নির্মীয়মান


|| তন্ময় ভট্টাচার্য || 


(১)

একটা অনুভূতিহীন লোক তোমার সামনে বসে আছে। এদিক-ওদিক তাকাচ্ছে, মাথা চুলকোচ্ছে কিন্তু তুলতে পারছে না কিছুতেই। কারণ সে জন্ম থেকে দেখে এসেছে বেরোলেই বিশাল একটা নারকেল গাছ। ঠাকুরদাকে সে দেখেনি, গাছ দেখেছে আর ভেবেছে তিনি এইভাবে ছড়িয়ে আছেন। আজ, যখন মাথার ওপর দেখছে ঝকঝকে আকাশ কিন্তু সে আর আকাশের মধ্যে বাধা নেই একটুও, হেমন্তের সন্ধেবেলা হাত নাড়িয়ে ডাকার নেই কেউ, শত চেষ্টা করেও পুরনো স্মৃতি ফিরিয়ে আনতে পারছে না কিছুতেই। যা নেই, নেই। একটা কাটা গুঁড়ি, কাল বা পরশু শিকড়শুদ্ধু উপড়ে ফেলা হবে। কিছু ছড়ানো-ছিটানো মুকুল, প্রশ্রয় পেলে একদিন ঘটের ওপর বসতে পারত গামছা জড়িয়ে। লোকটা তোমার দিকে তাকাচ্ছে না। হাতের মেটে রঙে চুমো খাচ্ছে বারবার। গালে-কপালে ঘষে যাচ্ছে ইটের টুকরো, ছড়ে যাচ্ছে কিন্তু লিখন বদলাতে পারছে না। টেরই পাচ্ছে না বেচারা। ভাঙা দেওয়ালের প্রতি তার এই নিঃস্পৃহতা দেখে অবাক হচ্ছ তুমি। চিনতে পারছ না। বলেছিল, একদিন এইসব দেওয়াল ভরে যাবে কবিতায়, চালের গুঁড়ো আর আলতা দিয়ে এঁকে ফেলবে তোমার আসার পূর্বাভাস। হাসছ। দূরে বসে, হাসার মতো উপভোগ্য কাজটুকু চেখে নিচ্ছ তুমি। অথবা কাছেই, মাথা তুলছে না বলে দূরের হয়ে গেছ নির্ঘাত। প্যারা ভাঙছে না বলে ছেড়ে যাচ্ছ মাঝপথে। লেখাকে। লোকটাকে। অক্ষরগুলো বাস্তুসাপের মতো ড্রেন বেয়ে নেমে যাচ্ছে ড্রেনে।

(২)
তাকাল আর ছিটকে সরে গেলে দূরে। যে চোখে তোমার ছায়া পড়ত, আজ তার গ্রীষ্মভাব সহ্য করতে পারছ না কিছুতেই। পালাও। পিছিয়ে যেতে-যেতে স্বীকার করো দোষ। ঢিল ছোঁড়ো। কঞ্চি দিয়ে খুঁচিয়ে দাও লোকটার হৃৎপিণ্ড। তাতেও যদি বিকার না হয়, অথবা এমন বিকার থেকে মুক্তি না-ই পায় যদি, পাগল বলে রটিয়ে দাও চারপাশে। ওই তো, হাসছে, তোমার পূর্বোক্ত হাসির প্রান্তটুকু ছিনিয়ে নিয়ে আধখেঁচড়া করে ফেলছে ঠোঁট। মন চেপে ধরছ। এটাও ছিনিয়ে নিলে সেরে উঠতে পারে। এত জোরে চেপে ধরতে পারে, ইটরঙা হয়ে যাবে তুমি। ভেঙে পড়বে। ইঙ্গিত হয়ে জমে থাকবে চৌকাঠে, পাপোশের নিচে, জানলার কার্নিশে যতক্ষণ না জলে ভিজিয়ে তুলে নেওয়া হচ্ছে সবটুকু। বাদ দাও। বোবা তাকানোর দিকে আঙুল নাচিয়ে বল এইজন্য পেরে উঠলে না। অজুহাতের পর অজুহাত সাজিয়ে নতুন একটা ঘরে পুরনো মানুষকে পেতে চাইছ। আর লোকটা, নতুন ঘর তৈরি হতে দেখেও বাইরে বসে আছে কেননা ঢুকলে তোমাকে নিয়েই, নইলে আবার ভেঙে দেবে।

(৩)
নিজের সঙ্গে কথা বলছে লোকটা। জোরে-জোরে। বাঁ-হাত দিয়ে চেপে ধরছে ডান কাঁধ। চুলে আঙুল চালাচ্ছে ঘনঘন। বুকের মধ্যে চেপে বসা ভিতে শাবল চালাতে চাইছে। পিঠে গেঁথে নিচ্ছে জং-ধরা শিক। আর যাই হোক, একা ভাবতে চাইছে না নিজেকে। ছটফট করছে। সিগারেটের ছ্যাঁকা দিচ্ছে শরীরে। সরিয়ে নিচ্ছে। দাঁতে দাঁত চেপে দুটো বাজে কথা বলল। এইমাত্র। ঘুঁষি মারল দেওয়ালে। নখ ফেটে গেছে। রক্ত বেরোচ্ছে গলগল করে। আছে, কেউ অন্তত আছে। ভেতরে। আরও কেউ থাকবে বলেছিল। কাঁদছে। মাথা ঝাঁকিয়ে ফেলে দিতে চাইছে স্মৃতি। পারছে না। লোকটা ঘুমোতে পারছে না। জাগতে পারছে না। খানিক পরে, কাঁদতেও পারছে না আর। দোষ দিচ্ছে। দোষ নিচ্ছে। নিজেকে গুটিয়ে ভরে ফেলছে একটা দেশলাই বাক্সে। বেরিয়ে এসে, বারুদে পিঠ ঘষছে। আগুন জ্বলল। ভয় পেয়ে, ঝাঁপ দিল জলে। জল খেল। হিসি করল। লোকটা আর ভাবতে পারছে না। হাসতে পারছে। হাসতে হাসতে, এগিয়ে যেতে পারছে লোকটা। দশবছর। বিশবছর। অন্য কোথাও, অন্য কোনো ভাষা শিখতে পারছে সে। প্রত্যেকটা কথা নতুন করে বলতে পারছে তোমায়। জবাব কি একই থেকে যাবে?


|| আঙ্গিকে কবির গদ্য ৩ ||

মন্তব্যসমূহ

জনপ্রিয় লেখা