একটি এক ফর্মা- বিবস্বান দত্ত



অন্য এক অন্ধকার
কবি- কুন্তল মুখোপাধ্যায়ের
প্রচ্ছদ- রাজদীপ পুরী
প্রকাশক- তবুও প্রয়াস
দাম- ৩০ টাকা


জীবনে যত সম্পর্ক পেয়েছি সবই এক ফর্মার বইয়ের মত। রাস্তায় হাঁটছি। চেনা বইয়ের দোকান। উল্টোতে উল্টোতে দুএকটা লাইন। ভালোলাগা। এবং আমাকে কুড়িয়ে নিল রোদ। মুহূর্তযাপন! খুব তাড়াতাড়ি শেষ হয়ে যায়। 

সম্পর্ক শেষ করে চলে গেল যে, সে আসলে এইবার থাকতে শুরু করল। একেকটা শব্দ গেঁথে রইল সুতীক্ষ্ণ বল্লম। সেই শব্দের জন্য আদিগন্ত রাত চুপ করে আছে। 

কুন্তল মুখোপাধ্যায়ের এক ফর্মা। 'অন্য এক অন্ধকার'। প্রথম কবিতায় তেমন এক শব্দ- "সারাধানমাঠ"। এবং কবিতার ছাত্র আমি অপরাধ করলাম। একটা কবিতাকে পড়তে শুরু করলাম ভেতরের একটা শব্দ থেকে। ওই একটা শব্দ আমার চোখে বিছিয়ে দিল দিগন্তলীন মাঠ। এক বিশাল ফ্রেম। 

আসলে হল কী, আমার অভ্যস্ত শব্দচিহ্নধারণা বিচ্যুত হল ওই শব্দটির কাছে এসে। এমনিতে শুরু থেকে বেশ চলছিল। কবিতার নাম 'দেবতার গ্রাস'। সভ্যতা যদি কোনো দেবতা হয়, তাহলে তার আশীর্বাদ প্রচুর। তার নৈবেদ্যও কিছু অকিঞ্চিত নয়। 
"কত ধানমাঠ গিলে খাবার পর আমাদের তীব্র গতি দিয়েছ হাইরোড
জালের মতন সারা দেশ জুড়ে তোমাকে বিছিয়ে দিয়েছি আমরা
দুপুরের মরীচিকায় জলের ভিতর থেকে উঠে আসে আমার মরা মাসি
আমার অজস্র ভাইবোন
যমরাজের মতো আসছে ন্যাশনাল পারমিট ট্রাক

কাটা হাত লাফাচ্ছে দেহের থেকে দূরে
সারাজীবন সেই হাত তাড়া করে বেড়াচ্ছে

আকাশ থেকে ফিরে আসছে আর ধানমাঠের মৃতদেহের ভিতরে
ঘুমিয়ে পড়ছে সেই হাত"

হাইরোডের দুর্ঘটনা। ন্যাশনাল পারমিট ট্রাকে। ধানমাঠের মৃতদেহ যে হাই রোড , সেইখানে পড়ে রয়েছে দুর্ঘটনায় ছিন্ন হাত। এবং সময় যথারীতি দুর্ঘটনা মুছে নিয়েছে। কিন্তু স্মৃতি। সেইখানে বিঁধে রইল কাটা হাত। যা আকাশ থেকে ফিরে ফিরে আসে।  এরপরেই কবিতাটি আশ্চর্য উড়ান দেয়। 
"হাতের মালিক সারাধানমাঠ খুঁজে বেড়াচ্ছে মাসি মাসি
গোল চাঁদ ফেটে ফেটে যাচ্ছে মাসি মাসি

মৃতদেহ আরও একটা

ঘিলু জড়ো করছি"

হাতের মালিক তো মৃত। কিন্তু খোঁজগুলো মরে না কখনো। ধানমাঠের বিষন্ন মৃতদেহের ওপর শুয়ে আছে হাইরোড। সেই সারাধানমাঠের সন্ধান কোনো পরিণামী গন্তব্যে নিয়ে যাবে না হাতের মালিককে। মৃত মাসি, মৃত অজস্র মরা ভাইবোনকেও তো খুঁজে পাওয়া যাবে না আর। সেই না পাওয়ার দুঃখে কি ফেটে ফেটে যায় গোল চাঁদ? আমরা জানি না। সত্যি বলতে আমার মন শুধু অবাক হয়ে বিঁধে থাকে সারাধানমাঠ শব্দটির দিকে। এই বইয়ের কবিতাগুলিতে শব্দ আসে এক চূড়ান্ত অনিবার্যতায়। এবং বারবার পাঠককে দাঁড় করিয়ে দেয় এক আশ্চর্যের দিকবলয়ে। যেমন 'বন্ধুত্ব নিয়ে' কবিতাটির দরজা আর দরোজা শব্দের ব্যবহার।

