একটা বড় হয়ে ওঠার বই- রাজর্ষি মজুমদার





হাওয়া শহরের উপকথা
লেখক- অলোকপর্ণা
প্রচ্ছদ- নক্ষত্র সেন
সৃষ্টিসুখ প্রকাশনী
দাম- ১৫০ টাকা



কয়েকবছর আগে, ঠিক কোন সাল মনে নেই একজন আমায় হঠাৎ জিজ্ঞেস করল – “আচ্ছা, মিস ইউ এর বাংলা কী?”
আমি অনেক ভেবেটেবে শেষ পর্যন্ত একরকম হার মেনে নিলাম। উত্তর জিজ্ঞেস করতে সে বলেছিল – ‘র’ পত্রিকায় এবারে অলোকপর্ণার এক লেখা বেরিয়েছে, সেখানে খুঁজে দেখ। 

পেয়েছিলাম। কেউ যেন আলগোছে, অর্ধেক লিখে রাখা চিঠির মতন ফেলে গেছিল “তোমায় হারাচ্ছি” শব্দ দুটো। তারও অনেকদিন পর আবার এই বইতে খুঁজে পেয়েছিলাম লেখাটা – “অভিমানের ইংরেজী নাম কী সুপর্ণা?”

বইয়ে যদিও লেখা “গল্প সংকলন”, কিন্তু আমার বিশ্বাস করতে ইচ্ছে করছেনা সেকথা। ইচ্ছে করছেনা আলাদা কোন ফর্মে ফেলে তারপর লেখাগুলোকে পড়ার। পড়তে পড়তে আমি ভাবতে চেষ্টা করছিলাম, এই বইয়ের সব লেখাগুলির জোড় কোথায় লুকিয়ে? একই লেখকের লেখা, এ ছাড়া কি অন্য কোন সমানতা নেই?
তখন লেখাগুলির বাস্তবতার পরিমণ্ডল নিয়ে ভাবতে চেষ্টা করলাম, দেখলাম – কোন লেখাই আমাদের পরিচিত বাস্তবতার ছবি নয়। তারা যে পুরোপুরি পরাবাস্তব তাও নয়, তারা অলোকপর্ণার নিজস্ব বাস্তব বা ওর নিজস্ব স্বপ্নের অংশ। অনেক লেখার ভিত আমাদের বাস্তবতায় লুকিয়ে কিন্তু প্রতিটা লেখার বয়ানেই লেখক ক্রমশ ঈশ্বর হয়ে উঠতে চেয়ে আমাদের বাস্তবতা গুলো মিলিয়ে দেন তার কল্পনায়, বা তার কাম্য যে বাস্তব সেখানে। এভাবেই তো উপকথার জন্ম হয়, লেখক যখন তার বাস্তবতা কল্পনা করেন।

বইটা শুরু হয়েছে The Beatles এর Across the universe গানটি দিয়ে যার শেষ চারটে লাইনে খালি একটাই কথা থাকে, “Nothing’s gonna change my world”

সত্যিই এই বইয়ের এক গল্প থেকে আরেক গল্পে আঙ্গিক বদলেছে, বিষয় বদলেছে, স্পেস বদলেছে, চরিত্র বদলেছেকিন্তু লেখকের দেখার ভঙ্গীটি, বা তার উপলব্ধি বদলায়নি মোটেই লেখক অনড় থেকে গেছেন তার ব্যক্তিগত রাজনীতিতে তার কল্পবাস্তবতা কী তাকে রুদ্ধ করে দিয়েছে তবে? প্রশ্ন আসে

