কাশ্মীরকি কলি অথবা পেলেট গান বুলেট- অলোকপর্ণা
কাশ
সম্পাদনা- অদ্বয় চৌধুরী, অভিষেক ঝা
প্রচ্ছদ- দেবদ্যুতি কয়াল
প্রকাশক- বৈভাষিক
দাম- ২৫০ টাকা
কাশ্মীর
একটা আক্ষেপের নাম। একটা ক্ষত যা মাঝে মাঝে উস্কে দিলে ভারতের পক্ষে দুঃখবিলাস করা
সম্ভব হয়। অথচ যখন উপত্যকায় চড়ে বেরানো ভেড়ার রোমের উষ্ণতা থেকে, দস্তরখানে ফেলে
রেখে চলে যাওয়া তন্দুরের টুকরো থেকে, জেগে থাকা মায়ের ধকধকে চোখ দিয়ে প্রতিধ্বনিত
হয়,- কাশ্... তখন কাশ্মীরের পক্ষে এই আক্ষেপের মধ্যে কোনো রোম্যান্টিসিজম নেই,
কোনো দুঃখবিলাস নেই, বরং ঘুমের মধ্যে নিস্তব্ধতা খান খান করে বেজে ওঠা বন্দুকের
আওয়াজ আছে, কুয়াশা আর বারুদের ধোয়ার মিলমিশে তৈরি অপার দীর্ঘশ্বাস আছে, আর আছে
কাশ্মীরী মানুষদের সেই জেগে থাকা ধকধকে চোখ, যে চোখে তারা ভারতকে দেখছেন, ভারতকে
মাপছেন। “কাশ্” হল ঠিক তেমনই এক আয়না, যে বাকী ভারতকে টেনে হিঁচড়ে সমস্ত প্রশ্নের
মুখে দাঁড় করিয়ে দেয়।
ক্ষত বিষয়ে
লিখতে দিলে বোধ করি এমন বই তৈরি হয়। শরতের লাল চিনার পাতার থেকেও ক্ষতয় লাল যে
ঝিলাম নদী, সেই নদী বয়ে গেছে বইয়ের প্রচ্ছদের ওপর দিয়ে, কাশ্মীরকে দুইভাগে ভাগ করে
দিয়ে। অসাধারণ এই প্রচ্ছদ করেছেন দেব্দ্যুতি কয়াল। একখণ্ড বরফের মত নিষ্পাপ দেখতে
এই বইয়ের প্রচ্ছদে তুষারের শৈত্য ছেয়ে আছে। এই শীতলতা কাশ্মীর প্রসঙ্গে ভারতীয়
শীতলতার মত ছেয়ে আছে বইয়ের প্রতিটা পাতায়।
“... শাহিনা
দেখেছে কীভাবে একের পর এক লোক খুন হয়েছে, নয়তো রহস্যময়ভাবে গুম। কদিন মাত্র আগে,
তাঁর এলাকার চারটি ছেলেকে তুলে ন্যে গেছিল গোলাগুলি চলার সময়। এখনও বাড়ি ফেরেনি
তারা। তাঁর প্রতিবেশি মুগলির নবম শ্রেণিতে পড়া ছেলেটিকে পাওয়া যাচ্ছে না...”
- তিহারের চিঠি। বিলাল হান্ডু। অনুসৃজনঃ অনুরাধা
কুন্ডা।
কাশ্মীরি
মুসলমানেরা মুদ্রার একপিঠ হলে পন্ডিতরা অপর পিঠ, এবং এই মূদ্রা অনবরত গড়িয়ে চলেছে
নিয়তির এক হাত থেকে আরেক হাতে,
“... দুবছর
বাদে যখন সে মারা যায়, তখন তাঁর চোখ স্থির ছিল একটাই দিকে, বিড়বিড় করছিল। মারা
যাওয়ার ঠিক আগেও সবাই অস্ফুটে শুনতে পায়, ‘বাড়ি হারিয়ে ফেলেছি। আমার আকাশ
কোনখানে?’”
- আমার আকাশ কোনখানে? বীণা পন্ডিত কউল। অনুসৃজনঃ ঈশান
বন্দ্যোপাধ্যায়
শুধুমাত্র
কাশ্মীরকে জানার জন্য এই বই পড়া উচিৎ তা নয়, গল্পের প্রয়োজনেও এই বই অবশ্যপাঠ্য।
এখানে বিশেষ ভাবে উল্লেখ করতে হয় মহম্মদ তাহিরের পরিযায়ী গল্পটির কথা যা অনুসৃজন
করেছেন দেবার্ঘ্য গোস্বামী,-
“‘প্রথমে
ঠাস – ঠাস আওয়াজ শুইনে শালার কিছুই বুঝি না কী হইতেসে! তারপর মাজিদ সাহের বলল যে
আর্মি এনকাউন্টার। আমাদের প্রথম তো!’
