এঁটে যাওয়া হাতের দস্তানা- প্রগতি বৈরাগী
কবি- রাকা দাশগুপ্ত
প্রচ্ছদ- দেবাশিস সাহা
প্রচ্ছদ- দেবাশিস সাহা
প্রকাশক- আনন্দ
দাম- ১০০ টাকা
দাম- ১০০ টাকা
রক্তের দাগ শুকিয়ে
এসেছে প্রায়। লালচে হাঁমুখ বুজে যাচ্ছে, এখন সামান্য
ভানেই স্টুডিও ফিক্স ৪৩.৫ ঘষে আবছা করে ফেলা যাবে ঘন মেহগনি রং এবড়োখেবড়ো।
ভান আর উচ্ছেদের
মাঝে মুখ বাড়ায় এক আধ-পুরন্ত বাতিল সংসার। হাত পা নাড়ায়,
যেন সদ্য উপড়ে
ফেলা ভ্রুণ, এক্ষুনি পেটের খোলে ঢুকিয়ে নিলেই আবার
আর একখান ফরএভার ফেয়ারিটেল।
আমার নাভির কাছে ব্যথা করে,
মাথার ভিতরে একশো ছুরির কোপ। এসব দিনে আমার ট্রাঙ্কুলাইজার লাগে, নার্ভাস সিস্টেমকে
শুইয়ে রাখবে মর্গের বরফে...অথবা কিছু ব্যক্তিগত
অঙ্গার, সূচিমুখ লেখা,
যারা ছিঁড়ে ফেলবে, একশা করবে ঝঞ্ঝা ছোপানো মগজ।
এমন এক ছন্নমতি দিনে হাতে ঠেকেছিল, আর একটি হাতের
মাপ,
“কী তেজি অশ্বের দল ছুটে আসছে, খুরের আওয়াজ
ঢুকে পড়ছে রাস্তা ছেড়ে, স্থলে-জলে, শান্ত গমখেতে,
সামলাতে পারে না। স্নায়ু কেঁপে উঠছে,
তীব্রতম হ্রেষা
সমুদ্রঢেউয়ের
মতো আছড়ে পড়ল। ঔষধের স্ট্রিপ
তোমার সম্বল; তুমি লাল-সাদা ট্যাবলেটের দ্বীপ
ভাসাচ্ছ জলের প্রান্তে।”
হাত নয়, আশ্চর্য দস্তানা,...
কবি রাকা দাশগুপ্তর “দস্তানা আর শীতের গল্প”। অল্পবিদ্যা আমি, আগে পড়িনি
তাঁকে। অথচ আজ হঠাৎ পড়তে বসে কী নিদারুণ ফিট করে যাচ্ছে সবকটি আঙুল!
আমার সযত্নে বানানো আদিগন্ত
লি লি করা একাকিত্বের উল্টোদিকে যে জীবন সরস, সরোষে বেড়া ডিঙিয়ে ঢুকে পড়ছে
অক্ষরে অক্ষরে,
“চিক্কন ঘোটক-ঘোটকীযুগ্ম চিরে দিচ্ছে নিস্তব্ধ
সরণি,
পদদাপে। দূরে গাঢ় আস্তাবল। দিনান্তের স্তন
ভারী হয়ে এলো
খুব। কিছু পরে জ্যোৎস্না, দুগ্ধবৎ
সমস্ত ভাসিয়ে দেবে- বালিশ, বিছানা, চরাচর,
ঔষধের দ্বীপ, কিংবা জল ভেঙে উত্থিত পর্বত।”
পনেরোটি কবিতা, পঞ্চদশ সমূহ
বিদ্যুৎ…
অক্লেশ বিষণ্ণতায়
রাকা গড়ে তুলেছেন অমোঘ ন্যারেটিভ, যার শরীরে
খোদাই করা ধর্মীয় অনুসঙ্গ-
লোকআখ্যান- ইতিহাস আর এক ফিনিক্স বর্গীয় ফেমিনিনিটি। তার প্রেম ও প্রণয় প্রলাপ, বাৎসল্য, যৌন উল্লাস এবং আদিম রিরংসা।
“বুঝে যাই, যা-কিছু সুন্দর, সবই
দাহ্য, আর যা-কিছু দাহক
সবই রূপবান।”
এমন মোহভঙ্গ ও
মোহবিনির্মাণ এক নিশ্চুপ অস্বস্তি জাগিয়ে রাখে পাতলা ছায়ার মতো।
“যেখানে ঝোপের মধ্যে চকিত সরণ, ওত পেতে
কে কাকে সংহার করছে, অন্ধকারে
বোঝাও যাচ্ছে না
আধপোড়া মাংসের গন্ধে চরাচর
ভারী হয়ে এল”
অস্তিত্বের ভিতর
নড়িয়ে দেয় শেষ লাইনটি, কিন্তু অবচেতনে অশরীরীর মতো অমোঘ হানা
দেয় দ্বিতীয় লাইন।
এই ২০১৯-এর মাছের
জীবন, ধ্বংসঅভ্যাস আর মারণযজ্ঞে ঘেন্না পাওয়া আমি আর একবার চিৎকার দেখে ফেলি রাকার শব্দে,
“তোমাদের প্রেম, এই ব্যূহরচনার শৈলী
যুগপৎ মুগ্ধ করে, বমনও উদ্রেক করে আজ।
জানি পালাবার পথ
নেই। তবু এও জেনো
আমারও তো তাড়া
নেই কোথাও যাওয়ার।…
... শুধু সামান্য পাথর ঘষে ঘষে
