দু'টি লেখা
|| বিবস্বান দত্ত ||
আমি একটা ছেলেকে চিনতাম যে মাঝে মাঝেই চোখ বন্ধ করে নিজেকে বলত, কষ্ট পাব না , কষ্ট পাব না, কষ্ট পাব না... বলেই চলত। আর সেই সময়েই সে টের পেত তার বুকে সমুদ্র ভেঙে পড়ছে। পূর্ণিমার সমুদ্র যে কী ভয়ংকর সে সেই দিনগুলোয় টের পেত।
আসলে চোখ বন্ধ করার আগেই কীভাবে যেন সে দেখতে পেয়ে যেত স্বপ্নের দুথালা ভাত। দেখতে পেয়ে যেত একটি ঘর। সে দাঁত চিপে বলত, দেখব না। এসব কিছু দেখব না। অথচ যৌথতার লুপ্তপ্রায় পাখি তার স্বপ্নের মধ্যে দেখা দিয়ে যায়। সে ভাবে স্বপ্নে কীভাবে চোখ বন্ধ রাখব!
নিজেকে সে বলে, তোমার জন্য কি মানুষ জুড়ে থাকতে ভুলে যাবে? শুধু অকারণে নিতান্ত অকারণে, তোমার, শুধু তোমার মন খারাপ হয় বলে কি লুকিয়ে পড়বে এই পৃথিবীর সমস্ত জোড়া শালিখ? তোমার নাম কি শুভেচ্ছা নয়? তুমি কি বই হয়ে, ফুল হয়ে, অভিমান ভাঙানোর চকলেট হয়ে কখনো যাওনি মুমূর্ষু নদীর ধারে? তুমি কি কখনো ভালোবাসনি বালক! তাহলে এ কষ্ট কেন?
যারা ভালোবাসে তারা পায় আদিগন্ত সবুজ মাঠ। তাদের কষ্ট হয় না। তারা শুধু হাওয়া হয়ে ছুঁয়ে যায় সমস্ত ঝরে পড়া পুষ্পকুঁড়ি। তারা শুধু ভালো থাকে। মানুষ ভালো আছে বলে তারা শুধু ভালো।
তারা আসলে এলোমেলো চৌপাই। তারা একসময়ের তুলসীদাসী গান। তারা সমস্ত নিরক্ষর বুকে ভক্তির অক্ষর। তারা আমার মায়ের আঁচল দেওয়া সান্ধ্য প্রণাম। তুমি তাদের মতো হও। ঈর্ষা ছেড়ে ভালোবাসো। ভালোবেসে একবার অন্তত একবার হাত খুলে দাও! দেখবে তোমার হাত থেকে জন্ম নিচ্ছে নতুন জনপদ। তোমার হাত থেকে ছড়িয়ে পড়ছে লোকগীতি। তোমার হাত শেষ বিকেলের এক চিলতে রোদ হয়ে ঝরে পড়ছে শ্মশান ঘাটে। ঘট ভাঙা অস্থি তোমার থেকে শিখে নিচ্ছে গান। আদিগন্ত টলমল পায়ে তোমার কাছে ছুটে আসছেন, হ্যাঁ, ঈশ্বর।
______________
তারপর পাগলটা একদম আমার পাশে চলে এল। " কী ? পুজো ভালো কাটল? কী খেলি পুজোয়? মাংস হয়েছিল?"
পা চালিয়ে খানিক এগিয়ে গিয়ে দেখি আবার একই প্রশ্ন একই ভাবে আরেকজনকে করছে। যেন কত দিনের চেনা। খুব আপন। শেষ শরতের সন্ধে তখন সবে চোখ মেলছে। হালকা ঠান্ডার দেহ যেন আড় ভেঙে উঠল। মনের ওপর মনখারাপের সর পড়ছে। রাস্তার আলোগুলো জ্বলেনি তখনও। কদম ফুল গন্ধ হয়ে চেপে বসছে বুকের ওপর। আর একজন পাগল পৃথিবী জোড়া আত্মীয় স্বজনের কুশল জেনে ফিরছে।
ওকে দেখে মনে হল, সব মানুষ একদিন ঠিক এতটাই একা হয়ে যাবে। সবার একদিন আর একা থাকতে ভালো লাগবে না। সবাই একদিন এভাবে স্বজন খুঁজবে। প্রত্যাখ্যাত হবে। বারবার হবে। কিন্তু মন আর খারাপ করবে না তার। মনখারাপের সময়ই থাকবে না। থাকবে না উত্তরটুকু শোনার সময়। উত্তরের বুকেই তো লুকিয়ে থাকে কাছে টানা অথবা দূরে ঠেলে দেওয়া! উত্তরের জন্য যে প্রশ্নের সময় নেই, সেই প্রশ্ন আসলে বিকেলের শেষ রোদটুকুর মত। সবাইকে ছুঁয়ে ছুঁয়ে খুব তাড়াতাড়ি ফুরিয়ে যায়।
পাগলটা হেঁটে যাচ্ছে। এক মানুষের থেকে অন্য মানুষে। সবাইকে জিগ্যেস করছে কেমন আছ? কেমন কাটল পুজো? উত্তরের সময় নেই ওর। ওকে যে অনেকজনের কাছে যেতে হবে। এক পৃথিবী স্বজন।
কে বলবে ওর কেউ নেই?
|| আঙ্গিকে কবির গদ্য ১০ ||
মন্তব্যসমূহ