"দরজা বন্ধ হলে সারি সারি অসংখ্য দরোজা খুলে যায়"

দরজার থেকে দরোজা কত দূর? কত শীতের মত বিচ্ছেদ? কত হলুদ উলের শীত! আসলে অসংখ্য খোলা দরোজা  সেই বন্ধ দরজার জন্য মন কেমন মুছে দিতে পারে না। পারে না বলেই "পুরাতন পাখি ক্ষয়াটে মিছিড়ি ঠোকরায়"।  

এক বাজারের দৃশ্য থেকে শুরু হয়ে 'রবিবার সকালে' কবিতাটিও এক আশ্চর্য জায়গায় চলে গেছে। কবিতাটি শেষ হচ্ছে এইভাবে,
"আমাকে ঘিরে ধরল আমার বাড়ি, আর
 সম্পর্কের মধ্যেকার মায়াবী বাজার..."

কবিতাটিতে আগেই বলা হয়েছে, "বাজার আসলে মৃতদেহের সমবায়"। বাড়ি আর সম্পর্কের মধ্যেও তাহলে থেকে যায় বিক্রীত অথবা বিক্রয়যোগ্য কিছু মৃতদেহ! 

এ কোনো প্রতিক্রিয়া নয়। সমালোচনার বৌদ্ধিক পথে এই লেখা কখনো হাঁটবে না। এ শুধু আরেকবার চকিৎ পড়ে নেওয়া এক প্রিয় বই। আর খানিকটা হলেও দেখে নেওয়া, এই বইয়ের কবিতাগুলোয় কবির মন কীভাবে কাজ করছে। 

কুরোসাওয়ার dream এর ঋণ স্বীকার করে শেষ হয়েছে 'লুপ্ত' কবিতাটি। এ কিছু হেরে যাওয়া মানুষের গল্প শোনায়। হারলে নাকি মানুষ সুন্দর হয়ে ওঠে! তাদের চোখের সামনে মিষ্টি রোদ, উঠোনের এলো ধান, চলিষ্ণু জলের শব্দ, কোজাগরী চাঁদ আবার অন্ধকার। তেঁতুলভাঙার শব্দ আর অফুরান দুপুরে ফটিক পাখির একটানা ডাক। এ এক লুপ্ত পৃথিবী.. হেরে যাওয়ার পৃথিবী। মনকেমনের ঠিকানা। তবু স্বপ্নের চোরা পথে সে আমাদের কাছে আছে। যেমন আসে ঘাতক হাইরোডে মৃত ধানমাঠ। হয়ত। আসলে আমাদের সম্পর্কগুলোও হারিয়ে সহজতা ফেলছে। হারিয়ে ফেলছে ধানমাঠের প্রাণপ্রাচুর্য। বদলে সেখানে বসে গেছে মৃতদেহের মায়াবী বাজার। ধোঁয়া-রক্ত-গাড়িহর্ন চ্যাটচ্যাটে যৌনতার এক অকারণ আড়ম্বর। হাইরোডের যান্ত্রিক উল্লাস। 

জীবনে যত সম্পর্ক পেয়েছি সমস্ত একফার্মার বই। তাড়াতাড়ি শেষ হয়। কিন্তু থেকে যায়। যেমন থেকে যায় প্রিয় দুঃখ। চোরকাটা প্রেম। একাকী। নিজেকে জানান দেওয়া তার কাজ নয়। তাকে খুঁজতে হয়। 

কুন্তল মুখোপাধ্যায়ের 'অন্য এক অন্ধকার' আমায় সেই খোঁজের আরেকটু কাছে নিয়ে যায়। এই বই কবিতা পাঠকের মন ছোঁবেই।


-বিবস্বান দত্ত
আঙ্গিক, বইমেলা সংখ্যা, ২০১৯ 

মন্তব্যসমূহ

জনপ্রিয় লেখা