আনোখা নদীর তীরে- রাকা দাশগুপ্ত






আনোখা নদী
কবি- হাসান রোবায়েত
প্রচ্ছদ- রাজীব দত্ত
প্রকাশক- তবুও প্রয়াস 
দাম- ২৫ টাকা

হাসান রোবায়েতের কবিতাপুস্তিকা আনোখা নদী উৎসর্গে লেখা আছে, “নানির মাগফেরাত কামনায়ছোট্ট বই, ছিমছামআড়ম্বরহীন দু'মলাটের মধ্যে ধরা  আছে তাঁর সদ্যমৃতা নানির আদর-ছায়া, তাঁর শোকস্নাতা আম্মার মুখের ম্লান আলোটুকুপড়তে পড়তে মনে হচ্ছিল, কেবলমাত্র ওঁরা দু'জন নন... আমাদের সকলের পূর্বনারীরা , অর্থাৎ বাংলার চিরন্তনী মাতা-মাতামহীরা ধরা আছেন এইসব কবিতার স্থিরচিত্রে জীবনানন্দ-কথিত  শঙ্খমালা-চন্দ্রমালা- মানিকমালার উত্তরসাধিকা তাঁরা, “চাল ধোয়া স্নিগ্ধ হাত, ধান-মাখা চুলতাঁদেরও অবিকল,  শুধু তাঁদের চলাচলটুকু আজকের অঙ্গনে, বাস্তবের ধুলোমাটিপথে

যে-মা নিজে সদ্য মাতৃহারা হয়েছেন, তাঁর অনুষঙ্গে  অনিবার্যভাবে  উঠে আসে রোগশয্যা,
আসে শোক -

রোগনিরাময়কারী হাওয়ায় আম্মা দাঁড়িয়ে থাকে
নিজের ভেতরে, একা -

দূরের সন্ধ্যায়
একটা পেয়ারা ফুল মা মরা মেয়ের মতো ডুকরে ওঠে হাওয়ায়

রোবায়েতের এই সব লেখায় আম্মা-নানি ছাড়াও আরেকটি কেন্দ্রীয় চরিত্র আছেসে চরিত্রের নাম বাংলার গ্রামজীবনতার অপার সৌন্দর্য, তার যাবতীয় বিষণ্ণতা নিয়ে সে আগলে রেখেছে কবিতাগুলিকেশুরুতেই বলছিলাম না, সেই চাল-ধোয়া হাতের কথা? রোবায়েত লেখেন -

আম্মা চাল ঝাড়তে বসলে
গমগমে নিস্তব্ধতার ভেতর একটা বাঁশপাতা
ক্রমশ পেরিয়ে যায় চিত্রার্পিত হাওয়া

আরও লেখেন, 

আম্মাকে দেখতাম, একটা লাল ফড়িঙের সঙ্গে বাড়ি ফিরতে - সিনেমা শেষে কুলায় গান ঝাড়তে ঝাড়তে আম্মা বলতো- ‘যেকোনো বাড়ির সবচে বড় অপচয় তার সদর দরজা

শেষ বাক্যটির কাছে থামতে হয় কিছুক্ষণফের পড়তে থাকি, অন্য কবিতায়  -
-
অনেক ফাঁপর দুরে চলে যাওয়ার সময়
নিমগাছের অমলিন ব্যথায় আম্মা লেপে দিত
হাতের অন্ধকার

 খুব ব্যক্তিগত বিষয় থেকে যে-সব কবিতা লিখিত হয়, তাতে দু'রকম বিপদ থাকেএক, যদি নির্মাণের দিকে চোখ চলে যায় বেশি, কবিতা তার আন্তরিক সুরটি হারায়দুই, যদি গঠনগত দিকে একেবারেই নজর দেওয়া না হয়, অপরিমিত আবেগের আধিক্য কবিতাকে তরল করে দিতে পারেএই দুয়ের মাঝখানে কোথাও একটা ক্ষীণ সুতোর মত রেখা থাকে, যেখানে কবিতা ঠিক যথাযথ, ব্যালেন্সডটানটান সেই সুতো বেয়ে নিখুঁত ভারসাম্য রেখে হেঁটে গেছে এই বইয়ের কবিতারা, টাইট-রোপ ওয়াকিং-এর মত, কোনও এক দিকে অতিরিক্ত হেলে পড়েনিসেখানেই মুনশিয়ানা, কবির