তাকে আরও ঋজু আরও তীক্ষ্ণধার
করি, কাছে এলে
নিঃশব্দে বিঁধিয়ে
দেব, বিনা রক্তপাতে। এটুকুই
আমার সভ্যতা,
শিল্প। আমার অস্তিত্ব, প্রতিশোধ।”
এই বই যদি নিরবচ্ছিন্ন
বেরিয়ে পড়া হয়, তবে 'আভে মারিয়া’ সেই সফরে দৈব সরাইখানা। পালতোলা জাহাজের সর্বোচ্চ আন্দোলনে দাঁড়িয়ে
কোন নাবিক যদি তার দূরবীনের মুখ সমুদ্র থেকে ঘুরিয়ে নিজের বুকের উপর রাখে, নিজের ধর্মের উপর রাখে,
তবে দুই কাচের মধ্যে বোধহয় এমনই দেখতে
পাবে।
অনুসঙ্গ টেনে নিয়ে
যায় ঔপনিবেশিক দিন বা ক্রুসেডে। বারবার ফিরে এসেছে গীর্জাঘর, চার্চ টাওয়ার,
জ্বলে যাওয়া মোমের শরীর, শবাধার এবং প্রগাঢ় মধ্যরাত।
মধ্যরাত,
'ধ্বসে যাওয়ার আগের মুহূর্তে’, খসে যাওয়া পোশাকে,
আয়নায় হাত ধরাধরি করে বসে 'আভে মারিয়া’
আর আমার অল্টারইগো, কুমারীবেলার তকতকে লিলিথ। বমির মতো
বয়ে যাচ্ছে সময়, ঝরে যাচ্ছি আমি। চোখের তলার
চামড়ায় কাটা কাটা অন্ধকারে আঙুল রেখে হিংসে হয়, ক্রোধ হয়
তারও বেশি।
“সেই কবেকার এক শিল্পী তোকে মার্বেলপাথর
কুঁদে বানিয়েছিলেন বলে যাত্রাপথে তোর বয়েস বাড়ল না আর, শোকস্নাতা
সদ্যকিশোরীটিই রয়ে গেলি। এদিকে আমার তো মিকেলেঞ্জেলো ছিল না কেউ, তাই আমার চামড়া কুঁচকে, চুল পেকে, শরীর ন্যুব্জ হয়ে গেল ধীরে ধীরে।’
ক্রোধের উল্টোপিঠে
থাকে প্রেম, স্নায়ুতে স্নায়ুতে জোড়া দিয়ে যে কল্পকঙ্কাল, তা যদি জন্মগোলক হত,
তবে সেই গোলকেই মায়াজলে দুলছি আমি আর
সে, ভাসতে ভাসতে ঠোঁটে ঠোঁট ছুঁয়ে দিচ্ছি, মাথা রাখছি
কাঁধে।
“... দেখতে পাচ্ছি তোর পাথরের জামা ফুটিফাটা
হয়ে এসেছে খুব ভেতরে ভেতরে। দেবী নয়, স্তনদাত্রী
নয়, এমনকী বন্ধুও নয়,
তোকে মনে হচ্ছে আত্মজা, যে খুব ভেঙে আছে,
যে অনেক শতাব্দী ঘুমোতে পারেনি। নিজের ঘুমটুকু তোকে দিয়ে, নিজের গর্ভের
মধ্যে টেনে নিচ্ছি তোকে। তারপর উঠে যাচ্ছি স্তম্ভমূল বেয়ে, তোর জায়গা নিতে-
নিবাত, নিষ্কম্প, প্রাণহীন।”
এই স্বপ্রেম, আত্মগার্হস্থ্য থেকে রাকা আমাকে ধাক্কা মেরে বার করে
আনছেন দ্বিতীয়ক্ষণেই। ঘাড় ধরে দাঁড় করিয়ে দিচ্ছেন দুমড়ে
মুচড়ে যাওয়া, যুদ্ধক্ষতে দগদগে ভবিষ্যতের সামনে,
“যে বাচ্চাটি পুতুল নিয়ে এসেছিল ক্যাম্পে,
লুকিয়ে
সে-ই আজ পুতুলের মাথায় ধরেছে
খেলার অধিক খেলা
বন্দুকের নল”
এবং দৃশ্যশেষে ক্ষতের অধিক ক্ষত, মায়ার অধিক
মায়া সেই কবিতাটি।
“দস্তানাটি হাত পায়, হাতও পায় ভুলে-যাওয়া ওম।
কী নিশ্চিন্ত মুঠো
পায়। গল্পে যেরকম হয়। আর
ভেতরে, নিঃশব্দে কিছু ঘাতক শূন্যতা বেঁচে থাকে।”
জানি, আবার কোন থরথর তীব্রতায় আমি ঝুঁকব, পড়ে নেব
দস্তানাটি,... বই, এই মেধাপৃথিবী, যার পরতে পরতে মিশে আছে অজস্র নারীভাজ।
এ বই আমাকে শান্তি
দেয়নি, আনন্দও নয়। দিয়েছে অতর্কিত ভ্রমণ, সহাবস্থান এবং
“সমস্ত যুদ্ধের বীজ। আদিম মুহূর্ত,
বিগ ব্যাং।’
ফলত কবি রাকা দাশগুপ্ত
আমার প্রিয় এবং অপেক্ষার হয়ে রইলেন।
- প্রগতি বৈরাগী
আঙ্গিক, বইমেলা সংখ্যা, ২০১৯
মন্তব্যসমূহ