‘শোন’,
জামাল বলে, ‘এরকম হইলে সঙ্গে সঙ্গে জানাবি কোথায় আছিস, কী সমাচার। এইখানে দিনে
দুপুরে মানুষ হাপিস হয়া যায়। আমি জানি কিসুই হবে না, তবু সাব্ধানের মার নাই। মনে
রাখিস এইটা তোর এত্থা না, দিল্লি না। এইটা কাশ্মীর। এইখানে সব কিছুই আলাদা।’
মাথা নাড়ে
নবাগত। মুসুর ডাল মাখা ভাতে আবার নড়েচড়ে ওঠে আঙুল। এক থাল ভয় সুড়ুৎ সুড়ুৎ করে
পাকস্থলীতে চালান হতে থাকে।”
অথবা বলা
যায় পীরজাদা মুজামিলের লেখা “আজহার”- এর কথা, যা এক পেলেট গান বুলেটের আত্মকথা, যা
অনুসৃজন করেছেন মোস্তারিনা ইসলাম-
“আমি
মানুষকে অন্ধ করি। হ্যাঁ, আমি ওদেরকে চির অন্ধকারে ঠেলে দিই। প্রথম প্রথম ওসব আমার
ভালো লাগত না। কিন্তু আমার ভালো বা মন্দ লাগাতে কিছু এসে যায় না। কাজটি আমি করলেও
আসলে আমাকে দিয়ে করানো হত। আর যেহেতু আমার ভূমিকাটি শুধু মানুষ অন্ধ করার ছিল, তাই
মালিকের ডাক পড়লেই আমি খুব দ্রুত এবং দক্ষভাবে ছুটে যেতাম ওদের চোখের দিকে। খুব
পাতিভাবে বললে ওদের চোখ ফুঁড়ে দিতাম। কেন জানি না ধীরে ধীরে এসব আমার ভালো লাগতে
লাগল।”
অথবা শাহনাজ
বাশিরের “মৃত্যুর খবর” যা অনুসৃজন করেছেন অদ্বয় চৌধুরী,
“... ‘ইয়ুথ
কিলড ইন মিশাপ উইথ আর্মি ট্রাক’।
‘সত্যিকারের’
মৃত্যুর খবর যে পড়তে চেয়েছিল। এই ছোট্ট খবরটা ‘সত্যিকারের’ মৃত্যুর খবর হয়ে উঠতে
পারে না পুরোপুরি। তবু, দিনের শেষে, ম্লান মুখে কিছুটা আলো ফিরে আসে মালিকের। সেই
আলো ফিরিয়ে আনে এই খবরটা।...”
সদত হাসান
মান্টোর গল্প পড়ার মতই রোমহর্ষক অভিজ্ঞতা হয় এই গল্পগুলি পড়লে। এসব অসামান্য গল্প
কাশ্মীরি সমস্যা ছাপিয়ে আন্তর্জাতিক পৃথিবীর উদ্বাস্তু সমস্যাকে ঘরে এনে ফেলে অতি
সহজে। বাংলায় এরকম কাজ এই প্রথম, কাশ্মীরি পন্ডিত ও কাশ্মীরি মুসলমানদের
সাম্প্রতিকতম ছোটগল্পের অনুসৃজন এর আগে হয়নি। অনুসৃজন শব্দটা এক্ষেত্রে লক্ষ্য
করার মত। যুগ্ম সম্পাদক অদ্বয় চৌধুরী ও অভিষেক ঝা-র মতে-
“কাহিনীর
নির্যাস, উদ্দেশ্য ও গুরুত্বকে সম্পূর্ণরূপে বজায় রেখে তাকে যথাসম্ভব সুপাঠ্য করে
তোলার উদ্দেশ্যে গল্পের বাক্যবিন্যাস, সময়কাল, ভাষাগত কাঠিন্য, পরিবেশনা এবং
অন্যান্য সমস্ত বিষয়ে প্রয়োজনীয় পরিবর্তনের স্বাধীনতা নেওয়া হয়েছে। সেই কারণেই ‘অনুবাদ’ শব্দটির বদলে ‘অনুসৃজন’
শব্দটি ব্যবহার করাই বাঞ্ছনীয় মনে হয়েছে আমাদের।”
কিছু কিছু
অনুসৃজন বাদ দিলে বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই অনুবাদের ছায়া টের পাওয়া যায় না। এখানে “কাশ্”কে
আলাদা করে ধন্যবাদ জানানো উচিৎ। বইয়ের বহু গল্পই কাশ্মীরি থেকে ইংরেজি এবং তারপর
বাংলায় অনুসৃজন করা হয়েছে। তবু কাশ্মীরি কাওয়ার মত, কাশ্মীরি গুস্তাবার মত গল্পের
স্বাদ বা আঁচ তাতে একটুও কমেনি।
বইয়ের শেষে
লেখক ও অনুবাদক পরিচিতি বইটিকে সম্পূর্ণ করেছে। বইটির ভূমিকায় ডঃ সুগত বসু বলেছেন,
“...দুর্ভাগ্যবশত গত তিন দশকে কাশ্মীরে সংঘটিত মানবতাধ্বংসকারী চরম বিয়োগান্ত
পরিস্থিতি ভারতের অন্যান্য প্রান্তের মানুষদের বোধশক্তির বাইরেই রয়ে গেছে।
কাশ্মীরি গল্পকারদের মর্মস্পর্শী ছোটগল্পের এই অনুসৃজন সংকলন অবশ্যই সেই
দুর্ভাগ্যজনক পরিস্থিতির প্রতি সংবেদনশীল প্রতীতির বহুল প্রসার ঘটাতে সক্ষম হবে,
সক্ষম হবে উভমুখী ভাবের আদান- প্রদান ঘটাতে।...”
“কাশ্” –এর
এই যে উদ্দেশ্য, আমার মতে তা সফল হয়েছে। কাশ্মীর সমস্যার তাৎক্ষনিক সমাধান আনা
আমাদের পক্ষে সম্ভব না হলেও, ভারতের কাশ্মীরের প্রতি সহমর্মীতাও আমাদের নূন্যতম
মানবিক করে তুলবে। এবং “কাশ্” সে চেষ্টায় সফল।
- অলোকপর্ণা
আঙ্গিক, বইমেলা সংখ্যা, ২০১৯
মন্তব্যসমূহ