সে এক ঘুঙুর রক্তজবা শ্লোকের পৃথিবী- পার্থজিৎ চন্দ



গুঞ্জাগাথা
কবি- জয়দীপ রাউত
প্রকাশক– ছোঁয়া
দাম- ১০০ টাকা


প্রিয় প্রিয়তম Kahlil Gibran, কতদিন আগে পড়েছিলাম – Your children are not your children/ They are the sons and daughters of Life’s longing for itself.

আজ আবার ২০১৮-র এক শীতের সন্ধ্যায় চোখের সামনে খুলে যাচ্ছে অন্য একটি বইয়ের পাতারা কে পাঠ করে? কেউ বা পাঠ করিয়ে নেয়? পাঠক ও লেখকের স্থান পরিবর্তিত হয় কী এমন অমোঘ ম্যাজিকে! এক ঘূর্ণির মধ্যে ডুবে যেতে যেতে মনে হয়, এ সব লেখা আমারইঅন্য কেউ একজন এই লেখাগুলি লিপিবপদ্ধ করে গেলেন শুধু
এই বইটি পড়তে পড়তে আমি একবার বাইরে বেরিয়ে পৌষ-আকাশের দিকে তাকিয়ে ছিলাম দু-একটা তারার মিটমিট গ্যলাক্সিইউনিভার্স, না কি মাল্টিভার্স? না কি তাকেও ছাপিয়ে এক অন্ধকারের নিস্তব্ধ প্রসারণআমি জানি না শুধু দেখি, এই মহাশূন্যের নিস্তব্ধতায় সবুজ আমলকির মত দোল খাচ্ছে একটা গ্রহ নারীর পাশে পুরুষ; পুরুষের পাশে নারী ঘুমিয়ে পড়েছে মায়ের পেটে লম্বা দাগ এঁকে দিয়ে জন্ম নিচ্ছে সন্তান বারবার নিজেদেরই জন্ম দিয়ে চলেছে মানুষকিন্তু কবি দেখলেন এবং আমাকে দেখলেন,

আমি তো তখন ছোট, আর দৃষ্টি আলো-আঁধারির
আমাকে দেখালো পথ আমার বড়দা শ্রী-কৃষ্ণ মুরারী

সে পথ চক্রাকার, মহাশূন্যতার
দ্যাখো মা তোমার পেটে, এখনো স্পষ্ট দাগ
                                        রথের চাকার…’ (১৮মে,২০০৯)
-মহাশূন্য থেকে নেমে আসা সেই রথের চাকার দাগ দেখতে পেলেন একবাঙালীকবি। সে রথের চাকা, আমার বিশ্বাস, প্রাণের মাটি-নির্মিত। বাংলা ভাষার লেখা বিদেশী কবিতা পড়তে পড়তে আজকাল ক্লান্ত হয়ে পড়িঅনুবাদ করে বাংলা কবিতা পড়বার অনঙ্গ অন্ধকারে আমি আমার হাত দেখি না পা দেখি না সেই অনঙ্গ অন্ধকারে কেন আজ ফুটে উঠল,

তার সহস্র পায়ের অজস্র আঙুলগুলি বেলফুল
জুঁইফুল টগরের কুড়ি দিয়ে গাঁথা খন্ড খন্ড মালার শিল্পের মতো ঝরে
দুঃখ দুরাশার কথা প্রায় প্রতিটি ঘরেই তারচে আজ সেই
আনন্দের কথা বলি, যেই অপূর্ব আনন্দে শ্রীরামপ্রসাদ সেন লিখে চলেছেন,
শাক্তপদাবলী…’ (শাক্তপদাবলী)  