আমি চেষ্টা করি বুঝতে সেই মানুষদের, প্রতিটা গল্পে যাদের দুম করে নিয়ে এসে ফেলা হয়েছে। যাদের চরিত্র ঠিক যতটুকু তার প্রয়োজন গল্প বলতে, লেখক ততটাই উন্মুক্ত করেছেন। এই জন্যে হয়ত এই লেখাগুলো এক আবেশ বা এক ধারণা তৈরীর জায়গাতেই থেকে যাচ্ছে কোথাও। তবে ভাবতে শুরু করি আবেশ তৈরী করা বা ধারণার জন্ম দেওয়া বা এক কল্পবাস্তবের সীমানাতে নিয়ে যাওয়াই কি শুধু লেখার উদ্দেশ্য হবে? আবার প্রশ্ন আসে ...
আসলে এই বিচারেও এক ভুল থেকে যাচ্ছে কোথাও হয়ত আমার নিজস্ব পছন্দের আঙ্গিকে ফেলে আমি দেখতে চাচ্ছি এই বইয়ের লেখাগুলোকে।

যেই মানুষগুলো চরিত্র হয়ে আসছে আমার ইচ্ছে করে তাদের আর বিশদে জানতে, তারা কথায় কথায় রবীন্দ্রসঙ্গীত গায় বা শুক্রবারে বিয়ার পছন্দ করে এই ইনফরমেশনটুকু আমার কাছে কিছু ক্ষেত্রে যথেষ্ট বলে মনে হয়না। মনে পড়ে যায় Godard এর Pierrot le Fou ফিল্মের এক কথোপকথন

Radio: … garrison already decimated by the Vietcong, who lost 115 of their men …
Woman: it’s awful, isn’t it, it’s so anonymous.
Man: What is?
Woman: They say 115 guerillas, yet it doesn’t mean anything, because we don’t know anything about these men, who they are, whether they love a woman, or love children, if they prefer the cinema to the theatre. We know nothing. They just say… 115 dead.

অলোকপর্ণার এই লেখাগুলোয় একেবারে যে আমরা চরিত্রদের জানছিনা যে তা নয়, কিন্তু তার যাত্রার কোন পূর্ণতা নেই।

কিছু লেখায় নানান গুরুত্বপূর্ণ সামাজিক/রাজনৈতিক বক্তব্য উঠে এসেছে – রেসিজম, জিহাদ, বিপ্লব। আমার সেই লেখাগুলিকে কিছুক্ষেত্রে আরোপিত মনে হয়েছে, মনে হয়েছে বক্তব্যের ভাঁজে অলোকপর্ণার লেখার যেই স্বাভাবিক চলন তা গেছে হারিয়ে।

আবার বেশ কিছু লেখায় এক অদ্ভুত সম্পূর্ণতা আছে, তা যেন লেখার বাইরে এসে ছবি হয়ে উঠেছে। যেমন “ও” গল্পটি - তার চলন, তার আবহ, তার অন্তর্গত চরিত্রদের যাত্রা সবই ভীষণ পরিমিত, ভীষণ নতুন।
বাংলা গল্পের এই দুর্দিনে আজও যেই কজন বাংলা গল্পকে এক আন্তর্জাতিক মানুষের চোখ দিয়ে দেখেন, তার মধ্যে অবশ্যই অলোকপর্ণা একজন। এই বইয়েও তার প্রতিফলন রয়েছে কিছু লেখায়

এই লেখাটা লেখার সাথে সাথে আমি আরেকটি ছোটগল্পের বই পড়ছিলাম – Murakami’ After The Quake হাওয়া শহরের উপকথার জগৎ কোন না কোন ভাবে মিশে যাচ্ছিল মুরাকামির সেই কল্পবাস্তবতার সাথে, আর আমার ভালো লাগছিল, বেশ ভাললাগছিল দেখে যে এখনও এক বাংলা গদ্যকার তার নিজের বাস্তবতা সৃজন করতে পারেন
যেই বাস্তবতা, যেই আবহ, যেই ডিসকোর্স বংলা গল্পে এর আগে প্রায় আসেনি বললেই চলে



- রাজর্ষি মজুমদার
আঙ্গিক, বইমেলা সংখ্যা, ২০১৯ 




মন্তব্যসমূহ

জনপ্রিয় লেখা