরই চরিত্রগুলো সব ডাবল এজেন্ট। কিচকিচ হনুভাষা আসলে বিদ্রোহীদের গোপন কোড। আমাদের হনুমান স্বয়ং রামের অনুচর, তিনি সংস্কৃত বলেন, কিচকিচ করেন না। অবশ্য দেবভাষা সংস্কৃতের চেয়ে গোভাষা হাম্বার স্থান অনেক উঁচুতে। যাই হোক, গো-প্রজাতন্ত্র তৈরি হবার আগেই যেভাবে এইসব কথা লেখা হয়েছিল, বোঝা যাচ্ছে তদন্ত হলে আরও গভীর কিছু বেরোবে। আবার এটা দেখুন, সাদা গোরুকে কালো রং করে সুইস ব্যাঙ্কে পাঠানোর কথা বলা হয়েছে। এটা পড়ে যদি কেউ ভাবে, আমরা সুইস ব্যাংকের টাকা নিয়ে যে সব জুমলা দিতাম, সেগুলোকে নিয়ে শুধুমাত্র স্যাটায়ার লেখা হয়েছে, তাহলে ভুল করবে সে। আসলে এটা অনুপ্রবেশ জিহাদের নীল নকশা। গোসন্তানের ছদ্মবেশে বিধর্মী যবনদের সীমান্ত পার করিয়ে এই গোরাষ্ট্রে ঢুকিয়ে দেওয়ার চক্রান্ত”

দম নেওয়ার জন্য সেনাপ্রধান একটু থামলেন। কয়েক ঢোক জল খেয়ে শুরু করলেন আবার, “এই বইটার সবথেকে ক্ষতিকর দিকটা হল, এখানে এমন কিছু লেখা আছে, যেগুলো দেখলে মনে হবে সরাসরি আমাদের নিয়ে লেখা নয়, অন্য কোনো সংগঠন বা পার্টিকে নিয়ে লেখা কিন্তু একটু বিশ্লেষণ করলেই বোঝা যাবে, আমরাও ওগুলোর থেকে বাদ যাই না। যেমন ধরুন ‘বন্দুকের নলই রাজনৈতিক ক্ষমতার উৎস’ অথবা ‘কেন্দ্রীয় কমিটির বৈঠকের পর লঘু-গুরু বিতর্ক’। ভেবে দেখুন, আমরা যে এতদিন ধরে সংখ্যাগুরুর শাসনের কথা বলে আসছি, সেটাকে চেটে দিল কেমন! আর সংখ্যাগুরুপন্থী পার্টিকর্মীর নামটা দেখুন ‘কমল’, এটাকে কাকতালীয় বলে মনে করার কোনো কারণই নেই। আরেকটা লেখা পড়ুন, একটা বন্দুক নিজের আত্মকথা বলছে পুলিশকে। জানাচ্ছে বারবার হাতবদলের পর জায়গা হবে থানার মালখানায়। এটা কিন্তু মাফিয়ারাজ বা লুম্পেন নেতার গল্প নয়। বন্দুক আসলে জনগণের প্রতীক। আর মালখানা মানে লেখকের মতে গোরাষ্ট্র, যেটাকে তাদের মতো দেশদ্রোহীরা লৌহযবনিকা মনে করে। পুরোপুরি উস্কানি রয়েছে লেখাটায়। আর আমাদের গোটা সিস্টেমটা যে চামচাতন্ত্রের ওপর দাঁড়িয়ে আছে, সেটাকেও আক্রমণ করেছে এই বইটাতে….
এতক্ষণ সুমিত শাহ চুপ করে ছিলেন। তিনি আরজিএস-এর খুব ঘনিষ্ট নেতা। প্রধানমন্ত্রীর পরেই সংগঠনে তাঁর স্থান। হঠাৎ সেনাপ্রধানের কথা মাঝখানে থামিয়ে বলে উঠলেন তিনি, “চামচাতন্ত্র আবার কী কথা? আপনি কি ওই বইটার মতোই আমাদের সিস্টেমকে নিয়ে স্যাটায়ার করছেন নাকি?”

সেনাপ্রধান জিভ কেটে বললেন, “না স্যার, আমি সেরকম কিছু মিন করতে চাইনি। আমি এক্সপ্লেন করছি স্যার”।
তখন প্রধানমন্ত্রী মুখ খুললেন। “এইভাবে নয়, আপনি বসুন। এনকোয়ারি কমিশন বসাতে হবে আপনার ওপর। গতিক সুবিধের নয়”।

গোটা হলে একটা চাপা গুঞ্জন উঠেই সঙ্গে সঙ্গে মিলিয়ে গেল। একটা ভয়ংকর নীরবতা নেমে এল সেখানে। রুমাল বার করে কপালের ঘাম মুছতে লাগলেন সেনাপ্রধান।



- শ্রেয়ণ
আঙ্গিক, বইমেলা সংখ্যা, ২০১৯ 





মন্তব্যসমূহ

জনপ্রিয় লেখা