এই ভারতবর্ষের মাটির মধ্যে লুকিয়ে রয়েছে আত্মার প্রবহমানতার বীজ নৈনং ছিন্দন্তি শস্ত্রাণি নৈনং দহতি পাবকঃ’, মূঢ়ের মত অনেকেই এই লিগ্যাসির থেকে মুখ ফিরিয়ে স্ফূর্তির গান গায় শুধু যা আসলে বিষন্নতার ধারাপাত বা কোটি কোটি বছরের চলাচল, তাকে অনেকেই নামিয়ে আনেন দু-দশবছরের কমিডিতে উল্লাসে হায় এর বিপ্রতীপে আজও কি লেখা হয়ে যাচ্ছে না ,

এজন্মেও তো কত ফুল কত পোকা কত মানুষের মুখোমুখি চিনতে পারিনি যে আমায় হঠাৎ মারল তাকে বলতে পারিনি তুমি বিগত জন্মের তীরে গেঁথে যাওয়া হরিণের নরম মাংস ছিলে আমিই তোমাকে মেরেছি এই ঠাকুরের পিঁড়ি, যার পিঠে বসে এসব ভাবছি, সেই পরজন্মের প্রজাপতি, তুমি আমাকে চিনতে পেরেছ কি?’ (অচিন)

ন হন্যতে হন্যমানে শরীরে থেকে এই বইয়ের পাতায় তো আমি ফুটে উঠতে দেখি আমার পিসিকেও। দেশান্তরিত হয়ে, শিকড় উপড়ে সেই নোয়াখালীর গ্রাম থেকে এপার বাংলায় চলে আসা, পিসি। পিসিমার শনের মত চুল হাওয়ায় উড়ছে। পিসি, তোমার ছোটভাই, মানে আমার বাবার সঙ্গে তোমার বহুদিন পর দেখা হল। দু’জনেই রোদে-পুড়ে জলে-ভিজে, তামার থেকেও বেশী তামাটে। এক অশ্রুনদীর পাড়ে বসে আমি দেখছি সেই ছায়াচিত্র। ঠিক একই ভাবে ভেবে চলেছি,

‘আমি নীলপাড় শাড়ি পরা তপুদি’র ক্লান্ত পায়ের কাছ বসে
মেজো পিসির হারানো বালাটি খুঁজছি ...

একদিন ফিরিয়ে দিতে হবে।’ (বালা)

এক একটা বই থাকে, যে বই বুঝিয়ে দেয় কবিই পারে, একমাত্র কবিই পারে ছিন্নভিন্ন স্মৃতির মধ্যে টাইম-ট্র্যাভেল ঘটিয়ে দিতে। জীবনের কাছে স্তব্ধ হয়ে, নতজানু হয়ে বসে পড়তে হয় এই লেখা পড়বার পর,

‘মাঝখানে বহুযুগ কেটে গেছে।
তোমার সন্তান তার সন্তানের কাছে, দিয়ে গেছে
তোমার ঘুমের ভার

আজ জেগে ওঠবার দিনে, দেখো সে আবার এসেছে।
তাকে ফের নাচের ইস্কুলে নিয়ে যবার জন্য তুমি
উদ্যোগী হচ্ছো তার ঘুঙুর বাঁধার...’

-হাজার হাজার বছরের মেধা-শ্রম-মনন-কল্পনা-আধ্যাত্মিকতা ও অনাসক্তির শরীরটিকে জলের পোশাক পরিয়ে দিয়েছেন একজন কবি। যে মহাশূন্য ভয়াবহভাবে স্তব্ধ, সেখানে আজ গড়ে উঠেছে জলের বাড়িঘর। এক নাচের স্কুল। সন্তানকে আবার নাচের স্কুলে পাঠানোর প্রস্তুতি নিচ্ছে মানুষ। একটা ঘুঙুরের টুংটাং নেমে আসছে পৃথিবীর দিকে।
দুলে উঠছে স্তব্ধ মহাকাশ।


-পার্থজিৎ চন্দ
আঙ্গিক, বইমেলা সংখ্যা, ২০১৯ 

মন্তব্যসমূহ

জনপ্রিয় লেখা