অলোকপর্ণা
You Only Live Once
ফাঁকা এক ট্রেনের কামরা, শনশন করে বয়ে যাচ্ছে যাদবপুর- বাঘাযতীন বাতাস। ফাঁকা কামরার হাতলেরা দুলছে না থাকা যাত্রীদের স্বভাবে। ট্রেনের ফিকে গায়ে যেন সদ্য লিখতে শেখা শিশুর হাতে লেখা, “বন্ধুত্ব করবে? ২৩৪৫****” একটু দূরেই আরেক নতুন হাতেখড়ি হওয়া হরফে
“প্লে বয়,- ২৭৮৬****”, তাকে ছাড়িয়ে ড: লোধের মোক্ষম দাওয়াই ফ্লুরোসেন্ট রঙের নির্দোষ কাগজের
গায়ে খচিত। অর্শ শুনতে বেশ হর্স- হর্স,- উহাই কি ঘোড়ারোগ?- মামাবাড়ি থেকে ফেরার পথে এসব দেখতে থাকা তিতির তা বুঝতে পারে না,
তবে জানে ক্লাসমেট রিয়ার মা এতে ভোগেন, রিয়াই বলেছে। ট্রেনে চড়লে আরেকটা বিজ্ঞাপন খুব দেখতে পায় তিতির,- মদের নেশা ছাড়ানো/ মানসিক
সমস্যা দূর করার প্রজ্ঞা নিয়ে পাতলা হলদে কাগজ ফড়ফড় করে হাওয়ায়। মনে হয় এই বুঝি মানুষের
নেশা ছাড়াবার বা মন ঠিক করার যাবতীয় সমাধান নিয়ে সে কাগজ নিরুদ্দেশ হয়ে যাবে
হাওয়ার সাথে।
ছোটবেলায়
জীবন খুব রহস্য করে। ডি ডি ১ এর অদ্ভুত লোগো থেকে শুরু করে নিরুদ্দেশ সম্পর্কে
ঘোষণা, সবকিছুই রহস্যে মোড়া, এই এত এত লোক খাকি প্যান্ট ও নীল জামা পরে কোথায়
হারিয়ে যায় তিতির বোঝে না। আর যদি একদিন সবার খোঁজ পাওয়া যায়, সবাই মিলে যদি
ভবানীভবন এসে জড়ো হয় দৃশ্যটা কেমন লাগবে? তিতির মনে মনে ভাবে ডানদিকের ভুরুতে কাটা
দাগ বা নাকের ওপরে আঁচিল সহ মানুষগুলো ফিরে এলে ঠিক কেমন দেখাবে ভবানীভবন নামের
বাড়িটাকে? এর থেকেও বেশি অবাক লাগে কেকের মত দেখতে ব্যান্ডেজের বিজ্ঞাপন শুরু
হলেই। মন খারাপ করে স্কুল থেকে বাড়ি ফেরা মেয়ে ওই ব্যান্ডেজ লাগিয়ে সেরে ওঠে,
কোথায় লাগায় তা আর দেখানো হয় না। মা ও মেয়ে সবশেষে একজোট হয়ে আনন্দের গান করে।
তিতির ভাবে মা বুঝি এসব দেখেই বলে, “মেয়েরা বড় হলে মায়ের বন্ধু হয়।” আরো এক
রহস্যময় বিজ্ঞাপন ছাতা হাতে রাতের বেলা বৃষ্টি ভিজতে থাকা প্রেমিক যুগলকে কেন্দ্র
করে (তখনও প্রেম শব্দটি জীবনে সেন্সরড ছিল), রাতের অন্ধকারে ছাতা হাতে তারা প্রেম
করতে বেরোয় আর গান শোনা যায়, “প্যায়ার হুয়া, ইকরার হুয়া হ্যাঁয়...”, খুব করে ছাতা
দেখানো হয় কিন্তু এ ঠিক যথার্থ ছাতার বিজ্ঞাপন নয়, তিতির তা বোঝে।
বিজ্ঞাপন
অনেক কিছু শেখায়, কালো মেয়ের সাদা হওয়ার ম্যাজিক ক্রিম শিখিয়েছে সাদা হওয়াটাই
কাম্য, এবং তা না হলে তাদের জীবনের মোক্ষলাভ aka বিবাহ অসম্ভব। সুগন্ধী তেলের বিজ্ঞাপন শিখিয়েছে চুল হতে হবে
