মায়াজীবনের অলৌকিক পাঠের গোপন ছায়াসংলাপ- পঙ্কজ চক্রবর্তী




মায়াজন্ম
কবি- সেলিম মণ্ডল
প্রচ্ছদ- নক্ষত্র সেন
প্রকাশক- সৃষ্টিসুখ
দাম- ১০০ টাকা


সেলিম মণ্ডল প্রথম দশকের একজন প্রতিশ্রুতিবান কবি। একজন সফল সম্পাদক এবং প্রকাশক। অথচ কবি হিসেবে সূচনা দশকেই নিজস্ব কাব্যভাষা নিয়ে তার আত্মপ্রকাশ। গত বইমেলায় প্রকাশিত হয়েছে সেলিমের প্রথম কাব্যগ্রন্থ ‘মায়াজন্ম’। পাঠকের বিপুল চাহিদায় বইটি দ্বিতীয়বার ছাপতে হয়। এই ঘটনা ছোট পত্রিকা ও প্রকাশনার পক্ষে গৌরবের নিশ্চয়। এই অসামান্য বইটি জুড়ে আছে এক নির্লিপ্ত কবিজীবনের ছায়া। চার ফর্মার বইটিতে লগ্ন অগাধ জীবনের মায়া আর ছোট খাট চাপা সন্ত্রাস।যে সন্ত্রাস রাষ্ট্রকে বিপন্ন করে অস্ত্রহীন- ভাতফুলের দাবিতে। বিভাব কবিতায় কবি আমাদের নিয়ে গেছে আলোছায়া মাখা জীবনের একান্নবর্তী দিনগুলিতে- ‘এঁটো বাসন-কোসন মেজে/মা যখন চকচকে থালায় ভাত বাড়ে/হে রাষ্ট্র তখন তোমার কথা না/মনে পড়ে,খেটে খাওয়া বাবার কথা/বাবা শিল্প বোঝে না/বোঝে,আমরা তিন অভুক্ত প্রাণী/রাষ্ট্র নামক কোনও কুয়োর ভিতর আটকে আছি/আরও অনেক প্রাণীর সাথে’। অনায়াসে হজগামী বাবার বাসনার হাতে সে তুলে দেয় ঢিল যেন সামনের শয়তান বিপন্ন হয়। সেলিমের কবিতা যেন তারই জীবনের জলছবি। কবিতার পর কবিতায় সে রেখে চলেছে স্নিগ্ধ ও অস্থির সময়ের দিনলিপি। মায়ের ভাঙাচোরা শরীরের উৎকণ্ঠার পাশেই বসে আছে অনেক অভিমানী শব্দ। অসহায় পিতা যিনি ফসলের ফলন বুকে দেখে ফেলেন ‘সন্তানের হেরে যাওয়া রোদে পোড়া চকচকে মুখ’। এর পাশাপাশি একই কবিতায় আছে সন্তানের ভিন্নমুখী দুশ্চিন্তা। যখন সন্তানের নিষেধ না শুনে পিতা নেমে পড়েন কোদাল হাতে জমিতে তখন অসহায় ছেলে ভাবে- ‘প্রণাম করব? না,যুদ্ধের মাঠে ধরিয়ে দেব প্রিয় স্যালাইন?’ 

