কলোনি কলকাতা: আত্মগত উপনিবেশের নকশা- সৈকত সরকার




কলোনি কলকাতা
কবি- প্রশান্ত সরকার
প্রকাশক- হাওয়াকল
দাম- ১৬৫ টাকা

কলকাতা শুধু শহর নয়, একটা তীব্র অনুভূতির কাঠ-খড় তার ধুলোপথ থেকে আলোর সওয়ারি এসমস্তই যেন আমাদের বেঁচে থাকায় টুকরো টুকরো শব্দ রেখে গেছে কবি প্রশান্ত সরকারের কলোনি কলকাতা যেন কলকাতার তীব্র কঙ্কাল ছুঁয়ে যাওয়া তেমনই কোনো ইনফ্রারেড রশ্মি, যার প্রতি চরণে আমরা শহরকে আবিষ্কার করি তার সমস্ত দোষ-গুনের হাড়গোড় দিয়ে, বিনোদনের মেদমাংস ঝরানো সেই সরণিতে একে একে এসে দাঁড়ায় কলকাতার আপন সকালেরা কিন্তু শহরের কঙ্কালে কিছু অভিজ্ঞতার  পুর জমে উঠেছে৷কবি লিখছেন, “যখন ব্রিজের নিচে ভেসে আসছে নির্জন.../ ভেসে আসছে নদীবহুল এই যাতায়াত/ তখন সারাৎসার ডুবে যাচ্ছে জলে এই কলকাতা কবির অভিজ্ঞতাসঞ্জাত মেঘের মতো, তার প্রতিটা বর্ষণ যেন স্মরণীয় সমস্ত স্মৃতিকে ফিরিয়ে আনছে৷ নদী আর ব্রিজের নিসর্গে কোথাও যেন জলের বন্দনা থেকে গেল, জলভার গ্রাস করছে তার অতীতের জায়মান স্মৃতি, অথবা সম্ভবত মুহূর্তের জন্য হলেও অতীতই আত্মসমর্পণ করছে শহরের কাছে শহর এখানে ছবির মতো, অথচ সম্পূর্ণ ছবিও নয় দীর্ঘ প্যানোরামা শটে যতটুকু দেখা যায়, ততটাই ব্যাপ্ত সেই দেখা কিন্তু কবিতা পড়তে পড়তে মনে হতে পারে- দেখলাম কাকে?  শহর? কিন্তু সে তো আলোকময় অজস্র স্তম্ভতবে?  নিজেকে দেখলম?  নিজের স্মৃতির মধ্যে গড়ে নিলাম অন্য কোনো কলকাতার কোলাজ? যাকে ইচ্ছেমতো ভাঙা যায়, ছেনি বুলিয়ে বুলিয়ে গড়ে তোলা যায় কাঙ্খিত অবয়ব এখন জেটি জুড়ে,অপুর গানের পথ,/ হাজারো বিশ্রামঘর,...কার্যত ক্যামেরা..” সন্দেহ হয় এই ক্যামেরামুখরিত শহরের সাথে কোথাও অপুর পথচলার ওয়েভলেন্থ মিলে গেছে নিশ্চিন্দিপুরের সেই ফেলে আসা ভাঙা দেওয়াল অথবা কাশফুলের গুচ্ছ খানিক হাওড়া ব্রিজের ছন্দেও বেজে উঠছে অথচ এই অমোঘ বেঁচে থাকা থেকে কোনো পরিত্রাণ নেই কারণ এতক্ষণ পর দূরে চলে যাচ্ছে যে সমস্ত দূরবীন/ তার পাশেই ফুটে আছে আমাদের তামাম নোঙর

কলকাতার প্রচলিত ছবিকে কবি তার ক্যানভাসে রাখছেন এক বাঙ্ময় তুলিতে করে তার প্রতিটা চিত্রপট মুখরিত, কোথাও কোনো স্থিরচিত্র নেই, কিংবা থাকলেও তাতে ধ্বনিত হচ্ছে অতীত ট্রাফিক টোন এর মতো প্রথামাফিক শব্দ থেকে একেবারেই অচেনা অর্ধচেনা আনকোরা শব্দ শিশুদের হাতভর্তি বেলুনটঙ্কার, কিংবা বেলুনভর্তি হাত..’’এই দ্বিধা যেন বেলুনবিক্রেতা পথচারী শিশুদের জেগে থাকা বর্তমান নিয়ে, গাড়ির কালো কাঁচ নামিয়ে কবি তাদের দেখছেন কোনো নব্য দূরবীনে, যাতে শুধু দূরদৃশ্য নয়,দূরস্থিত বেলুনের অস্পষ্ট টঙ্কারের শব্দগুলোও থেকে যায় এ বইতে যেমন আছে শহরের উষ্ণতার পাঠ, তেমনই আছে তার অন্তর্গত পথচারীর ব্যক্তিগত শ্বাসপ্রশ্বাসের শব্দ–“যেভাবে মাঝরাতে নেমে আসা ছাদ-অবসরে, একা পথচারী যেভাবে তার স্থূল কার্নিশে রেখে গেছে হালফিল কিছু ফুল”, মনে হয় শহর জেগে উঠছে প্রতিটা ইঁটকাঠপাথরের দেহে, প্রতিটা ছাদবিলাসী মানুষের শ্রম আসলে কলকাতার সেই সমস্ত হালফিল চলনের মধ্যেও মানুষের আত্মরতির অনুভূতিকে তীব্রতর করে তুলেছে অবসাদ আর ক্লান্তির মধ্যেও শুশ্রুষার মতো রয়ে গেছে এমন অজস্র ছাদ,এমনকি তার শৌখিনতাও –“মাঝে মাঝে অল্পপ্পেয়ে হেঁটে আসার ছাদও/ ফুটিয়ে রাখে জবা

এ শহরের মধ্যে আছে কিছু একঘেয়েমির নাস্তা কখনও প্রথার মতো, কখনও আবার প্যাশন আর অভ্যাসের গিটারে তারা নেচে ওঠে যেমন আবহমান শিরোনামের আধারে কবি লিখছেন, “ এ শহর নিভে গেলে যাক/ আরু ফুঁ দিলে বেজে উঠছে....রোজকার ক্যাথলিন”,  কিংবা যখন শহরই বিমুখ করে, বিফলমনোরথ প্রেমিকের চোখে ঘনিয়ে তোলে ছায়া, তখন হয়তো কবিকে এভাবে সুষম ছন্দ আর মিলের তালে তালে ভাঙতে হয় অতীতের জীবনানন্দীয় উপমার রঙ – “ চুল তার কবেকার, ভুল প্রিয়তমা /নিবিড় শয়ানে থাক ফুলের তর্জমা

বাতিঘর বুটিক”, কিংবা শ্রীকৃষ্ণ মিষ্টান্ন ভাণ্ডার এর মতো বিপণির নামও কবিতায় শিরোনাম হয়ে ওঠে মনে হয়, শহরের প্রতিটা বিপণিও যেন তার বাণিজ্যের ইঙ্গিত খুলে দিয়েছে শহরের কাছে কখনও কলকাতাই চেপে বসছে আবেগে, আবার কখনও আবেগ ঘাড়ে ওঠে কলকাতার কে কার উপনিবেশ, বোঝা দুষ্কর হয়ে ওঠে প্রত্যেকটা ছায়ার মধ্যে নতুন নতুন উপনিবেশ সংশ্লেষিত হয় এখানে সেইসব আস্তানাতেই তামাম নোঙর ফেলে আরও আরও কলকাতা ভেসে থাকে

মন্তব্যসমূহ

জনপ্রিয় লেখা