মায়ের প্রতিকৃতিটি এখানে বড় যত্নে এঁকেছেন শিল্পীতাঁর শাশ্বত কল্যাণীরূপটি তো আছেই, সঙ্গে আছে এক চিরকিশোরীর আদলওফড়িং-এর সঙ্গে ঘুরে বেড়ানোর মত প্রাণোচ্ছল আর ছেলেমানুষ যিনি, একই সঙ্গে উদাসী আনমনা-

রান্না ঘরে আম্মা
দুধের দিকে তাকিয়ে - ধীরে ধীরে জমছে সর
দুধের বলক থেকে উড়ে যাচ্ছে ঢেউ

মজা হল, কবিতাগুলি আঙ্গিকের দিক থেকে সমধর্মী, এমন নয়আদ্যন্ত ছন্দের কাঠামোয় লেখা কবিতা আছে এখানে, তেমনই আছে ফ্রি ভার্স, আছে টানা গদ্যের লেখাকিন্তু ভাবগত দিক দিয়ে এমন তীব্র সাযুজ্যে  গাঁথা সবটা, যে মালা থেকে একটি ফুলও আলগা হয়ে খসে পড়ে না

এবং, এক অপার সারল্যের গন্ধ মিশে আছে এই কবিতাগুচ্ছে কী সহজ সব উপাদান - ওপরের তাকে তুলে রাখা হাঁস মার্কা নারিকেল তেলের কৌটো, ব্যাগের হাতল থেকে ঝরে যাওয়া নাইলন  এক নিষ্পাপ, নির্লোভ বাল্যকাল  জড়িয়ে আছে, আদ্যোপান্তকিন্তু, কবিতাগুলি   নিছক পারিপার্শ্বিকের বিবরণ হয়ে থেমে থাকে নি, তার মধ্যে থেকে উঠে এসেছে  স্থান-কাল অতিক্রম করা কিছু  আশ্চর্য উচ্চারণ – “শৈশবে আমার কোনো জুতা ছিল না/ শুধু মাপ ছিল পায়ের”, “নাম ধরে ডাকলে রাস্তাও ছোট হয়ে যায়”, “নিরশ্ব হাওয়ায় আঁতুর শরীরটুকু মনে হয় অসমাপ্ত মা

শব্দপ্রয়োগের আকস্মিকতায় মাঝে মাঝেই মুগ্ধ হতে  হয় - এই যেমন এখানে নিরশ্ব হাওয়া”, অন্য কবিতায় হাঁটুজল সূর্যাস্তআরও ভালো লাগে এইজন্য, যে এইসব ব্যবহারে শব্দের আলগা চতুরতা  নেই, পাঠককে চমকে দেওয়ায় চেষ্টা নেই, বরং আছে এক অন্যতর  দৃষ্টিতে  পৃথিবীকে দেখতে চাওয়া -

লীন এক সাম্রাজ্য ভেঙে
উঠে আসে সারি সারি চোখ
পেছনে আম্মার ডাক, পাতার করুণা

বাংলাদেশের তরুণ কবি হাসান রোবায়েতের এই বইটি প্রকাশ করার জন্য ধন্যবাদার্হ হয়ে রইলেন পশ্চিমবঙ্গের নবীন প্রকাশনা তবুও প্রয়াসকাঁটাতারের বিভেদ এভাবেই মুছে যাককারণ, বাড়ি-প্রসঙ্গে কবি  লিখেছেন, দেশের ক্ষেত্রেও তা সত্যি... যে-কোনও ভূখন্ডের সবচেয়ে বড় অপচয় যে তার সদর দরজা! আলো-হাওয়ার মত কবিতাও  থাকুক এমন অবারিত-দ্বার, পাঠক হিসেবে এটুকু প্রার্থনা তো আমাদের থাকতেই পারে!



- রাকা দাশগুপ্ত
আঙ্গিক, বইমেলা সংখ্যা, ২০১৯ 

মন্তব্যসমূহ

জনপ্রিয় লেখা