আতরের গন্ধমাখা মিথ্যে কান্না ভরা এক বালকজীবনের ছায়ামাখা ছবি এঁকেছে সেলিম। সকালবেলার স্কুল থেকে অনেকটা দূরে অভিসন্ধির ভিতর ডুবে যায় ছাত্রজীবনের অনেক গল্পগাথা। বিষণ্ণ এক শোকপ্রস্তাবই লিখে ফেলে কবি মাতৃভাষা আর পাঠ্যতালিকার ঘোর বিষমতায়- ‘স্কুল পড়ুয়ারা এঁটো হাতে মিলিয়ে নেবে মুখস্থপাঠ্য/অক্ষর থেকে ধুয়ে যাবে শত মনীষীর রক্ত,নিঝুম!’ একটা অসহায় ছোট সংসার আর তার ভাঙাচোরা জীবন বারবার উঠে এসেছে সেলিমের কবিতায়। পাখি ঠোকরানোর পর অবশিষ্ট জীবন নিয়ে সে বসে আছে যেখানে সংসার বড় হলেও সামঞ্জস্য আসে না থালা সাজিয়ে। যেন সে জীবন আর সময়ের কাছে পাঠ নিয়েছে কবিতার। তাই গোপনে সে লিখে ফেলে চাষির জীবন ‘যার ঋণের খাতায় আত্মহত্যা লেখা থাকে’। তুচ্ছতাচ্ছিল্যের জীবনে সে রোদে শুকোয় মৃত্যু খাটিয়া আর অলৌকিক মায়ায় জাগতিক জন্মবীজ লালন করতে চায়। একটা অসামান্য সাধারণ জীবন জুড়ে সে বিশ্বাস করে ভাতের সুগন্ধ হয়ে ওঠে কবিতা। তার কেবলই মনে হয় ভোরের আজান শুনে কেঁদে ফেলে যে পাখি সে কি অসহিষ্ণু? গাছকে সে কিছু কথা বলেছে বলেই আমরা জেনেছি কাঠুরিয়া গাছকে অবাধ যৌনতা দিয়েছে তাই সে মানুষকে ভালবাসতে অপারগ। 
অসামান্য কিছু উজ্জ্বল পংক্তিতে ভরে আছে সেলিমের অনেক কবিতা। লোভী ও সতর্ক পাঠক বারবার খুঁজে পড়বেন সেসব লেখা। যেখানে সে বলে ‘উড়ে যাওয়াটুকু পাখি হলে/ডানার নির্লিপ্ত অহংকারটুকু ভালোবাসা’ কিংবা ‘মা বয়স গোনে/মা প্রবল বর্ষায় ছেলের আয়ুতে সংগ্রামী হাত বোলায়’। ভাতফুল, হাসপাতাল, লেডি টেলর, মাওবাদী মিথ্যে ধারণা সবকিছু পেরিয়ে দেখি পড়ে আছে আড়ষ্ট কষ্টের নিভৃত বেদনা। মায়ের জ্বর এলে পড়শি এক মেয়ে সেবা করে যায়।অদেখা সেই মেয়েটি আর স্বপ্নের ভিতর অংকের দিদিমনি এটুকুই অস্পষ্ট প্রেম অথবা স্বপ্নদোষ। মা, বাবা, মুনাই, স্কুলমাষ্টার সবাইকে ছেড়ে শেষপর্যন্ত কবি এলেন পাঠকের কাছে-বোধন এবং প্রত্যাশায়-

১। ‘স্তন একটা নিশুতি রাত/স্তন একটা নিশুতি রাতের অলৌকিক চাঁদ/বুঝতে বুঝতে কিশোরী যেদিন মা হল/কোনও এক রাস্তার মোড়ে তাকে দেখা গেছিল জবার মতো/কিন্তু বোঝার উপায় ছিল না সে কোন পুজোর ফুল ছিল’ (বোধন২)

২। ‘কবিদের ভিতরে একটা নরম পুতুল থাকে/সেই পুতুলের কান্না পাঠক শুনতে পায় না/পাঠক দেখে সাজানো ঘর সংসার/কবি অনায়াসেই বুকে ছুরি চালায়/সিরিয়াল কিলারের মতো/মুগ্ধ পাঠক হাততালি দেয়/মুগ্ধ পাঠক শুধু বিয়ে দিতে জানে’ (পুতুল)

আমি সেলিমের কবিতার সেই মুগ্ধ পাঠক। শব্দে শব্দে বিয়া’ দিয়ে পুতুলের ঘর সংসার খুঁজি। আর অন্ধ বিশ্বাসে বিড়বিড় করি– এই বই কখনও পথ হারাবে না। প্রথম দশক অতিক্রম করে বেঁচে থাকবে অনেকদিন। আর রাষ্ট্রকে বিনীত কণ্ঠে বলে যাবে- ‘প্রিয় নখ তুমি ভালোবাসা হয়ে যাও/বেড়ে ওঠা গাছেরা বুঝুক/নগরায়ন-কোনও শৈল্পিক আদর নয়/এ তোমারই মতো পরমযত্নে দাঁড়িয়ে থাকা/কোনও মন্দির-মসজিদের ব্যর্থ ছায়া’।

কৃষ্ণনগর স্টেশনে একদিন সেলিম বলে যাকে বুকে জড়িয়ে ধরেছিলাম, সে কি মায়াজন্মের কবি? ব্যর্থ ছায়ায় আমি শুধু দেখতে পাচ্ছি যেন এক অলৌকিক পিওন পথ ভুলে একা একা ঘুরে বেড়াচ্ছে সন্ধ্যার বিষণ্ণ আকাশে।



- পঙ্কজ চক্রবর্তী
আঙ্গিক, বইমেলা সংখ্যা, ২০১৯ 

মন্তব্যসমূহ

জনপ্রিয় লেখা