ঘন কালো। হেলথ ড্রিঙ্ক এর বিজ্ঞাপন দেখে শেখা গেল খাঁটো বা লেখাপড়ায় কমজোরি হওয়ার
গ্লানি, এবং বেশিরভাগ বিজ্ঞাপনই শেখায় পৃথিবীটা পাতলা ঝকঝকে সুখী মুখের মানুষদের–
খুব অল্প বয়স থেকেই এসব ছাঁচে ফেলার ক্লাস শুরু হয়ে যায়, যেমন তিতিরেরও হয়েছিল।
তারপর একদিন জীবনে “কেক ব্যান্ডেজ”-এর প্রয়োজনীয়তা বোঝার সময় এল।
এইবয়সে
তিতির বিজ্ঞাপনের ভক্ত হয়ে ওঠে, বাড়ির সবাই সিরিয়াল দেখতে বসলে তিতির সিরিয়ালের
মাঝের বিজ্ঞাপন গিলবে বলে পাশের ঘরের পড়ার টেবিল থেকে লুকিয়ে লুকিয়ে উঁকি দেয়।
টিভির পর্দায় দেখা যায়, সুগন্ধি গায়ে মেখে অনাবিল এক যুবা অসংখ্য যুবতীকে আকর্ষণ
করতে সক্ষম হচ্ছে। একই ভাবে সুগন্ধির বদলে জান্তব বাইক ও বাইক আরোহীকে দেখা মাত্র পৃথিবীর
সমস্ত মেয়ের হাত থেকে অফিসের ফাইল আকাশের নক্ষত্রের মত খসে পড়ে। এসব দেখে তিতিরের হঠাৎ-ই মনে পড়ে যায় বাসে যেতে যেতে দেখতে পাওয়া “বশীকরণ,
সরকারী চাকরি, প্রেমে বিফলতা, দাম্পত্য কলহ এবং ইত্যাদি ইত্যাদি” লেখা তীক্ষ্ণ হলুদ
হোর্ডিং। সাথে দাড়ি গোঁফের আড়ালে লুকিয়ে
থাকা বিস্ফারিত অথবা অর্ধনির্মিলিত নেত্র আপাদমস্তক লাল এক মানব, বা যদি মানবী হন
তবে লাল পাড় সাদা শাড়ি এলো চুল, কপাল জোড়া লাল সুর্যের চেয়েও বড় সিঁদুরের টিপ থাকা
আবশ্যক। এসব বিজ্ঞাপন খবরের কাগজের পাতাতেও থাকে, সেই একই পাতায় মৃত্যু সংবাদ আর
নিখোঁজ সংক্রান্ত খবর পড়তে গিয়ে তিতির এই মানুষদের দেখতে পায়। তিতির ভাবে রাতে ঘুমের আগে
এসব মানুষ কি ভাবে? এদের ঘুম ঠিক মতো হয়?
এরপর তিতিরদের
জীবনে এলো ফেসবুক, এই বইয়ের সমস্ত পাতার সমস্ত মানুষ সুখী, আনন্দিত,
কর্মময়, ও হ্যাপেনিং জীবন যাপন করে। একেকটা মুখ- একেক রকম
বিজ্ঞাপন। তিতিরও নিজের বিজ্ঞাপন দেয় ফেসবুকে, একই প্রোফাইল ফটো কুড়িদিনের বেশি রাখে
না, রোজ সকালে উঠে কুড়ি জন প্রিয় বন্ধুকে সুপ্রভাত ও রাতে শুভরাত
জানিয়ে যায়। আর মাঝে মধ্যে এটা সেটা পোস্ট করে। কারণ বাকিদের মতই তিতিরও জানে এসব করতে হয়, এসব না করলে পাশের ঘরের মানুষটাও ভাবতে পারে তিতির আর নেই,-
তিতির মরে গেছে। চ্যাট উইন্ডোর ফাঁক দিয়ে ফেসবুকের এড দেখা যায়, হাসতে থাকা সুসজ্জিত একটা দুটো মুখ,
পাশে বড় করে লেখা, “বন্ধু চাই?”, বাংলা ইউনিকোডে লেখা হরফগুলো দেখে এখন আর কাঁচা হাতের কাজ বলে মনে হয় না। তিতিরদের নামের পাশের সবুজ আলো আজীবন জ্বলতে থাকে।
মন্তব্যসমূহ